বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : চীন গত সপ্তাহে প্রথম ওপেন-সোর্স ডেস্কটপ অপারেটিং সিস্টেম (ওএস) চালু করেছে। বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা ঘোচানোর লক্ষেই এই চেষ্টা করছে দেশটি। তবে নাগরিকেরা এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করবে কি না সেটিই এখন চীনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন এই ওএসের নাম ‘ওপেনকাইলিন’, যা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না ইলেকট্রনিকস করপোরেশন’ বানিয়েছে। ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান চীনের সেমিকন্ডাক্টর, সফটওয়্যার এবং টেলিযোগাযোগ পণ্য তৈরি করে থাকে। এর লক্ষ্য, বিদেশি মালিকানাধীন সফটওয়্যারের বাজার দখল করা।
‘জাতীয় নিরাপত্তা’ ইস্যুতে হুয়াওয়ে এবং জেডটিই–এর মতো কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর চীন সফটওয়্যার প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার এ উদ্যোগ নিল।
চীনা কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালে সমস্ত সরকারি অফিস এবং প্রতিষ্ঠানকে তিন বছরের মধ্যে বিদেশি কম্পিউটার সরঞ্জাম এবং সফটওয়্যার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক বেন লিওং বলেন, ‘উইন্ডোজের মতো বিশ্বের প্রধান সফটওয়্যারগুলো মার্কিন কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এমন অনেক কোম্পানি চীন এবং চীনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই আইন পাস করে এসব বন্ধ করে দিতে পারে। যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’
তবে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ এবং অ্যাপলের ম্যাকওএসকে নিষিদ্ধ করা থেকে চীন এখনো যোজন দূরে।
ওয়েব ট্রাফিক বিশ্লেষণকারী স্ট্যাটকাউন্টারের মতে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চীনে ডেস্কটপ অপারেটিং সিস্টেমের প্রায় ৮৫ শতাংশ উইন্ডোজেরে দখলে। আর ম্যাকওএস সাম্প্রতিক বছরে বাজারের ৮ শতাংশ দখলে নিয়েছে।
বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো উন্নত প্রযুক্তিতে কাজ করা চীনা কোম্পানিগুলোতে আমেরিকান বিনিয়োগ বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র আইন করার চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
লিনাক্স-ভিত্তিক ওপেনকাইলিন চালু করার সময় কর্মকর্তারা চীনকে প্রযুক্তিতে নয়া শক্তি হিসেবে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন চেয়েছে। ওপেন-সোর্স সফটওয়্যারটি ব্যবহারকারীদের প্রাথমিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
ওপেনকাইলিনের ইউজার ইন্টারফেস অনেকটা উইন্ডোজ ১০–এর মতো। এটি চীনা এবং ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যায়। একটি চীনা-উন্নত অফিস স্যুট প্রি-ইনস্টল করা রয়েছে। যেটিতে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এবং এক্সেল ডকুমেন্টের মতো কাজ করা যায় এবং উইন্ডোজের এই সফটওয়্যারের সঙ্গে কম্পেটিবল।
কিন্তু ব্যবহারকারীরা এটি গ্রহণ করবেন কি না সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এটি মাইক্রোসফটের মতো সব প্রোগ্রাম এবং অ্যাপ পরিচালনা করা নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে সন্দেহ ও উদ্বেগ রয়েছে।
চীনা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ জিয়াওহংশুয়ে এক ব্যক্তি এই অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নিয়ে পোস্ট করেছেন। ওই পোস্টে তিনি জানান, ওপেনকাইলিনের টাচস্ক্রিন ফাংশন এবং ফটো-এডিটিং সফটওয়্যার চালানোর সক্ষমতা রয়েছে। তবে এতে কিছু ‘বাগ’ রয়েছে।
অধ্যাপক লিওং বলেছেন, ‘চীনকে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যারা সফটওয়্যারটিকে আরও ব্যবহার উপযোগী ও আকর্ষণীয় করে তুলবে। ওপেনকাইলিন চাইনিজ জনগণের প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠার ঘটনার চীনে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো বিষয় হবে। তখন মার্কিন বা পশ্চিমা কোম্পানির পণ্যের দিকে তাঁরা আর ঝুঁকবেন না।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে গুপ্তচরবৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির নিরাপত্তার অজুহাতে দেশটিতে হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করে। চীনা টেলকো জায়ান্টটিকে হারমোনিওএস নামে নিজস্ব ওএস তৈরি করতে বাধ্য করে। এ ওএস এখন কোম্পানিটির স্মার্টফোনগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ওএস অ্যান্ড্রয়েডের মতোই, স্মার্টওয়াচ এবং ট্যাবলেটেও চলে।
সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো মনোজ হারজানি বলেছেন, চীন স্বদেশি এই ওএসকে ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক করার চেষ্টাও করবে। যদিও ওএস তৈরি চিপ বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার ডিজাইনিংয়ের মতো ব্যাপার নয়।
এই জাতীয় দেশীয় সফটওয়্যার চালু করা সমাজের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের উপায় হতে পারে উল্লেখ করে মনোজ হারজানি বলেন, প্রযুক্তির আরও একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে নিল চীন। যা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার অপরিহার্য। যেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে চীনে আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনধিকার চর্চা করে আসছে। বিষয়টি মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রতি নিয়ন্ত্রণমূলক হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে চীনা গণমাধ্যমগুলো পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা হ্রাসের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকার ২০২১ সালে তার সফটওয়্যার শিল্পকে বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক প্রভাবসহ দুই বা তিনটি ওপেন সোর্স সম্প্রদায়’ তৈরির একটি পরিকল্পনা উন্মোচন করেছিল। এই উদ্যোগ কাজে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে জনপ্রিয় কোড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম গিটহাবের দ্বিতীয় এখন চীনা ব্যবহারকারীরা।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ হারজানি বিশ্বাস করেন, এই প্রযুক্তি জনপরিসরে ব্যবহার তখনই বন্ধ হবে যখন লোকেরা ওপেনকাইলিন প্রি–ইনস্টল করা কম্পিউটার কিনবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
হারজানি বলেন, বেশির ভাগ লোকজনই এখন কম্পিউটারে তেমন বসেন না, কারণ স্মার্টফোনেই তাঁরা সেসব কাজ সারতে পারেন। এই পরিস্থিতে ওপেনকাইলিন যদি বাকি সব অপারেটিং সিস্টেমের থেকে সেরাও হয়ে থাকে তবু বেশির ভাগ ব্যবহারকারী একটি নতুন ওএস ইনস্টল করতে চাইবে না।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে থেকে চীনের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ডিফেন্স টেকনোলজির গবেষকেরা কাইলিন নামে একটি অপারেটিং সিস্টেমের উন্নয়ন করছেন। প্রথম সংস্করণগুলো ফ্রিবিএসডি ভিত্তিক ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সামরিক এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান এটি ব্যবহার করবে। পরবর্তীতে কাইলিন লিনাক্স-ভিত্তিক হয়ে ওঠে এবং নিওকাইলিন নামে ২০১০ সালে রিলিজ করা হয়।
চীনে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ কম্পিউটারে নিওকাইলিন প্রি–ইনস্টল করা থাকে। বর্তমানে কাইলিন এবং নিওকাইলিন সম্মিলিতভাবে সরকারি খাতের ৯০ শতাংশ বাজার দখল করে আছে।
লিনাক্স ভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম উবুন্টু ২০১৩ সালে কাইলিনের নিজস্ব প্রথম সংস্করণ বের করে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে কাইলিনের ওপেন-সোর্স সংস্করণ ওপেন কাইলিন রিলিজ করা হয়। এখন এটিরই নতুন সংস্করণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে চীন সরকার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।