আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফ্রান্সের রক্ষণশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো অভিবাসন সংক্রান্ত নতুন একটি সার্কুলার জারি করেছেন। নতুন সার্কুলারে বিশেষ বিবেচনায় বৈধতার ক্ষেত্রে বসবাসের শর্ত ও ফরাসি ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার শর্ত যোগ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের সবগুলো প্রশাসনিক দপ্তর তথা প্রিফেকচুরগুলোর কাছে সার্কুলারটি ইস্যু করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো। পরবর্তীতে শুক্রবার বিকেলে গণমাধ্যমের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি ব্যাখ্যা করেন রক্ষণশীল এলআর দলের এই নেতা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অভিবাসন নীতি কঠোর করতে চাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।
ফ্রান্সে অনিয়মিত অভিবাসীদের নিয়মিতকরণের অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে সার্কুলার ভালস। ২০১২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস এই পদ্ধতি চালু করেছিলেন। নতুন ফরাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রোতাইয়ো নতুন সার্কুলার জারি করে আগের সারকুলারটি বাতিল করে দিলেন।
সার্কুলার ভালস মূলত কোন আইন নয়। এটি একটি আইনি নির্দেশনা; যার মাধ্যমে ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে বৈধতার (এইএস) আওতায় অনিয়মিত থেকে নিয়মিত হতেন অভিবাসীরা।
নতুন ও পুরোনো উভয় ক্ষেত্রেই অভিবাসীদের জন্য সার্কুলারগুলো সুবিধাজনক নয়। কারণ এটির মাধ্যমে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলে প্রিফেকচুর বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে ৩৫ হাজার অনিয়মিত অভিবাসী চাকরি, পরিবারসহ বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে সার্কুলার ভালস অনুসারে বৈধতা পেয়েছেন, যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় স্থিতিশীল সংখ্যা।
• যা আছে নতুন সার্কুলারে
শুক্রবার বৃহত্তর প্যারিস অঞ্চলের ভার্সাই প্রিফেকচুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রুনো রোতাইয়ো বলেন, প্রিফেকচুরগুলোর প্রধানদের বিবেচনার ভিত্তিতে অভিবাসীরা নিয়মিত হবেন। এটির আওতায় বৈধতা স্বয়ংক্রিয় অধিকার নয়। এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে নিয়মিতকরণ আগের মতোই ‘ব্যতিক্রমী’ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ফ্রান্সে চার লাখ ৫০ হাজার অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মধ্যে তিন লাখ ৩৪ হাজার ৭৩৪ জন বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে এইএস প্রক্রিয়ায় নিয়মিত হয়েছেন। যা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের মোট সংখ্যার মাত্র ৮ ভাগেরও কম।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী স্তেফান মজন্দ বলেন, অনেকেই প্রচার করেন সার্কুলার ভালসের আওতায় প্রিফেকচুরগুলো অভিবাসীদের সামগ্রিকভাবে বৈধতা প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে এই সার্কুলার প্রিফেকচুরগুলো খুব কমই প্রয়োগ করে থাকে।
এই আইনজীবী আরও বলেন, সার্কুলার একটি সাধারণ চিঠি; যা প্রিফেকচুরগুলো চাইলে অনুসরণ বা উপেক্ষা করতে পারে। এক কথায় প্রিফেকচুরগুলো এটি প্রয়োগ করতে বাধ্য নয়।
ব্রুনো রোতাইয়ো জোর দিয়ে বলেন, এই সার্কুলারটি কেবল প্রিফেকচুরের প্রধানদের নির্দেশনা এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। তবে নতুন সার্কুলারটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনথিভুক্ত অভিবাসীদের রেসিডেন্স পারমিট পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। নতুন নথিটি তিন পৃষ্ঠার। আগের সার্কুলারটি ছিল ১২ পৃষ্ঠার।
এটিতে ২০১২ সালের রোডম্যাপের পরিবর্তে কয়েকটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ২০২৪ সালের ফরাসি অভিবাসন আইনে নির্ধারিত শর্তাবলীর ওপর নির্ভর করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্কুলারটি বৈধতা প্রক্রিয়াকে অস্পষ্টতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই নতুন সার্কুলারকে সুনির্দিষ্ট বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে তা নয়।
অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদের কর্মকর্তা অরোর ক্রিজুয়া বলেন, আমরা আসলে বুঝতে পারছি না যে অনিয়মিত পরিস্থিতিতে থাকা ব্যক্তিদের নিয়মিতকরণ আবেদনের জন্য কোন মানদণ্ডগুলো অনুমোদিত হবে। তাদের মতে, রোতাইয়ো সার্কুলার এবং সার্কুলার ভালসের মধ্যে পার্থক্য মূলত শব্দ চয়নের পরিবর্তনের মধ্যে নিহিত।
২০১২ সালের নথিতে উদ্দেশ্য ছিল ‘একটি স্পষ্ট’ এবং সুষম অভিবাসন নীতির প্রচার করা। অপরদিকে, নতুন সার্কুলারে ‘অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবেলা করে অভিবাসন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ’ করাকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্রুনো রোতাইয়ো বলেছেন, আমাদের সমাজে বিদেশিদের ইন্টিগ্রেশন বা একীভূত করার স্তরটি আরও জোরদার করতে হবে।
• শ্রমিক সংকটে থাকা খাতে গুরুত্ব
নতুন সার্কুলারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিফেকচুরগুলোকে অনুরোধ করেছেন, তারা যেন ‘মেতিয়ের অঁ তনসিওঁ’ বা গুরুতর শ্রমিক সংকটে থাকা খাতগুলোতে কর্মরত অভিবাসীদের বৈধতার দিকে গুরুত্ব প্রদান করে।
সংশোধিত তালিকা আগামী মাসে প্রকাশিত হবে বলে কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০২৪ সালের অভিবাসন আইন অনুসারে, এই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের এক বছর মেয়াদি রেসিডেন্স পারমিট দিতে দিতে প্রিফেকচুরগুলোকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এই পদ্ধতিতে রেসিডেন্স পারমিট পেতে একজন ব্যক্তিকে ন্যূনতম তিন বছর ফ্রান্সে নিরবচ্ছিন্ন বসবাস করতে হবে এবং সবশেষ দুই বছরের মধ্যে অন্তত ১২ মাস শ্রমিক ঘাটতিতে থাকা নির্দিষ্ট এলাকায় এবং সেক্টরে কাজে নিযুক্ত থাকতে হবে।
পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের ফ্রান্সে কোনও অপরাধের সাথে যুক্ত থাকা যাবে না। এটির স্বপক্ষে ফরাসি প্রশাসন থেকে পুলিশে ক্লিয়ারেন্স বা সত্যতা প্রতিপাদন জমা দিতে হবে। এছাড়া ওই ব্যক্তির ফরাসি মূল্যবোধের সাথে একাত্মতা ও সমাজে ইন্টিগ্রেশন চেষ্টাকেও আমলে নিবে প্রিফেকচুরগুলো।
তবে পূর্বের মতো অনিয়মিত অভিবাসীদের বৈধতা পেতে তাদের নিয়োগকর্তাদের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। শর্ত পূরণ করলে নিজেরাই আবেদন করতে পারবেন। বৈধতার এই সুযোগ প্রাথমিকভাবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ মাস চাকরির শর্তে স্টুডেন্ট জব ও সিজনাল কাজের চুক্তিকেও আমলে নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব শর্তের পাশাপাশি প্রিফেকচুরগুলোকে আরও কিছু উপাদান বিবেচনা করতে হবে। যেমন সামাজিক ও পারিবারিক ইন্টিগ্রেশন বা একীকরণ, জনশৃঙ্খলা ও প্রজাতন্ত্রের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি।
আইনি কাঠামো হওয়া সত্ত্বেও সার্কুলারের মতো এখানেও প্রেফেকচুরগুলো নিজ বিবেচনায় ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনও যুক্তি ছাড়াই কোনও আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন।
• পারিবারিক আওতায় বৈধতা কমানো
নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, ব্রুনো রোতাইয়ো প্রিফেকচুরগুলোকে আবেদন যাচাইয়ে আরও কঠোর পদ্ধতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। নথিতে নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে ফ্রান্সে কমপক্ষে সাত বছরের উপস্থিতির শর্ত আরোপ করা হয়েছে। পূর্বে যেটি ক্ষেত্রে বিশেষে তিন বা পাঁচ বছরের আওতায় আবেদন করা যেত।
আইনজীবী স্তেফান মজন্দ ব্যাখ্যা করেন, খুব স্পষ্টতই সাত বছরের কম সময়ে ফ্রান্সে থাকা সকলের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া পূর্বের সার্কুলার ভালস, অনুসারে অনিয়মিত বিদেশিরা বিভিন্ন শর্ত পূরণ করে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ক্যাটাগরিতে নবায়নযোগ্য এক বছরের রেসিডেন্স পারমিট পেতেন। নতুন নথিতেও এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ না থাকলেও এটি বহাল থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
যেসব অনিয়মিত অভিবাসীদের সন্তান কমপক্ষে তিন বছর ধরে স্কুলে পড়েন তারা, বৈধ বিদেশিদের অনিয়মিত স্বামী-স্ত্রী, কিশোর থেকে কমপক্ষে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ফ্রান্সে পড়াশোনা করে ১৮ বছরে পূর্ণ হওয়া তরুণরা পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে বৈধতা পান।
এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা এবং মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা ‘মানবিক’ ক্যাটাগরিতে বৈধতা পেয়ে থাকেন। এসব খাতে আগের নিয়ম বলবৎ থাকবে।
কিন্তু ব্রুনো রোতাইয়ো নির্দেশনা দিয়েছেন, পারিবারিক কারণে বৈধতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী এইএস ব্যবস্থার বদলে আইনি পথকে যেন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
অর্থাৎ ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ক্যাটেগরিতে নিয়মিতকরণের সংখ্যা হ্রাস করতে বলেছেন ব্রুনো রোতাইয়ো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে অনিয়মিত পরিস্থিতিতে থাকা ১১ হাজার ৫২৫ জন ব্যক্তি কাজের মাধ্যমে এবং ২২ হাজার ১৬৭ জন পারিবারিক ক্যাটেগরিতে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। যা এইএস ক্যাটেগরিতে নিয়মিতকরণের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ।
একটি প্রিফেকচুরের প্রধান ফরাসি দৈনিক লো ফিগারোকে বলেছেন, নতুন সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আওতায় আট থেকে ১০ হাজার ব্যক্তি কম নিয়মিত হবেন।
• ইন্টিগ্রেশনের শর্ত
রোতাইয়ো সার্কুলারে বিশেষ বিবেচনায় বৈধতা বা এইএসের ক্ষেত্রে সকল আবেদনকারীদের ফরাসি সমাজে ইন্টিগ্রেশন বা একীভূতকরণের ওপর জোরদার করতে কয়েকটি শর্তের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে…
• বৈধতা পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের ফরাসি প্রজাতন্ত্রের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করার বাধ্যবাধকতা, পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মত বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
• ফরাসি ভাষার দক্ষতার প্রমাণ দেওয়া। ফরাসি ভাষার ডিপ্লোমা অথবা ভাষা সনদের মাধ্যমে এটি প্রমাণ করা যাবে। যেখানে পূর্বের সার্কুলার ভালসে শুধুমাত্র ফরাসি ভাষার প্রাথমিক মৌখিক দক্ষতার কথা বলা হয়েছিল।
• কিন্তু এই সার্কুলারে বৈধতার ক্ষেত্রে ঠিক কোন মানের ভাষা দক্ষতা দেখাতে হবে সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। অর্থাৎ এ১, এ২, বি১ বা বি২ কোন ধরণের সনদ লাগবে সেটি বলা হয়নি।
• বৈধতার আবেদনকারী ব্যক্তি জনশৃঙ্খলার জন্য কোন হুমকি সৃষ্টি করবে না। এটি অবশ্য পূর্ববর্তী সার্কুলারেও উল্লেখ ছিল।
• যদি কোনও অনিয়মিত অভিবাসীর বিরুদ্ধে ফরাসি অঞ্চল ত্যাগের ওকিউটিএফ নোটিশ থাকে সেক্ষত্রে তার আবেদন প্রেফেকচুর প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন।
নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোন আবেদনকারীর নিয়মিতকরণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হলে সংশ্লিষ্ট অনথিভুক্ত বিদেশিকে স্বয়ংক্রিয়ভাব ওকিউটিএফ নোটিশ ইস্যু করা হবে। ইনফোমাইগ্র্যান্টস।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।