জুমবাংলা ডেস্ক : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে এক পাইলটের আবেদনে তথ্য জালিয়াতি ধরা পড়েছে। বোয়িং সেভেন থ্রি সেভেনের পাইলট হিসেবে আবেদন করলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) মাধ্যমে তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় ধরা পড়ে একের পর এক অনিয়ম ও জালিয়াতি। তিনি ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ। ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে তার জালিয়াতির কথা।
২০০১ সালে কমার্শিয়াল পাইলট হিসেবে কাজ শুরু করেন ক্যাপ্টেন নুরুদ্দীন আহমেদ আল মাসুদ। জিএমজি ও ইউনাইটেড এয়ারলাইনসে উড়োজাহাজ চালনার পাশাপাশি ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে ফ্লাইট অপারেশনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০২২ সালে প্রথম মাসুদের লগবুকে অনিয়ম ও উড্ডয়ন তথ্যের গরমিল পাওয়া যায়। ২০২৩ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সেভেন থ্রি সেভেনের পাইলট হিসেবে আবেদন করলে বেবিচকের তথ্য যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় ধরা পড়ে এ জালিয়াতি।
এ বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি আমরা অবহিত। বিস্তারিত তদন্তকাজ করছে ফ্লাইট সেফটি ও রেগুলেশনস্ বিভাগ। এরপর প্রমাণিত হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের তদন্তে ক্যাপ্টেন মাসুদের তিনটি সার্টিফিকেটে তিন ধরনের উড্ডয়ন তথ্য পাওয়া গেছে। ২০০১ সালের ২০ মার্চ স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেটে ৫ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট উড্ডয়নের তথ্য রয়েছে। আরেকটিতে ২৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট এবং অপরটিতে অক্টোবর পর্যন্ত ৩৪৬ ঘণ্টার তথ্য রয়েছে। মাসুদের লগ শিটেও ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি। এতে দেখা যায়, ৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল উড্ডয়ন ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট। ২৭ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল মাত্র ৯ দিনে বাকি ১১৮ ঘণ্টা উড্ডয়ন করেন তিনি।
মাসুদের নথিপত্র পর্যালোচনা করে ফ্লাইট সেফটি ও রেগুলেশনস্ পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুকিত উল আলম মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন করে বেবিচক। বেবিচকের এই তদন্ত কমিটি ৩৪৬ ঘণ্টা উড্ডয়নের তথ্যকে গ্রহণ করে ছাড়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করে। অথচ এপ্রিলের পর ক্যাপ্টেন মাসুদের পাসপোর্টে ফিলিপাইনে প্রবেশের কোনো তথ্য নেই। এরপর সত্যতা যাচাইয়ে বেবিচকের তৎকালীন চেয়ারম্যান চিঠি পাঠান ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশনকে। ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ পাল্টা জবাবে নথিপত্রের অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত করে মাসুদের দাবির অসত্যতা তুলে ধরে।
এদিকে ২০০৩ সালের ২২ ও ২৩ আগস্ট দুই দিনের তথ্যেও রয়েছে বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতি। ক্যাপ্টেন মাসুদের
ওই সময়ের লগবুকে ২২ আগস্ট উড্ডয়ন সময় ৪১৬ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট, আবার একদিন পরই উড্ডয়ন সময় ৫৪৭ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট উল্লেখ রয়েছে। ওই লগবুকের কয়েক পাতা পর চোখে পড়বে এপ্রিল মাসের তথ্য। অথচ একই বছরের হিসাবে আগস্টের পর এপ্রিলের তথ্য থাকা সম্ভব নয়।
এ ছাড়া মাসুদের বিরুদ্ধে রয়েছে বৈধ লাইসেন্স ছাড়া ফ্লাইট পরিচালনার অভিযোগও। সিভিল এভিয়েশনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইআর (ইনস্ট্রুমেন্ট রেটিং) নবায়ন করেছেন ২০২০ সালে। বৈধ মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনারও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন মাসুদের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি তার মুঠোফোনে নম্বর ব্লক করে দেন। অভিযোগের বিষয় লিখে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ (সিএএ) জানিয়েছে, ৯ দিনে ১১৮ ঘণ্টা ফ্লাইট প্রশিক্ষণ জমা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবেদনে তিনি ফ্লাইং স্কুলে ‘এভারেজ’ উল্লেখ করেছেন। অথচ একজন ছাত্র পাইলট প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা উড়ে যান। ২১ দিনের সময়ের মধ্যে তার ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট জমা করার বিষয়েও সন্দেহ করেছে ফিলিপাইন সিএএ। সংস্থাটি বেবিচককে জানিয়েছে, ক্যাপ্টেন মাসুদের বক্তব্যে বেশকিছু অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। ফ্লাইং রেকর্ড এবং লগবুকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন মাসুদ ফিলিপাইনে যাওয়ার আগে এয়ারপারাবত থেকে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সমস্ত ফ্লাইং ট্রেনিং পেয়েছিলেন। তবে তিনি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৯৯৯ সালে বিএফএ এবং জিএতে ভর্তি হন। ক্যাপ্টেন মাসুদ ফিলিপাইনে তার মেডিক্যাল সার্টিফিকেশনের তারিখ জানিয়েছেন ২০০১ সালের ৫ মার্চ।
বাস্তবে দেখা যায়, ক্যাপ্টেন মাসুদের ফিলিপাইনের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ২০০১ সালের ২০ মার্চ জারি করা হয়েছিল এবং আগের দিন অর্থাৎ ২০০১ সালের ১৯ মার্চ মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয়েছিল। এ জন্য তার বিবৃতি, লগবুক, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য রেকর্ডে আবিষ্কৃৃত সাইনের অসঙ্গতি উল্লেখ করেছেন ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশনের ডিজি। তিনি উল্লেখ করেছেন এই সার্টিফিকেট তাদের রেকর্ডে নেই এবং যদি প্রশিক্ষণ শেষ করার আগে একটি সার্টিফিকেট জারি করা হয়, তবে সার্টিফিকেটের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তাতে স্পষ্ট ভুয়া সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে মাসুদের বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স জারি করা হয়েছে। ক্যাপ্টেন মাসুদের ফিলিপাইনের পিপিএল (প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স) বৈধতা ২০০১ সালের ২৭ মার্চ জারি করা হয়েছিল এবং এটি ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বৈধ ছিল। ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ফিলিপাইন সিভিল এভিয়েশনের উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের অনুমতি পেয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন মাসুদের ফ্লাইং সার্টিফিকেট ফিলিপাইনের সিভিল এভিয়েশনের মাধ্যমে প্রমাণিত যে ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট জমা করেছিলেন। তার (ক্যাপ্টেন মাসুদ) ফিলিপাইনের লগবুক পেজ অনুসারে, তার শেষ ফ্লাইং ডেট রেকর্ড করা হয়েছে। সেটা ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ছিল এবং মোট সময় ১৯৩ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট রেকর্ড করা হয়েছিল এবং ওই বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট সময় ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট ছিল। তার মানে তিনি ১১৮ ঘণ্টা ১৮ মিনিট উড়তে মাত্র ৯ দিন পেয়েছেন।
ফিলিপাইনের সিএএর ডিজি তার ইমেইল রিপের্টে মাসুদ ৯ দিনে ১১৮ ঘণ্টা জমা হওয়ার বিষয় নিয়ে স্পষ্টভাবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, একজন ছাত্র পাইলটের জন্য প্রতিদিন ফ্লাইং স্কুলের গড় ফ্লাইং সময় সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা। ফিলিপাইন সিএএ ২১ দিনের সময়ের মধ্যে মাসুদের উড্ডয়ন সময় ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট জমা করার বিষয়টি সন্দেহজনক। ক্যাপ্টেন মাসুদের মেডিক্যাল পরীক্ষা ২০০১ সালের ১৯ মার্চ করা হয়েছিল এবং পরদিন ২০ মার্চ মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জারি করা হয়েছিল। সুতরাং প্রার্থী মেডিক্যাল পরীক্ষার আগে উড়ান শুরু করতে পারেন না। অতএব ২০০১ সালের ২০ মার্চের আগে ক্যাপ্টেন মাসুদের উড্ডয়নের দাবি করা সার্টিফিকেট প্রশ্নবিদ্ধ। সূত্র : আমাদের সময়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।