স্পোর্টস ডেস্ক : প্রশ্ন: সভাপতি হয়েই কি ফিরতে চেয়েছিলেন?
তাবিথ আউয়াল : আসলে ভাগ্য বলতে পারেন। একদম চার বছর আগে নির্বাচনে হেরে যাই। সে ব্যাপারে অভিযোগ ছিল এবং আছে। সেটা আসলে মুখ্য বিষয় নয়।
তবে সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে নিশ্চিত ফিরে আসব। কিন্তু পরেরবার আমি সভাপতি হয়ে ফিরব। এর দুটি কারণ ছিল; একটি ছিল, বাফুফে নির্বাচনে দুইবার সহসভাপতি হয়েছি।
যদি জিততাম তিনবার হতো।
অভিজ্ঞতা ছিল আমার যথেষ্ট। কিন্তু যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে কাজ করতে পারিনি। তাই ভেবেছিলাম, পরেরবার সভাপতি হয়ে না এলে সেই কাজগুলো করতে পারব না। শেষের দিকে এসে একরকম জেদ কাজ করেছে।
প্রশ্ন:নতুন এই দায়িত্বে কতটা রোমাঞ্চ, কতটা চাপ বা চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন?
তাবিথ আউয়াল : রোমাঞ্চ আছে, আবেগও কাজ করছে। মনে হচ্ছে, নিজের ঘরে অনেক দিন পর ফিরে যাচ্ছি। সেই জায়গা থেকে তো রোমাঞ্চ আছে, আবেগও আছে। ইতিবাচকভাবে ভয়ও কাজ করছে।
সোজা সময়টা বা চাপের সময়টা পার করে এসেছি, মানে মানে নির্বাচনের সময়টা। নির্বাচনের পর তো দায়িত্ব শুরু। যাঁরা আমাকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁরা তো আমার ওপর প্রত্যাশা রাখছেন। আমি যেন ফুটবলকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। এখন সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে আমাকে।
প্রশ্ন: ফুটবলের নেতৃত্ব দেবেন আপনি, নেতা হিসেবে আপনার দর্শনটা কেমন?
তাবিথ আউয়াল : একটি প্রবাদ আছে, যদি জোরে যেতে চাই তাহলে একা যাওয়া ভালো, আর যদি দূরে যেতে চাই তাহলে সবাইকে নিয়ে যাওয়া ভালো। আমি চেষ্টা করব সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ যাত্রা করতে। আমার পর তো আরেকজন আসবেন। ওই ব্যক্তি যেন সেখান থেকে ফুটবলটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। আমরা চাই ফুটবলকে আরো উঁচুতে তুলে ধরতে। এখানে ২১১টি দেশ খেলে খেলে। এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের র্যাংকিংয়ে এগোতে হবে। এরপর ধরুন, ছেলেদের সাফ জেতা। এই প্রত্যাশাগুলো তো আছে। তা আমাদের পূরণ করার সময় এসে গেছে।
প্রশ্ন: কাজী সালাহউদ্দিন ছিলেন সুপারস্টার। তাঁর কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। আপনি তরুণ, আধুনিক। আপনার কাছে তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, সেটা কি অনুভব করছেন?
তাবিথ আউয়াল : ফুটবলবিশ্ব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এখনকার ফুটবল প্রযুক্তিনির্ভর। ইউরোপের মতো ম্যাচ ভিডিও অ্যানালাইজিং, ম্যাচের সময়ের বিভিন্ন ডাটা সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া—এসব জায়গায় আমি মনে করি, আমি প্রস্তুত আছি এবং আমার অভিজ্ঞতা আছে যথেষ্ট। আজকের দিনে ফুটবল যেখানে চলার কথা সেখানে চালাতে আমি প্রস্তুত আছি। ফুটবলে এশিয়া এখন যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। এশিয়ার ফুটবল এখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশকেও এশিয়ার পর্যায়ে লড়াই করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি জানেন যে, দেশের ফুটবল কোথা থেকে কোথায় এসেছে। জনপ্রিয়তা কমেছে, র্যাংকিং নেমেছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কী পরিকল্পনা নেবেন?
তাবিথ আউয়াল : আমি এখনো মনে করি না যে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কমেছে। আমার কাছে মনে হয়, কিছু কিছু ক্লাব ভালো করতে পারছে না এবং ব্যক্তিগতভাবে কোনো খেলোয়াড় তারকা হয়ে উঠতে পারেননি বলে সেই জনপ্রিয়তা দৃশ্যমান নয়। তবে আপনি যদি সাধারণত দেখেন, অনেক দর্শক বাংলাদেশ থেকে ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়মিত দেখছেন। আমরা যখন সিলেটে এর আগে প্রীতি ম্যাচগুলো খেলেছিলাম, অনেক দর্শক মাঠে এসেছিল। আর বর্তমানে মেয়েদের ফুটবল দেখার জন্য অনেকে নেপালেও চলে গেছে। দর্শকরা ভালো খেলা দেখতে চায় এবং বুঝতে চায় এটা ভালো ম্যাচ ছিল, পাতানো ম্যাচ ছিল না। এই আস্থার জায়গাগুলো তৈরি করতে হবে। দর্শকরা তো দর্শকই, এখন তারা বাসায় বসে থাকবে নাকি মাঠে এসে খেলা দেখবে। দ্বিতীয়ত, দর্শকদের জন্য আমরা কী করেছি? খেলা দেখার পরিবেশ আমরা একদমই রাখিনি। একজন দর্শক যখন খেলা দেখতে চায়, তখন স্টেডিয়াম পর্যন্ত যাতায়াত, স্টেডিয়ামে সব কিছুর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছি না। আমার বিশ্বাস, ফুটবলের পরিবেশ পরিবর্তন করতে হবে। আর তৃতীয়ত, টেকনোলজি। দর্শকরা তো অনলাইনে খেলা দেখতে পারছে না। আপনি যদি ম্যাচ সরাসরি না দেখান, অনলাইনে স্ট্রিমিং না করেন, লাইভের পর রিপ্লে না করেন তাহলে কিভাবে হবে? দর্শকরা তো এসব দেখতে চায়। আশা করি, আমাদের নতুন যে কমিটি, এসব ব্যাপারে প্রচুর সময় দেবে। টিভি ও ডিজিটালে সম্প্রচারের জন্য কাজ করবেন। আমি বিশ্বাস করি, খেলা প্রচার করতে পারলেই দর্শকরা খেলা দেখবে এবং খেলার সঙ্গে যুক্ত হবে।
প্রশ্ন: ক্লাব ফুটবলের অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বললেন, কিন্তু আমাদের ঘরোয়া ফুটবলে তো তা নেই। ক্লাবগুলোর ক্ষেত্রে বাফুফের কি করণীয় থাকবে?
তাবিথ আউয়াল : প্রথমে ক্লাবগুলোকে প্রচুর সমর্থন দিতে হবে, সেটা আর্থিক দিক নয়। ক্লাবগুলো খেলোয়াড় তৈরি করে। যখন তারা সেই খেলোয়াড়কে ট্রান্সফার করে কিন্তু প্রত্যাশামাফিক অর্থ পায় না, তখন পরবর্তী খেলোয়াড় তৈরিতে নিরাশ হয়। এর চেয়ে বরং তৈরি খেলোয়াড় কেনে এবং খেলায়। আমরা বাফুফে থেকে যেটা করব, নতুন খেলোয়াড় তৈরি করলে তাঁকে যেন বিক্রি করে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয় সেটা ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত হলো, ক্লাবগুলোর মার্চেন্ডাইজিং ঠিক করা। এখন যদি কোনো ক্লাবের জার্সি কিনতে যান, কোনটা আসল কোনটা নকল বুঝতে পারবেন না। তাই আমরা ক্লাবগুলো আইনের কাঠামোর ভিত্তিরে এই মার্চেন্ডাইজিংয়ের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া টিকিটের মাধ্যমেও ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস বের করার কাজ করতে হবে। ফুটবল যতক্ষণ না ব্যাবসায়িক মনোভবে না করতে পারব, ততক্ষণে উন্নতি করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: বাফুফেকেও তো আয়ের উৎস নিয়ে ভাবতে হবে?
তাবিথ আউয়াল : আমার মতে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, আস্থা অর্জন করা। দিন শেষে ফুটবল একটা পণ্য। একটা বিনোদনের জায়গা, আরেকটা ব্যক্তিগত জায়গা। আমরা যদি আবেগ, গর্ব এবং আস্থা এক করতে পারি, তাহলে ফান্ড এমনিতেই চলে আসবে। কারণ, ভালো খেললে স্পন্সররা এমনিই চলে আসেন।
প্রশ্ন: ২০২২ সালে মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসার পরই অলিম্পিকে বাছাইয়ে খেলতে পারল না টাকার অভাবে। এসব তো আপনাকে পরিবর্তন করতে হবে…।
তাবিথ আউয়াল : আমরা যেটা বললাম, অতীতে কী হয়েছে সেটা দেখছি না। সামনে কী করব, সেসব নিয়ে ভাবছি। আমাদের মেয়েরা ও ছেলেরা যদি মাঠে ভালো পারফরম্যান্স দিতে পারে, তাহলে এই সুনামের সঙ্গে ব্র্যান্ডিং এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু দুটোই বাড়বে। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, আদায় করে নেওয়া। যেটার দায়িত্ব পরে আমার ওপর। সরকার থেকে আদায় করি, ফিফা থেকে আদায় করি নাকি কোনো স্পন্সর থেকে আদায় করি; সেটা আমার ব্যাপার। আদায় করতেও স্কিল লাগে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের কমিটির বেশির ভাগেরই সেই স্কিল আছে, মানে টাকা জোগান দেওয়ার। আমরা অনুভব করছি, আমরা যদি কাজ করি তাহলে আর্থিক অভাবও দূর হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: সভাপতি হয়েই এএফসির প্রগ্রামে দক্ষিণ কোরিয়া গেলেন। কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
তাবিথ আউয়াল : সেখানে অভিজ্ঞতা হলো, অন্যান্য দেশ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কোন কোন জায়গায় এগোতে পারছি না, সেটা উপলব্ধি করা। এখানে লজ্জার কিছু নেই। আমাদের চেয়ে ভুটানও পারফরম্যান্সে অনেক এগিয়ে। নেপাল গ্রাসরুট পুরস্কার পেল। তারা বিভিন্ন মাঠ আদায় করে নিচ্ছে, ফান্ড আদায় করছে। ওই জায়গা থেকে আমি দেখছি, আমাদের কী করণীয়। তাদের চেয়ে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে রিসোর্স বেশি আছে। আমরা সেগুলো ব্যবহার করতে পারিনি। আগামী দিনগুলোতে আশা করি, এসব যথাযথ কাজে লাগাতে পারব।
প্রশ্ন: গত বছর বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আর্থিক অনিয়মে ফিফা থেকে নিষেধাজ্ঞা পান। বিশ্বমঞ্চে আমাদের জন্য এটা কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং এই জায়গা থেকে আমাদের বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখেন কি না?
তাবিথ আউয়াল : দেখুন, অনেক সময় আমরা দু-একটা অপ্রিয় ঘটনায় নিজেদের আটকে রাখি। ফুটবল বিশ্বে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হচ্ছে এখন সাফজয়ী নারী দল। বিশেষ করে, তারা যেসব জায়গা থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের পতাকা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে, সেটাই বিদেশে আমাদের সুনাম, এটাই আমাদের পরিচিতি ছড়িয়েছে। এই মেয়েদের জন্য এখন ইউরোপে খেলার প্রস্তাব আসছে। এগুলোই আমাদের ইতিবাচক জায়গা।
প্রশ্ন: জেলার ফুটবলকে সচল করা নিয়ে কী পরিকল্পনা?
তাবিথ আউয়াল : জেলায় খেলা হতেই হবে। শুধু লিগ নয়, অনূর্ধ্ব ১৫ ও অনূধ্ব-১৭ পর্যায়ে দুটি টুর্নামেন্ট করার ব্যাপারেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা জেলাগুলোকে উৎসাহ দেব এবং প্রয়োজনে কঠোর হব। কিন্তু জেলাতে ফুটবল হতে হবে।
প্রশ্ন: চার বছর শেষে ফুটবলটাকে কোথায় দেখতে চান?
তাবিথ আউয়াল : এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা একটু কঠিন। তার পরও বলি ধরুন র্যাংকিংটাকে, এটাকে আমাদের একটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। খেলার মানের ধারাবাহিকতা চাই। হার জিত থাকবে। বাংলাদেশ যখন খেলবে দর্শকদের জানা উচিত বাংলাদেশ কোন মানে খেলবে। সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। তা ছাড়া কিছু টেকনিক্যাল ইস্যুতে আমি হাত দেব। যেমন ধরেন, শেষ ১০ মিনিটে গোল খাওয়া। এর সঙ্গে খেলোয়াড়দের ফিটনেস জড়িত, টেম্পারমেন্ট জড়িত থাকে। এ রকম জায়গাগুলোতে আমি চেষ্টা করব কোনো ঘাটতি যেন না থাকে। তা ছাড়া খেলা হলে দর্শক থাকবে স্টেডিয়ামে, সেটাই প্রত্যাশা। খেলা হলে মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া রাইটস থাকবে, সেখান থেকে আয়ের সুযোগ থাকবে। এই জায়গাগুলো করে দিয়ে যেতে চাই।
প্রশ্ন: সাফজয়ী মেয়েরা অনেক চাহিদার কথা জানিয়েছেন, সে ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
তাবিথ আউয়াল : আমি এসব নিয়ে ওদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। আমাদের নারী দল নিজেরাই তাদের একটা জায়গা করে নিয়েছে। তাদের ওরকম সুযোগ-সুবিধা কিন্তু কেউ দেয়নি। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে আমাদের এই মেয়েরা দেশের জন্য সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে। শুধু তা-ই না, ফুটবলের মাধ্যমে তারা একটা সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মাঠ ও মাঠের বাইরে তারা অনেক কিছু জয় করেছে। সেটার পর্যাপ্ত সম্মান তাদের পেতেই হবে। এটা বাফুফে থেকেও তাদের পেতে হবে, রাষ্ট্র থেকেও তাদের পেতে হবে। বাফুফে থেকে তাদের জন্য কিছু করাটা যেমন আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তেমনি রাষ্ট্র থেকে কিছু আদায় করে দেওয়াটাও আমাদের কমিটির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে জায়গাগুলোতে আমরা সোচ্চার থাকব। আর আমরা এমন দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম দেখাতে চাই, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উৎসাহ পায়, সেটা ছেলেরা যেমন পাবে তেমনি মেয়েরাও যেন পায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।