সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জের সিংগাইরে এক গৃহবধুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার পর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নিতেও পুলিশ গড়িমসি করেছিল বলে জানায় ভুক্তভোগী ওই গৃহবধু। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর মামলা হলেও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় আসামিদের হুমকিতে বাড়ি ছাড়া ওই গৃহবধু ও তার পরিবার।
ধর্ষণের শিকার ওই গৃহবধুর পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলার সিংগাইর উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের বাসিন্দা ওই গৃহবধুর পরিবারের লোকজন গত ২৫ জুলাই বিকেলে নিজ গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যায়। পরিবারের লোকজন আত্মীয় বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি হওয়ায় তারা আসছে কি’না দেখার জন্য সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে রাস্তায় বের হওয়ার পর আসামি হযরত মোল্লা, শরিফ ও রমিজ ওই গৃহবধুকে গামছা দিয়ে মুখ বেধে পাশের কলাবাগানে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। কলাবাগানে নিয়ে ওই গৃবধুকে বিবস্ত্র করে প্রথমে হযরত মোল্লা, এরপর শরিফ এবং সবশেষ রমিজ ধর্ষণ করে। এসময় আরো সাতজন অজ্ঞাত ব্যক্তি পাহারায় থেকে তাদের সহযোগিতা করে। এরপর ওই গৃহবধুর মা ও মামা বাড়িতে ফিরে তাকে দেখতে না পেয়ে আশপাশে খোঁজাখুজি করেন। খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে বাড়ির পাশে একটি কলাবাগানে টর্চলাইট মেরে দেখতে পান বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে ওই গৃহবধু। এরপর ওই গৃহবধুর মা নিজের কাপড় দিয়ে ঢেকে মেয়েকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরদিন ভোরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর সকালে শান্তিপুর পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ ওই গৃহবধুর মা ও ছোটবোন জামাইকে যেতে বলে। সেখানে সারাদিন বসে থেকেও পুলিশের কোন সহযোগিতা না পেয়ে অবশেষে ওই গৃহবধুকে নিয়ে সন্ধ্যায় সিংগাইর থানায় যান।
ওই গৃহবধুর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিংগাইর থানায় যাওয়ার পর পুলিশ অনেক ব্যস্ততা দেখিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে থানার একটি রুমে নিয়ে তাদের বসানো হয়। এরপর খাবার খাওয়ার সময় হয়েছে বলে পুলিশ আবার বাইরে চলে যায়। এরপর ওই গৃহবধুকে আবার অন্য একটি রুমে নিয়ে পুলিশ বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করে। এসময় ওই গৃহবধুর মা ও ছোট বোন জামাইয়ের মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় পুলিশ। এরপর পুলিশ ওই গৃহবধুকে ধর্ষণ মামলা না করে অন্য একটি মামলা দেয়ার জন্য বলে। এরপর ভুক্তভোগী ওই গৃহবধু ধর্ষণ মামলা গ্রহণের জন্য বারবার অনুরোধ করার পর অভিযোগ গ্রহণ করে পুলিশ। এরপর রাত তিনটার দিকে ওই গৃহবধু আবার অসুস্থ হয়ে গেলে পুলিশ সিএনজি করে হেমায়েতপুরের জামাল ক্লিনিকে নিয়ে যায়। জামাল ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ কয়েকজন আসামিকে বাদ দিয়ে নিজেরাই অভিযোগ সাজিয়ে মামলার বাদি ভুক্তভোগী ওই গৃহবধুর স্বাক্ষর নেন।
ভুক্তভোগী ওই গৃহবধু বলেন, ‘থানায় যাওয়ার পর পুলিশ অনেক ব্যস্ততা দেখিয়ে মামলা নিতে দেরি করে। পুলিশ প্রথমে ধর্ষণ মামলা নিতে চায়নি। পুলিশ আমাকে বলেছে তোমার তো মাত্র একটা বাচ্চা হয়েছে, শুনেছি তুমি শারীরিকভাবে অসুস্থ, তুমি তো যেকোন সময় মারা যেতে পারো। তোমার এই মামলা করা ঠিক হবেনা। তোমার বাচ্চাও তো বড় হচ্ছে, তোমার মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। তোমার এই মামলা করার দরকার নাই, অন্য একটা মামলা দাও। তখন আমি জোর দিয়ে বলি আমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে আমি সেই মামলা করবো। প্রায় চার ঘন্টা পর্যন্ত পুলিশ আমাকে একটা রুমে আটকে রেখেছিল, সেই রুমে কাউকে যেত দেয়নি। তারপর আমি বলি আমার শরীর খারাপ লাগছে। তারপর রাত আড়াইটার দিকে আমি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করি আমরা যাবো কখন? পুলিশ আমাদের জানায় আজকে যাওয়া যাবেনা, এখানেই থাকা লাগবে। তখন আমি জানতে পারি আমার মা-ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নিয়ে গেছে পুলিশ। এরপর পুলিশের কাছে ফোন চাইলেও তারা দেয়নি। পরে জিজ্ঞাসা করি এখানে থাকবো কোথায়। পুলিশ জানায় থানার ভেতরে একটা বেড আছে, সেখানে থাকতে হবে। তখন আমার মা-ভাইকে ভেতরে আসতে দিতে অনুরোধ করি, তখন পুলিশ বলে তারা ভেতরে আসতে পারবেনা। তুমি ভেতরে থাকবা, তারা বাইরে থাকবে। তারপর আমি তাদের পা ধরে কান্না করি, একপর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। চিকিৎসা চলাকালীন ভোরের দিকে তারা আমাকে একটা কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। উনারা উনাদের নিজেদের মত করে মামলা সাজিয়েছে। আমাকে প্রথম ধর্ষণ করেছে হযরত মোল্লা, দ্বিতীয় শরিফ ও তৃতীয় ব্যক্তি রমিজ। পুলিশ মামলায় উল্টাপাল্টা লিখেছে। মামলায় লিখেছে- শরিফ আমাকে ধর্ষণ করেছে আর হযরত মোল্লা ও রমিজ আমার হাত ধরে রেখেছে। মূলত হযরত মোল্লা আমাকে প্রথম ধর্ষণ করেছে, এরপর শরিফ ও রমিজ ধর্ষণ করেছে। ঘটনার তিনদিন পর পুলিশ আমার রিপোর্ট করানোর জন্য মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এছাড়া পুলিশ প্রথমে মামলার কাগজ দিতে চায়নি, পাঁচদিন পার হওয়ার পর বার বার ফোন দেয়ার পর তারা মামলার কপি দিয়েছে। আমার সাথে এমন অন্যায় অত্যাচারের বিচার চাই আমি।’
ওই গৃহবধুর মা বলেন, “ঘটনার পর থেকেই আসামিরা ও তাদের লোকজন আমাদেরকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। হযরত মোল্লার ভাই কালাম মোল্লা আমার ভাইকে হুমকি দিয়ে বলেছে- তোরে কচুকাটা করবো, তোর মেয়েকে নিয়ে যাবো। আমার স্বামীকেও মারার ভয় দেখিয়েছে। তারা সবাই এখন বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে আছে। আমি ন্যায্য বিচার চাই।”
বিষয়টি নিয়ে সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন বলেই ফোন কেটে দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিংগাইর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মানবেন্দ্র বালো বলেন, এখনো কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি, তবে শ্রীঘ্রই গ্রেফতার হয়ে যাবে। মেয়েটি শিক্ষিত। সে দেখে, পড়ে ও বুঝে এজাহার দিয়েছে, সে অনুযায়ী মামলা হয়েছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি আছি, আমি আর কিছু জানিনা।
এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (সিংগাইর সার্কেল) আব্দুল্লাহ আল ইমরান বলেন, থানা কখনো কিছু লিখতে পারেনা, বাদি যেটা অভিযোগ আকারে দেয় সেটাই এফআইআর-এ উঠে। পরবর্তীতে আসামী কমবেশি করার সামর্থ্য ওসিরও নাই, কোন আইনেও এগুলো দেয়া নাই। উনারা হয়তো বুঝতে পারে নাই বা ভূল বুঝেছে। আর মামলা এন্ট্রি না হলে তো ধর্ষণের টেস্ট করানো যায়না, যেদিন মামলা হয়েছে সেদিনই ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যখন কেউ কোন বিষয়ে অভিযোগ করে সেক্ষেত্রে ওসির একটা নিজন্ব আইনি ক্ষমতা আছে। তার তদন্ত করে জানার অধিকার আছে, আসলে সেটি ঠিক কি’না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।