আবুল বাশার মিরাজ : নেত্রকোনার পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী নিয়ে আছে চমত্কার এক লোককথা। কিংবদন্তিপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ তাঁর স্মৃতিকথা ‘জীবন সংগ্রাম’-এ তার সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়, সেই ১২০৮ সালে বর্তমান নেত্রকোনার সীমান্ত এলাকায় খরস্রোতা এক নদীর তীরে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন একদল তীর্থযাত্রী সাধু। স্থানীয় গরিব মত্স্যজীবীরা গিয়ে পাহাড়িদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাঁদের সহায়তা চান।
তখন দলের প্রধান সাধু তাঁর যুবক সহচর সোমনাথ পাঠককে সেখানে থেকে গিয়ে জেলেদের সাহায্য করার নির্দেশ দেন। তখনো সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ না করা তরুণ ব্রাহ্মণ সোমনাথ পাঠক তা-ই করেন। সেই সোমনাথ পাঠকের নামেই কালক্রমে নদীটির নাম হয় সোমেশ্বরী। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছাড়াও এই নদীটির আছে আরেক বিশেষ পরিচিতি।
স্থানীয় লোকজনসহ অনেকেই বলে, দেশের মধ্যে শুধু সীমান্তবর্তী সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীতেই মেলে মহাশোল মাছ।
মণি সিংহ লিখেছেন, মহাশোলের আকৃতি রুই ও মৃগেল মাছের মাঝামাঝি। আঁষ টাকার মুদ্রার মতো গোল ও বড়। এই মাছ দেখতে যেমন সুদৃশ্য, খেতে তেমনই সুস্বাদু। তবে মহাশোল কেন নাম হলো তা জানা যায়নি।
একদা বিখ্যাত এই মহাশোল মাছ এখন প্রকৃতিতে বিলুপ্তপ্রায়। এর স্বাদ জানা নেই সাম্প্রতিক প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষের। সোমেশ্বরী বিধৌত সুসং দুর্গাপুরের অভিজাত পরিবারের সন্তান মণি সিংহের জন্ম সেই ১৯০১ সালে। অর্থাত্ মহাশোল মাছ নিয়ে তাঁর স্মৃতি বহু যুগ আগের।
এ সময়ে আবহমান বাংলার প্রকৃতি থেকে আরো বহু প্রজাতির মাছের মতো মহাশোলও হারিয়ে গেছে প্রায়। তবে বিলুপ্তপ্রায় এই মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উত্পাদন এবং চাষ ব্যবস্থাপনার কৌশল উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশের মত্স্য গবেষকরা। বর্তমানে মহাশোলের তিনটি প্রজাতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। এগুলো হলো টর টর, টর পুঁটিটোরা ও টর ব্যারাকি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কার্পজাতীয় অন্যান্য মাছের তুলনায় মহাশোলকে গায়ের রং দেখে সহজেই আলাদা করা যায়। এই মাছের গায়ের রং চকচকে সোনালি। বর্তমানে টর পুঁটিটোরা প্রজাতির মহাশোলের পোনা চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সারা দেশে এর চাষ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মহাশোল মাছ নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্য হলো এই মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে খাবারের পাতে ফিরিয়ে আনা।
বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, মহাশোল বাংলাদেশের বিপন্ন প্রজাতির কার্পজাতীয় মাছগুলোর অন্যতম। এই মাছ জন্মে শুধু নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী ও কংস নদীতে। তবে কয়েক দশক আগেও ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেট ও দিনাজপুরের খরস্রোতা নদী ও খালবিলে এই মাছের প্রাচুর্য ছিল। বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে এ দেশে মাছের প্রাকৃতিক বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র ক্রমে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অন্য অনেক মাছের মতোই প্রাকৃতিক জলাশয়ে মহাশোলের প্রাপ্যতাও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়ে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। কার্পজাতীয় অন্যান্য মাছের তুলনায় এর অত্যন্ত কম ডিম ধারণক্ষমতাকে হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। বিলুপ্তির মুখে থাকায় আশির দশকে নেপাল থেকে এই মাছের পোনা আমদানি করা হয়। পরে পুকুরে পোনা ছেড়ে জিনপুল সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিএফআরআই থেকে এই মাছের ব্যাপক পোনা উত্পাদনসহ চাষের কৌশল উদ্ভাবন করা হয়।
ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, মহাশোল মাছটি কার্পজাতীয় অন্য মাছগুলোর চেয়ে আকারে তুলনামূলকভাবে বড় হয়। সাধারণত লম্বায় সর্বোচ্চ ৫২ সেন্টিমিটার এবং আকারে আট থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। মাছটির বৃদ্ধি অন্যান্য মাছের তুলনায় কিছুটা কম। চাষের সময়ে রোগবালাই কম হয় বলে এই মাছ চাষে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। মহাশোল প্রচলিত খাবারে অভ্যস্ত। এ কারণে অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের সঙ্গে সহজেই এর চাষ করা সম্ভব।
বিএফআরআই মহাপরিচালক ড. মো. জুলফিকার আলী জানিয়েছেন, বর্তমানে মহাশোল মাছের একটি প্রজাতির পোনা চাষিদের বিতরণ করার পাশাপাশি বাকি দুটির কৃত্রিম প্রজননের গবেষণার কাজ চলমান। সূত্র : কালের কন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।