জুমবাংলা ডেস্ক: রাজধানীর আবদুল গণি রোড। সচিবালয়পাড়ায় রেল ভবনের পাশেই কাচে ঘেরা সুসজ্জিত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের আটতলা ভবন। হালকা সাদা রঙের ভবনটির পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর কার্যালয়।
১৮ এপ্রিল, সকাল পৌনে ১১টা। লিফট থেকে নেমেই দেখা গেল, ডেস্ক সামলাচ্ছেন এক নারী কনস্টেবল। তার সহযোগিতায় ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতি মিলল। ভেতরে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া। বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। সবার পরনে পুলিশের পোশাক। সামনে দূরালাপনী, কম্পিউটার আর কানে হেডফোন। দৈনিক সমকালের প্রতিবেদক বকুল আহমেদ-এর প্রতিবেদনে বিস্তারিত উঠে এসেছে।
রিং বেজে উঠতেই টেলিফোনের রিসিভার তুললেন পুলিশ কনস্টেবল হারুন অর রশিদ। কথা শুরু, ‘আসসালামু আলাইকুম, শুভ সকাল। জাতীয় জরুরি সেবা থেকে বলছি। কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি…।’ ফোনের অন্য প্রান্তে থাকা সেবাপ্রত্যাশী এক নারী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি পুলিশ পাঠান, স্বামী ঘরে আটকাইয়া আমারে পিটাইতাছে।’ এরপর ওই নারীর নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করলেন কনস্টেবল হারুন। সেবাপ্রত্যাশীকে হারুন বললেন, ‘অনুগ্রহ করে লাইনে থাকবেন। সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করবেন না।’ সেবাপ্রত্যাশীকে এসব পরামর্শমূলক কথা বলার মধ্যেই ইসলামপুর থানার ডিউটি অফিসারকে ফোন করে কনফারেন্সে ওই নারীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। দ্বিতীয় ধাপে তদারক কর্মকর্তা এসআই জহুরুল ইসলামপুর থানায় ফোন করে জানতে পারেন, এসআই আলিম ঘটনাস্থলে রওনা দিয়েছেন। পরে ওই নারীর সঙ্গে ৯৯৯ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পুলিশ আসার খবর শুনেই তার স্বামী পালিয়েছে।
যখন শুরু, যেভাবে চলছে :২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর চালু হয় জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’। তিনটি জরুরি সেবা- অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশি সেবা দিতেই পথচলা ৯৯৯-এর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিপদাপন্ন মানুষ প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে সেখানে সরাসরি ফোন করে। একই সময়ে ৯০ জন সেবাপ্রত্যাশী নিতে পারেন সেবা। কাজ হয় তিন শিফটে।
৯৯৯-এ এখনও নিজস্ব কোনো জনবল নেই। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে জনবল সেখানে সংযুক্তি করা হয়েছে। তবে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৯৯৯-এর জন্য এক হাজার ৮৪৭ জনের নিজস্ব জনবলের প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনও নেই ৯৯৯-এর স্থায়ী কার্যালয়, তবে স্থায়ী স্থাপনার জন্য ডেমরার আশুলিয়ায় কেনা হয়েছে জমি।
সেবামূলক এই সংস্থার প্রধান হিসেবে রয়েছেন একজন অতিরিক্ত ডিআইজি। এ ছাড়া আছেন একজন পুলিশ সুপার, তিনজন সহকারী পুলিশ সুপার, ৩৫ জন পরিদর্শক, ২৬ জন উপপরিদর্শক (এসআই), ৩৪ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এবং ৩২৩ জন কনস্টেবল। এর মধ্যে ৬৩ জন নারী। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের আটজন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছয়জন কর্মরত এখানে।
অকাজের ফোন :অকারণেও বহু মানুষ ফোন করে ৯৯৯-এ। ভূতুড়ে ফোনও (কল করে কথা বলে না) আসে বেশ। এ ছাড়া অপ্রয়োজনে ফোন করে সেবা না চেয়ে উদ্ভট কথাবার্তা বলেন কেউ কেউ। মিসড কল দেওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। একই নম্বর থেকে একাধিকবার ব্লাঙ্ক কলও দেওয়া হয়। এসব ফোন নম্বরে ৯৯৯ থেকে সতর্ক করে পাঠানো হয় মেসেজ। এরপরও বারবার ফোন করে বিরক্ত করলে সেই নম্বর ব্লক লিস্ট করে রাখা হয়। যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে টেলিফোন করে বিরক্ত করলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে আইনে। এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে তা কার্যকর করার মতো উদাহরণ এখনও দেখা যায়নি। এ আইন বাস্তবায়ন করা গেলে ভূতুড়ে ফোনের উৎপাত অনেকটাই কমানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ৯৯৯-এ ফোন করা উচিত নয়। কারণে-অকারণে উদ্ভট কল করে ফোন ব্যস্ত রাখলে প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীরা বঞ্চিত হতে পারে।’
ভূতুড়ে কলারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ আইন বাস্তবায়নের বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। কয়েকটি ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।
৬৭.০৪ শতাংশ মানুষের অযথা ফোন :৯৯৯-এর কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় চার বছর চার মাসে ফোন এসেছে তিন কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার ৮৩৩টি। এর মধ্যে দুই কোটি ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৪৯৮টিই অপ্রয়োজনীয় ফোন; শতাংশ হিসাবে যা ৬৭.০৪। যার মধ্যে এক কোটি ৬১ লাখ ২৯ হাজার ৫৩৯টি ভূতুড়ে কল করে কোনো কথা না বলে চুপ থাকে ফোনদাতা। ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৫ জন ফোন করে সেবা চাওয়ার বদলে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলে। মিসড কলের সংখ্যা ৩৭ লাখ ২১ হাজার ১২৭টি। ৯৯৯ কিনা তা যাচাই করতে ফোন আসে ২৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩৭টি।
মোবাইল ফোনে সমস্যা, সমাধান বাতলে দিন :দুপুর ১টা ২০ মিনিটে বেজে ওঠে কনস্টেবল জাহাঙ্গীর আলমের ডেস্কের ফোনটি। রিসিভ করে কথা শুরু করেন তিনি। অন্য প্রান্ত থেকে সেবাগ্রহীতা জানাচ্ছেন, তার মোবাইল ফোনে সমস্যা। সমাধানের উপায় জানতে চান তিনি। ‘কলটি অপ্রাসঙ্গিক হওয়ায় সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো’ বলে ফোন রেখে দেন জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘জরুরি সেবার আওতার বাইরেও অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে মানুষ কল করে। ‘
কল গ্রহণকারী জাহাঙ্গীরের কাছে জানা গেল, সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় তার কাছে ৭৬টি কল এসেছে। এর মধ্যে জরুরি সেবার মধ্যে পড়ে এমন কল ছিল দুটি। দুটিই অ্যাম্বুলেন্স সেবা চেয়েছে। কল করেও কথা বলেনি ৪৪টি। বিভিন্ন পরামর্শ চেয়ে কল করার সংখ্যা ১২টি। স্বামী মারধর করে- এমন অভিযোগে তিন নারী কল করে সহায়তা চান। তিন শিশু ফোন করে তাদের মতো চেঁচামেচি করেছে।
কাজটা উপভোগ করেন কনস্টেবল পপি :২০১৮ সালের জুন থেকে ৯৯৯-এ কল গ্রহণকারী হিসেবে কর্মরত কনস্টেবল পপি আক্তার। তিনি বলেন, ‘৯৯৯-এর কাজটাকে খুব উপভোগ করি; কারণ এক জায়গায় বসে দেশের ৬৪ জেলার মানুষকে সেবা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এটা অনেক ভালো লাগার।’ তিনি জানান, অনেকেই ফোন করে গালাগাল করেন। এসব তিনি ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নেন।
৪৮৪৮টি ফোন তিন ঘণ্টায় :সোমবার সকালে তিন ঘণ্টা ‘৯৯৯’-এর কার্যালয়ে অবস্থানকালে সারাদেশ থেকে মোট ফোন আসে চার হাজার ৮৪৮টি। এর মধ্যে জরুরি সেবার কল ছিল মাত্র ১৭৬টি, এক হাজার ৮৯৭ জন ভূতুড়ে কল। ৫৮ জন অপ্রয়োজনে কল করে সেবা না চেয়ে উদ্ভট কথাবার্তা বলেছে। নানা তথ্য জানতে বা যাচাইয়ের জন্য কল করেছে ৯২৪ জন। নানা তথ্য চেয়ে পুলিশ সদস্যদের ফোন এসেছে ১২টি। নারী কলার ছিল ৫২ জন। শিশু কল ১৮৪টি। অন্যান্য কলারের মধ্যে ছিল কারও ফোনের রিচার্জ শেষ হয়েছে, কোথায় রিচার্জ করবে, ফোনের সিম নষ্ট হয়েছে, বকেয়া টাকা আদায় করতে পারছে না ইত্যাদি।
ঈদের দিন থেকে দেশের যেসব এলাকায় ৪৮ ঘন্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।