জুমবাংলা ডেস্ক : ৪৩তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী মো. সিরাজ আলী। এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরুর আগের দিন থেকে অসুস্থ ছিলেন তিনি। আর তৃতীয় পরীক্ষার (আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি) দিন ছিলেন শয্যাগত।
সেদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে তেমন কিছু না লিখেই জমা দেন খাতা সিরাজ। পরে বাকি পরীক্ষাগুলো না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বন্ধু-বান্ধব ও বড় ভাইয়ের অনুরোধে এরকম অসুস্থতা নিয়েই তিনি যান পরীক্ষার হলে। তাই ৪৩তম বিসিএস নিয়ে তেমন কোন প্রত্যাশাই ছিল না সিরাজের। তবে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে তার উত্তীর্ণ হওয়া নিয়ে তিনি নিজেই অবাক হয়েছেন।
মো. সিরাজ আলী বলেন, আমি ৪৩তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। বন্ধুরা এখন মজা করে বলে যে, আমি এক বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়েই ক্যাডার হলাম!
কিভাবে একটা পরীক্ষা না দিয়েই ক্যাডার হলেন— জানতে চাইলে সিরাজ বলেন, কেউ যদি বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাগুলোর যেকোনো একটা পরীক্ষায় উপস্থিত না হয় তাহলে তার রেজাল্ট আসবে না, তখন রেজাল্ট আসবে ফেল। আমি উপস্থিত হয়েছিলাম কিন্তু তেমন কিছু না লিখেই খাতা জমা দিয়ে চলে এসেছিলাম।
দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম ও বেড়ে উঠা সিরাজের। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা সকলের জীবনের সফলতার গল্পটা কমবেশি একই সুতোয় গাঁথা হলেও সিরাজের গল্পটা একটু আলাদা। কৃষক বাবা-মাকে পরিবারের ব্যয় মিটিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করতে হয় গ্রামের প্রাইমারি ও হাইস্কুল থেকে। মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ+ পেলেও আর্থিক সংস্থানের অভাবে ভাল কোন কলেজে ভর্তি হতে পারেননি সিরাজ। ভর্তি হতে হয় বাড়ি থেকে ১০ কি. মি. দূরবর্তী এক কলেজের মানবিক বিভাগে। কলেজে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল সাইকেল। গ্রীষ্মের তাপদাহ, তুমুল বর্ষা, কিংবা কনকনে শীতে সাইকেলে চেপে কলেজ যাতায়াত করতে হতো তাকে।
সিরাজ জানান, অসুস্থতার কারণে কলেজের পড়াশোনা থমকে গিয়েছিল তার। তবে হাল ছাড়েন নি তিনি। এইচএসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। খরচের টাকা যোগাতে তার টিউশনি করাতে হয়েছে, কাজ করেছেন একুশে বইমেলাতেও।
তবে প্রথম থেকেই তার লক্ষ্য ছিল জীবনে ভালো কিছু অর্জন করার। তাই বিভাগের পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যারিয়ার সম্পর্কিত পড়াশোনার দিকে নজর ছিল তার।
সিরাজ জানান, ৪১তম বিসিএস তার প্রথম বিসিএস ছিল। তখনও একাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি শেষ হয়নি। তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো পরীক্ষা দিতে পারেন নি। ইচ্ছে ছিল পরের বিসিএসে ভালো কিছু করার।
“তাই এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বসেছিলাম। পরে ২০২২ সালেল ২০ জানুয়ারি প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। আমি উত্তীর্ণ হলাম। পুরোদমে শুরু করলাম লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি। সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করে ক্ষুরধারা প্রস্তুতি নিতে আমি যখন বুঁদ হয়ে আছি ঠিক তখনই ওই বছরের ৬ মে আমার প্রাণপ্রিয় বাবা পরপারে পাড়ি জমালেন।”
তিনি বলেন, হঠাৎ বাবার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। এ কষ্টটা, যারা বাবাকে হারিয়েছে একমাত্র তারাই অনুভব করতে পারবে। প্রতিযোগিতার কাতার থেকে ছিটকে পড়লাম বিষাদসিন্ধুতে। কিছুদিন পর পরিবারের লোকজন আমাকে একপ্রকার জোর করেই ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন। পড়াশোনাতে মন আর সায় দেয়না।
সিরাজ জানান, ৪৩তম বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষা (২৪ জুলাই ২০২২-থেকে ৩১ জুলাই ২০২২) যেহেতু সন্নিকটে তাই অগত্যা চেষ্টা করলাম মোটামুটি একটা প্রস্তুতি নিতে। সে বছর ঈদ-উল-আজাহা অনুষ্ঠিত হয় ১০ জুলাই। যেহেতু ২৪ জুলাই থেকে পরীক্ষা শুরু এবং আমার পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে তাই বাবার মৃত্যুর পর প্রথম ঈদটাও পরিবারকে ছাড়াই ঢাকায় করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
“এ সময়ের মধ্যে যতটুকু পারলাম প্রস্তুতি নিলাম। তবে এবার বাধ সাধল আরেক প্রতিবন্ধকতা। ২৪ জুলাই লিখিত পরীক্ষা শুরু, আর ২২ জুলাই বিকেল থেকে আমার অসুস্থতা (জ্বর) শুরু। ২৩ তারিখ বিকেল হতে হতে আমি প্রায় শয্যাগত। বিছানা থেকে পরীক্ষার হল, পরীক্ষা শেষ করে এসে আবার বিছানায়। এ রুটিনে প্রথম দুটো পরীক্ষা দিলাম। ঔষুধ খেয়েও জ্বর কমছিলনা তাই আমি মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছিলাম।”
তিনি জানান, আমার লিখিত পরীক্ষার আসন ছিল ঢাকার তেজগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনতলার একটি কক্ষে। এক বন্ধু আমাকে ধরে ধরে সিঁড়ি উঠিয়ে পরীক্ষার রুমে রেখে আসত, তারপর ফেরার সময় আবার সাথে করে নিয়ে আসত।
“তৃতীয় পরীক্ষা ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি। পরীক্ষা শুরু হল, আমি বেঞ্চে কোনোভাবেই বসে থাকতে পারছিলাম না। পরীক্ষা শুরুর পর ১ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার আগে কোন পরীক্ষার্থীর কক্ষ থেকে বের হওয়ার নিয়ম নেই। পরীক্ষকের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে বের হলাম। কিছুক্ষণের ব্যবধানে ২ বার বমি হলো!”
“এরপর স্যালাইন খেয়ে একটু স্টাবল মনে হচ্ছিল। আবার খাতা কলমের সাথে যুদ্ধ শুরু করলাম। টেবিলে মাথা লাগিয়ে কিছু একটু হলেও লিখার চেষ্টা করলাম। সেটাও পারলাম না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই খাতা জমা দিয়ে চলে আসতে বাধ্য হই। কক্ষের অন্য পরীক্ষার্থীরা এবং পরীক্ষক আমার দিকে আফসোস এর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।”
সিরাজ জানান, সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি পরীক্ষাগুলো আর দিব না। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও বড় ভাইয়ের অনুরোধে এরকম অসুস্থতা নিয়েই কোন রিভিশন ছাড়াই বাকি পরীক্ষাগুলো দিলাম। তাই ৪৩তম বিসিএস নিয়ে তেমন কোনো প্রত্যাশাই ছিল না। ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট যখন লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো, আমি উত্তীর্ণ হয়েছি দেখে একটু অবাকই হয়েছিলাম।
“ভাবলাম আশার প্রদীপটা যেহেতু এখনও নিভে যায়নি, সেহেতু শেষ চেষ্টাটা করতে ক্ষতি কি? জোরেসোরে ভাইভার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। কিন্তু প্রত্যাশিত ভাইভা দিতে না পারায় মনে হলো, প্রদীপ নেভার আগে যেমন একবার দপ করে জ্বলে ওঠে, আমার ক্ষেত্রেও মনে হয় এমনটা ঘটল।”
সিরাজ জানান, এসব কিছুর পর নিজেকে মাঝে মাঝে বড় অভাগা বলে মনে হত। মনে হত প্রতিবন্ধকতার গোলকধাঁধায় আমি ঘুরপাক খাচ্ছি। তবে আমি হাল ছেড়ে দেবার মানুষ নই। তাই সবকিছু আবার রিস্টার্ট করার পরিকল্পনা করছিলাম।
“এর মধ্যেই ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার বিষয় জানতে পারলাম। আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, আমি এই বিসিএস এ যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি, এখান থেকে কিছু প্রত্যাশা করা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে পড়বে।”
তিনি জানান, সেদিন বিকেল ৫টার দিকে রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। ভয় ভয় দৃষ্টিতে রেজাল্ট শিটে চোখ রাখলাম। রেজাল্ট শিটে আমার রোল নম্বরটা যখন খুঁজে পেলাম, তখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল সুপারিশপ্রাপ্ত ২১৬৩ জন ক্যাডারের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ভাগ্যবান। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমার স্বপ্নটা অবশেষে সত্যি হলো। আমার মনে হয় কেউ যদি তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে স্বপ্ন পূরণে লড়ে যায়,সৃষ্টিকর্তা তাকে নিরাশ করে না। এরকম ভালো লাগার মুহূর্ত প্রত্যেকের জীবনে আসুক।
সিরাজ বলেন, বিষয়ভিত্তিক ২০০ নম্বরসহ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা মোট ৯০০ নম্বরের। আর লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে হলে ৯০০-এর মধ্যে ন্যূনতম ৪৫০ নম্বর পেতে হবে। তবে কোন বিষয়ে ৩০% এর কম নম্বর পেলে, ওই বিষয়ে সে শূন্য পেয়েছে বলে বিবেচিত হবে।
“কোন বিষয়ে যদি কেউ শূন্য পায়, তাহলে বাকি বিষয়গুলোর নম্বর যোগ করে যদি ন্যূনতম ৪৫০ নম্বর হয় তাহলেও সে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। তারপর ২০০ নম্বরের ভাইভা হয়। পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর ও ভাইভায় প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে সে নম্বরের ভিত্তিতে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশ করা হয়। তবে ক্যাডার পেতে হলে সচরাচর লিখিত পরীক্ষায় ৫০০-এর উপরে নম্বর থাকতে হয়।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।