জুমবাংলা ডেস্ক : ‘আগের দিনের দেশি ধানের কথা মনে অইলে অহনও গেরান (ঘ্রান) নাহে (নাকে) লাগে। ভাতের মজা জিবরায় (জিহ্বায়) লাইগ্যা থাহতো (থাকতো)। যেকুনু ছালুন (তরকারি) দিয়া খাওনের রুচি অইত। হুদা ভাতও পেড ভইরা খাওন যায়, দেশি চালের ভাত অইলে।’
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার হাতপাটন গ্রামের ষাটোর্র্ধ্ব কৃষক দ্বিজেন্দ্র তালুকদার হারিয়ে যাওয়া দেশি ধানের স্মৃতিচারণ করে আক্ষেপের সুরে বলছিলেন এসব কথা। তার মতো এলাকার প্রবীণ কৃষকদের স্মৃতিতে এখনো রয়েছে হাওড়ের সুস্বাদু ও সুগন্ধি রাতা, বাঁশফুল, টেপি, গছি, লাখাইয়া, কালিজিরা, জগলি বোরো, বিন্নিধান।
স্থানীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী এসব ধান কালের পরিক্রমায় উচ্চ ফলনশীল ধানের আধিপত্যে হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, দেশি ধানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বেশি তেমনি বন্যার ঝুঁকিমুক্ত। তাছাড়া ফলন কিছুটা কম হলেও স্বাদ ও অপূর্ব গন্ধের কারণে এই ধানের চালে বেশি দাম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষকরা জানান, স্বাধীনতার পর সবুজ বিপ্লব আন্দোলনে অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে দেশি ধান। বানের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই ধান ছিল হাওড়ের কৃষকের ভরসা ও শক্তির প্রতীক। বেশি ফলনের কথা বলে সরকারি- বেসরকারিভাবে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান চাষ করা হচ্ছে চার দশক ধরে। তবে ফলন বেশি হলেও দেশি ধানের তুলনায় উফশী ধান পাকে দেরিতে। ফলে আগাম বন্যায় প্রতি বছর এই ধানের ক্ষতি হয়। সে তুলনায় অল্প জমিতে কৃষকরা দেশি ধান রোপণ করে লাভবান হচ্ছে। খরচ ছাড়াই চাষকৃত দেশি ধান পানি আসার আগেই কেটে ফেলা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে অনন্য হাওড়াঞ্চলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাওড় এলাকার কিছু কৃষক আজো দেশি ধান চাষ করছেন।
উপজেলার বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, তিনি টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ২৫ বিঘা জমিতে দেশি জাতের ধান শাইল বোরো চাষ করেছিলেন। বীজ ছিল নিজের ঘরের। সর্বসাকূল্যে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ক্ষেতে চারা রোপণের পর কোনো সার বা কীটনাশক দেননি। আগাছা দমণ করতে হয়নি, দিতে হয়নি পানি সেচ। ফলনও হয়েছে ভাল। মৌসুমে সবার শেষে রোপণ করে সবার আগে সোনা রংয়ের ঝকমকে ধান গোলায় তুলেছেন।
তিনি আরো জানালেন, ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর ধান উৎপাদন হয়েছে বিঘাপ্রতি ১০ মণ হারে প্রায় ২৫০ মণ, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা।
জানা যায়, হাওড়াঞ্চলে একসময় প্রায় ২২৮ প্রজাতির বোরোধান চাষ হতো। স্থানীয় কৃষকদের দাবি, উফশী ও হাইব্রিড জাতের ধানের চাষ সাময়িক ভালো ফলাফল দিলেও এর বহুমাত্রিক ক্ষতিকর প্রভাব হাওরের চিরায়ত কৃষিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে উফসী জাতের ব্রি ২৮, ব্রি ২৯, ব্রি ৮৯ ধানে মহামারি আকারে ব্লাস্টের সংক্রমণ তার উদাহরণ। এ পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাওড়ের গভীর পানির ধানের জাতগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে অধিক ফলনশীল করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।
মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মীর হাসান আল বান্না বলেন, দেশীয় গভীর পানির ধানের জাতকে উচ্চ ফলনশীল করতে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ আবিষ্কৃত ধানের জাতগুলোর মধ্যে দেশীয় জাতের কম্বিনেশন রয়েছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর মধ্যনগর উপজেলায় ১৩ হাজার ২৬৪ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৪৮১ মে. টন। এর মধ্যে ব্রি-২৮ ধানের চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে। আর দেশীয় ধানের চাষ হয়েছে মাত্র ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ হেক্টর জমিতে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।