তীব্র দাবদাহে ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তার ধুলো উড়ছে গরম হাওয়ায়। ফ্যানের নিচে বসেও ঘামে ভিজে যাচ্ছে গায়ের জামা। শিশুটি ক্লান্ত, মুখে নেই প্রাণচাঞ্চল্য, খাবারে অরুচি। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল তৃষ্ণায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। এই চিত্র কি অচেনা? গ্রীষ্মের এই নির্মম তাপদাহে শুধু ক্লান্তিই নয়, ডেকে আনে পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোকের মতো ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি। কিন্তু আশার কথা হলো, প্রকৃতি নিজেই আমাদের জন্য রেখেছে সমাধানের ভাণ্ডার। ঠিক সেই জায়গাতেই আলোকপাত করে গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার – শুধু নাম নয়, এটি হয়ে উঠতে পারে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপনের অপরিহার্য অঙ্গ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাইরেও যে প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী ও সুস্বাদু উপায়ে এই দাবদাহ মোকাবিলা করা সম্ভব, চলুন জেনে নিই সেই সহজ উপায়গুলো, যা আপনার শরীরকে ভেতর থেকে শীতল ও সতেজ রাখবে।
Table of Contents
গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার: প্রাকৃতিক সমাধানের প্রথম ধাপ
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই তাপমাত্রা বাড়লে শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘামের মাধ্যমে তাপ কমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট (লবণ, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি) বেরিয়ে যায়। ফলাফল? ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে খিঁচুনি এবং মারাত্মক ক্ষেত্রে পানিশূন্যতা বা হিটস্ট্রোক। এখানেই গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার-এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই খাবারগুলো শুধু পুষ্টি সরবরাহই করে না, তাদের বিশেষ গুণাবলীর কারণে তারা:
- শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে: কিছু খাবার হজম প্রক্রিয়ায় কম তাপ উৎপন্ন করে (যেমন সহজপাচ্য ফল ও সবজি), আবার কিছু খাবার সরাসরি শীতল প্রভাব ফেলে (যেমন দই, পুদিনা)।
- পানিশূন্যতা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে: তরমুজ, শসা, ডাবের পানির মতো খাবার ও পানীয়তে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ非常高, যা ঘামের মাধ্যমে হারানো তরল পূরণে সাহায্য করে।
- প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে: গরমের স্ট্রেস ও অতিবেগুনি রশ্মি থেকে কোষের ক্ষতি প্রতিরোধে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (লাইকোপিন, বিটা-ক্যারোটিন, ভিটামিন সি) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেক গ্রীষ্মকালীন ফল ও সবজিতে প্রচুর থাকে।
- হজমশক্তি ঠিক রাখে: গরমে হজমশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। হালকা, সহজপাচ্য ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার পেটের গোলমাল এড়াতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভেবে দেখুন – বাজারে সহজলভ্য, সস্তা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল-সবজিই হতে পারে আপনার গরমকালীন স্বাস্থ্য রক্ষার প্রধান হাতিয়ার। মৌসুমী ফল যেমন আম, জাম, লিচু, কাঁঠালের পাশাপাশি তরমুজ, বাঙ্গি, শসা, পেঁপে, ডাব – এসবই প্রকৃতির দান এই প্রখর গ্রীষ্মে।
পানিশূন্যতা রোধে সেরা খাবার ও পানীয়: তৃষ্ণা মেটানোর চেয়েও বেশি
ঘামের সাথে শুধু পানি নয়, বেরিয়ে যায় শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ইলেক্ট্রোলাইট। তাই শুধু পানি পান করলেই চলবে না, দরকার এমন খাবার ও পানীয় যা একসাথে পানির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ইলেক্ট্রোলাইট ও প্রাকৃতিক শর্করাও সরবরাহ করবে। এটিই গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার নির্বাচনের মূলমন্ত্র।
- ডাবের পানি (নারিকেল জল): এটিকে প্রাকৃতিক স্পোর্টস ড্রিঙ্ক বলা যায়। এতে বিদ্যমান পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইট পানিশূন্যতা দূর করার পাশাপাশি শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে শীতল, হালকা মিষ্টি এবং সহজে হজমযোগ্য। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার পাশের ডাবওয়ালা কিংবা গ্রামের নারিকেল গাছ থেকে পাওয়া এই পানীয় সবার জন্যই উপকারী।
- তরমুজ: গ্রীষ্মের অন্যতম জনপ্রিয় ফল তরমুজের ৯০% এর বেশি অংশই পানি! শুধু তাই নয়, এটি লাইকোপিন নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে এবং ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। কুমিল্লা, যশোর, নরসিংদীর মাঠে ফলানো তরমুজের এক টুকরোই দিতে পারে তাত্ক্ষণিক শীতলতা ও প্রশান্তি। কাটা তরমুজ ফ্রিজে রেখে খেতে পারেন, ব্লেন্ড করে জুস বানিয়ে নিতে পারেন, এমনকি সালাদেও যোগ করতে পারেন।
- শসা: শসা একটি অত্যন্ত কম ক্যালোরি সম্পন্ন, পানিসমৃদ্ধ সবজি। এতে সিলিকা নামক উপাদান থাকে যা ত্বক, চুল ও নখের জন্য উপকারী। সালাদ, স্যান্ডউইচ, রায়তা বা এমনি কাঁচা খাওয়া যায়। শসার স্লাইস চোখের উপর রাখলে চোখের ক্লান্তিও দূর হয়।
- দই/ঘোল/লাচ্ছি: প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ দই হজমশক্তি উন্নত করে, পেট ঠান্ডা রাখে এবং শরীরে শীতল প্রভাব ফেলে। এক বাটি টকদই, বা তাতে চিনি/গুড় মিশিয়ে, কিংবা পানি ও লবণ মিশিয়ে ঘোল বানিয়ে পান করুন। মিষ্টি দইয়ের লাচ্ছিও গ্রীষ্মের জনপ্রিয় পানীয়। দইয়ের তৈরি বোরহানিও (মসলা ও পুদিনা মিশ্রিত) শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য চমৎকার। গবেষণা অনুযায়ী, প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার হিট স্ট্রেস মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশে দুগ্ধজাত পণ্যের পুষ্টিগুণ নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন বাংলাদেশ পুষ্টি পরিষদের তথ্যাবলী।
- পুদিনা পাতার শরবত: পুদিনা পাতায় মেন্থল থাকে, যা মুখ ও গলার শীতল অনুভূতি বাড়ায়। এটি পাচনতন্ত্রকে শান্ত করে এবং বমি বমি ভাব দূর করে। কয়েকটি পুদিনা পাতা থেঁতো করে পানির সাথে মিশিয়ে, সামান্য চিনি বা মধু ও লেবুর রস যোগ করে তৈরি করুন স্বর্গীয় শীতল এক পানীয়। বিকেলে কাজের ফাঁকে এক গ্লাস পুদিনা শরবত সত্যিই সঞ্জীবনী শক্তি দান করে।
- ইসবগুলের ভুষি: গরমে পেট খারাপ, অম্লতা বা বদহজমের সমস্যা বেড়ে যায়। ইসবগুলের ভুষি পানির সাথে মিশিয়ে খেলে এটি পানি শোষণ করে জেলির মতো হয়, যা পেট ঠান্ডা রাখে, হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এক গ্লাস পানিতে বা এক বাটি দইয়ে এক-দুই চা চামচ ইসবগুল মিশিয়ে রাতেই খাওয়া যায়। এটি গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার তালিকার একটি ঐতিহ্যবাহী ও কার্যকরী উপাদান।
- লেবুর পানি/বেলের শরবত: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবু ইমিউনিটি বাড়ায় এবং শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। এক গ্লাস ঠান্ডা পানিতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস ও সামান্য লবণ মিশিয়ে পান করুন। অন্যদিকে, বেলের শরবত গ্রীষ্মের আরেকটি জনপ্রিয় ওষধি পানীয়, যা হজমশক্তি বাড়ায় এবং শরীর ঠান্ডা রাখে।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ: গরমে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি, কোলা) এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন। এগুলো প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে শরীরকে আরও ডিহাইড্রেট করতে পারে। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয়ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
গ্রীষ্মের সুপারফুডস: স্থানীয় ও সস্তা উপাদানেই সমাধান
গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার বলতে শুধু পানীয় নয়, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এমন কিছু খাবার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি, যেগুলো হালকা, সহজপাচ্য এবং প্রাকৃতিকভাবেই শীতল প্রভাব বিস্তার করে। দেখে নিন সেই সবুজ-রঙিন সুপারফুডস:
- সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, লাউ শাক, পুঁই শাক, ঢেঁড়স, করলা, ঝিঙে): এই সবজিগুলোতে পানির পরিমাণ বেশি, ফাইবার সমৃদ্ধ এবং হজমে সহায়ক। এগুলোতে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। বিশেষ করে পালং শাক ম্যাগনেসিয়ামে ভরপুর, যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। লাউ, ঝিঙে, করলার মতো সবজিগুলো খুবই হালকা এবং শরীরে ঠান্ডা প্রভাব ফেলে। সেদ্ধ, ঝোল বা ঘন্ট ভাজি করে খাওয়া যায়। গ্রামগঞ্জের বাজারে বা শহরের মৌসুমী সবজির দোকানে এই সবজিগুলো সহজেই পাওয়া যায়।
- পেঁপে: পেঁপে পেপেইন নামক এনজাইম সমৃদ্ধ, যা হজমে সাহায্য করে এবং পেট ঠান্ডা রাখে। এটি ভিটামিন সি ও বিটা-ক্যারোটিনের ভালো উৎস। কাঁচা পেঁপের তরকারি বা পাকা পেঁপে ফল হিসেবে খাওয়া যায়। পাকা পেঁপের সালাদও বেশ উপাদেয়।
- কলা: প্রচণ্ড গরমে ঘামের সাথে বেরিয়ে যাওয়া পটাশিয়াম পূরণে কলা অত্যন্ত কার্যকরী। এটি শক্তি সরবরাহ করে এবং পেশির খিঁচুনি রোধে সাহায্য করে। সকালের নাস্তায় বা বিকেলের স্ন্যাকস হিসেবে নিখুঁত।
- টক দইয়ের সাথে ফল: এক বাটি টকদইয়ের সাথে তরমুজ, বাঙ্গি, কলা বা পেঁপের টুকরো মিশিয়ে নিন। এটি একটি পুষ্টিকর, শীতল ও হালকা নাস্তা বা মিষ্টান্ন। দইয়ের প্রোবায়োটিক আর ফলের ভিটামিন-মিনারেলের কম্বিনেশন গ্রীষ্মের জন্য আদর্শ।
- মৌসুমী ফল (আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, বরই): বাংলাদেশের গ্রীষ্মে নানান রসালো ফলের সমাহার। ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই ফলগুলো শক্তি জোগায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে ভেতর থেকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। তবে আম, লিচু, কাঁঠালে প্রাকৃতিক চিনির পরিমাণ বেশি, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের পরিমিত খাওয়া উচিত। রোজার সময় ইফতারিতে এই ফলগুলোর উপস্থিতি অনিবার্য।
- ঘরে তৈরি স্যুপ (বিভিন্ন সবজির স্যুপ, লেন্টিল স্যুপ): গরমে গরম স্যুপ? হ্যাঁ, তবে তা হতে হবে হালকা ও কম মসলাযুক্ত। সবজি বা ডালের হালকা স্যুপ শরীরে তরলের জোগান দেয় এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। রাতের খাবারে ভারী খাবারের বদলে এক বাটি হালকা গরম স্যুপ ভালো বিকল্প হতে পারে। গ্রীষ্মকালীন স্বাস্থ্যকর রেসিপির জন্য আমাদের রান্না বিভাগে দেখুন।
স্মার্ট খাওয়ার কৌশল: গরমে ভারী, তৈলাক্ত, ভাজাপোড়া ও মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। এগুলো হজমে বেশি সময় নেয়, শরীরে বেশি তাপ উৎপন্ন করে এবং গ্যাস-অম্লের সমস্যা বাড়ায়। বরং ছোট ছোট পরিমাণে বার বার হালকা খাবার খান। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খান, তবে খুব বেশি নয়, যাতে পেট ফাঁপা না হয়।
রান্নার পদ্ধতিরও আছে ভূমিকা: কীভাবে খাবারের ঠান্ডা গুণ বজায় রাখবেন
শুধু গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার বাছাই করলেই হবে না, সেগুলো প্রস্তুত ও রান্নার পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পদ্ধতি খাবারের প্রাকৃতিক শীতল গুণাগুণ নষ্ট করে দিতে পারে:
- কাঁচা বা অল্প সেদ্ধ রাখার চেষ্টা করুন: শসা, টমেটো, গাজর, ক্যাপসিকাম, বিভিন্ন ধরনের শাক (যেমন লেটুস, পুদিনা, ধনিয়া) – এগুলো যতটা সম্ভব কাঁচা সালাদ হিসেবে খান। তরমুজ, বাঙ্গি, পেঁপে ফল হিসেবে কাঁচাই খাওয়া ভালো। লাউ, ঝিঙে, করলা, ফুলকপি, বরবটি ইত্যাদি সবজি হালকা সিদ্ধ করে বা স্টিম করে নিন। বেশি সেদ্ধ বা ভাজলে তাদের পানি ও পুষ্টিগুণ কমে যায়।
- সালাদের উপর জোর দিন: দিনের একটি প্রধান খাবার (বিশেষ করে দুপুরে) হতে পারে বড় একটি সবুজ সালাদ বাটি। বিভিন্ন রঙের শাকসবজি (শসা, টমেটো, গাজর, মুলা, ক্যাপসিকাম, লেটুস), কিছু ফল (আপেল, বেরি), বাদাম বা বীজ এবং দই বা লেবুর রস-জলপাই তেলের হালকা ড্রেসিং দিয়ে তৈরি করুন পুষ্টি ও শীতলতায় ভরপুর সালাদ।
- হালকা রান্না: রান্নায় তেল-মসলা কম ব্যবহার করুন। ঝোল বা ঘন্ট জাতীয় তরকারি (যেমন লাউ-চিংড়ি, ঝিঙে-পটল, ডাল) বেশি উপযোগী গরমে। ভাজাভুজি, কাবাব, বিরিয়ানি বা তেহারির মতো ভারী খাবার সপ্তাহে একদিনের বেশি না খাওয়াই ভালো। ঢাকার বুকে রেস্টুরেন্টের চটকদার মেনু না দেখে, বাড়ির হালকা খাবারের দিকেই মন দিন।
- ঠান্ডা স্যুপ বা গ্যাজপাচো: টমেটো, শসা, ক্যাপসিকাম, রসুন, পুদিনা পাতা ব্লেন্ড করে তৈরি করুন স্প্যানিশ স্টাইলের গ্যাজপাচো – একদম ঠান্ডা পরিবেশন করা এই স্যুপ গ্রীষ্মের জন্য উপহার স্বরূপ। বিভিন্ন সবজি সিদ্ধ করে ব্লেন্ড করেও ঠান্ডা ক্রিমি স্যুপ বানানো যায়।
- দইয়ের ব্যবহার বাড়ান: দই শুধু খাবারেই নয়, রান্নাতেও ব্যবহার করতে পারেন। রায়তা, বোরহানি, দই দিয়ে মাছ বা সবজি রান্না (দইমাছ, দহিবড়া) – সবই শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
সতর্কতা ও বিশেষ বিবেচনা: যেসব খাবার গরমে এড়িয়ে চলবেন
গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার বেছে নেওয়ার পাশাপাশি কিছু খাবার এই সময়ে এড়িয়ে চলা বা সীমিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ:
- অতিরিক্ত তেল-চর্বি ও ভাজাপোড়া: সমুচা, পুরি, তেলে ভাজা পিঁয়াজু, চপ, কাটলেট, ফাস্ট ফুড (বার্গার, পিজা, ফ্রাইড চিকেন) – এসব খাবার হজমে অনেক সময় নেয়, শরীরে তাপ উৎপন্ন করে এবং গ্যাস-বদহজমের সমস্যা তৈরি করে। রোজার সময় ইফতারিতে ভাজাপোড়ার আধিক্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত মসলাদার খাবার: খুব ঝাল বা মসলাদার খাবার মুখ ও পেটে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়াতে পারে। গরম মশলা (গরম মসলার গুঁড়া, লাল মরিচের গুঁড়া) ব্যবহার কমিয়ে দিন। আদা-রসুন-পেঁয়াজের পরিমাণও ভারসাম্য রাখুন।
- প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার: চিপস, কুকিজ, ইনস্ট্যান্ট নুডলস, প্যাকেট জুস, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদিতে প্রচুর লবণ, চিনি, প্রিজারভেটিভ ও কৃত্রিম রং থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং শরীরে পানির চাহিদা বাড়ায়।
- অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার ও পানীয়: মিষ্টি জাতীয় খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায় এবং ক্লান্তি আনে। বাজারজাত মিষ্টি পানীয়, কোল্ড কফি, আর্টিফিশিয়াল ফ্রুট জুসে প্রচুর চিনি থাকে। প্রাকৃতিক ফলের রসও পরিমিত পান করুন।
- অতিরিক্ত আমিষ (প্রোটিন): খুব ভারী মাংস (গরু/খাসির মাংস), ডিমের অতিরিক্ত ব্যবহার হজমে চাপ সৃষ্টি করে। মাছ, চিংড়ি, হালকা মুরগির মাংস বা ডাল থেকে প্রোটিন নেওয়াই ভালো।
বিশেষ দল: শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী, ক্রনিক রোগে (ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদরোগ) আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য খাদ্যতালিকা আরও সতর্কতার সাথে তৈরি করতে হবে। তাদের জন্য ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক। গরমে শিশুদের ঘন ঘন তরল খাবার (ডাবের পানি, লেবুর পানি, ফলের রস, স্যুপ) দিতে হবে এবং মৌসুমী ফল-সবজি খাওয়ানোর অভ্যাস করাতে হবে।
জানুন
- গরমে কোন ফল সবচেয়ে বেশি শরীর ঠান্ডা রাখে?
- উত্তর: তরমুজ, বাঙ্গি (খরবুজা), শসা (যদিও প্রযুক্তিগতভাবে ফল), ডাবের পানি, এবং পাকা পেঁপে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। এগুলোর পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ খুব বেশি, যা শরীরকে হাইড্রেটেড ও শীতল রাখে। এছাড়া লেবু, বেল, আনারসও উপকারী। স্থানীয় ও মৌসুমী ফল বেছে নিন।
- গরমে ঠান্ডা পানি পান করা কি ক্ষতিকর?
- উত্তর: সাধারণত ঠান্ডা পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে বলে প্রচলিত ধারণা আছে। তবে হঠাৎ করে খুব ঠান্ডা পানি পান করলে তা কিছু মানুষের গলা ব্যথা বা টনসিলের সমস্যা বাড়াতে পারে, বিশেষ করে ঘেমে নেয়ে আসার পর। আয়ুর্বেদিক মতে, এটি হজমের আগুন নিভিয়ে দেয় বলে ধরা হয়। স্বাভাবিক বা হালকা ঠান্ডা পানি পান করা নিরাপদ ও উপকারী। তবে অতিরিক্ত ঠান্ডা (বরফ ঠান্ডা) পানি এড়িয়ে চলাই ভালো। ফুটানো পানি ঠান্ডা করে পান করা সর্বোত্তম।
- ডায়াবেটিস রোগীরা গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য কোন খাবার খেতে পারেন?
- উত্তর: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার নির্বাচনে চিনির মাত্রা লক্ষ্য রাখা জরুরি। তারা খেতে পারেন: শসা, টমেটো, লাউ, ঝিঙে, করলা, পালং শাক, ঢেঁড়স (কম তেল-মসলায় রান্না), সীমিত পরিমাণে তরমুজ বা বাঙ্গি (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী), টকদই/ঘোল (চিনি ছাড়া), ডাবের পানি (প্রাকৃতিক মিষ্টি, পরিমিত), লেবুর পানি (চিনি ছাড়া), ইসবগুলের ভুষি (চিনি ছাড়া পানিতে), পুদিনা পানীয় (চিনি ছাড়া বা স্টেভিয়া দিয়ে)। মিষ্টি ফল (আম, লিচু, আঙ্গুর) এবং মিষ্টি পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে।
- গরমে বারবার বমি বা পাতলা পায়খানা হলে কী খাবেন?
- উত্তর: এই অবস্থায় গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার এর পাশাপাশি বিশেষ সতর্কতা দরকার। প্রথমে প্রচুর তরল (ওরাল স্যালাইন, ডাবের পানি, ভাতের মাড়, চালের গুঁড়ার জাউ) খেতে হবে পানিশূন্যতা রোধে। হালকা ও নরম খাবার খান: চিড়া (ভিজানো), মুড়ি (ভেজানো), কলা, সিদ্ধ আলু, টকদই, পাতলা স্যুপ, ডালের স্যুপ। তেল-মসলা, ভাজাপোড়া, দুধ, মাংস, কাঁচা শাকসবজি এড়িয়ে চলুন। অবস্থার উন্নতি না হলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
- গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে সকালে খালি পেটে কী খাওয়া ভালো?
- উত্তর: সকালে খালি পেটে হালকা গরম পানি বা এক গ্লাস লেবুর পানি (গরম বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায়, সামান্য মধু বা চিনি ছাড়া) পান করা ভালো। এটি শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে। এরপর নাস্তায় রাখুন এক বাটি টকদই বা ফলের সালাদ (তরমুজ, পেঁপে, আপেল), বা ভেজানো বাদাম ও চিড়া। ভারী নাস্তা এড়িয়ে চলুন।
- গরমে ত্বক ভালো রাখতে কোন খাবার খাব?
- উত্তর: গরম ও সূর্যের তাপে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার এর পাশাপাশি ত্বকের জন্য উপকারী খাবারগুলো হলো: পানিসমৃদ্ধ ফল-সবজি (তরমুজ, শসা – ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে), বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার (গাজর, মিষ্টি আলু, কুমড়া – সূর্যের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে), ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (আমলকী, লেবু, পেয়ারা, ক্যাপসিকাম – কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে), অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার (বেরি জাতীয় ফল, ডার্ক চকলেট, সবুজ চা – ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি কমায়), এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার (চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড, সামুদ্রিক মাছ – ত্বকের প্রদাহ কমায়)। প্রচুর পানি পান করাও অত্যাবশ্যক।
এই নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য সাধারণ স্বাস্থ্য জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। এটি কোনোভাবেই চিকিৎসকের পেশাদার পরামর্শ, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার বিকল্প হিসাবে বিবেচিত হওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি। কোনো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা বা চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সর্বদা একজন যোগ্য চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর পরামর্শ নিন।
প্রচণ্ড দাবদাহের এই সময়ে প্রকৃতির দেওয়া সহজলভ্য উপাদানগুলোই হতে পারে আপনার শরীরের সেরা প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যবস্থা। তরমুজের এক ফালের রস, ডাবের এক চুমুক পানি, টকদইয়ের এক বাটির শীতলতা, পুদিনার এক গ্লাস সতেজতা – এগুলো কোনো জটিল সমাধান নয়, বরং আমাদেরই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক উপহার। গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার খাবার সম্পর্কে এই জ্ঞান শুধু আপনার নিজের জন্যই নয়, পরিবারের বয়স্ক সদস্য, কর্মব্যস্ত সহকর্মী, বা পথশিশু সবার জন্যই কাজে লাগাতে পারেন। নিজেকে হাইড্রেটেড রাখুন, পুষ্টিকর ও হালকা খাবার বেছে নিন, ভারী ও জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন। মনে রাখবেন, একটি শীতল ও সতেজ শরীরই পারে এই গ্রীষ্মকে মোকাবিলা করে কর্মক্ষম ও সুস্থ থাকতে। আপনার দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় আজই যোগ করুন শরীর ঠান্ডা রাখার এই সহজ ও প্রাকৃতিক উপায়গুলো, এবং এই গরমকে করুন আরামদায়ক ও সুস্থতার সাথে কাটানোর উপভোগ্য সময়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।