আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সায়রা বালুচ যখন প্রথমবারের মতো একটি মর্গে ঢুকেছিলেন করেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫। অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই কক্ষে তিনি কেবল আর্তনাদ, চাপা কান্না, ফিসফাস প্রার্থনা এবং মানুষের পদচারণার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। প্রথম যে মৃতদেহটি তিনি দেখেন, সেটি ছিল এমন এক ব্যক্তির, যিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে মনে হচ্ছিল।
তার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, দাঁত খুলে নেয়া হয়েছিল এবং বুকে পোড়ার দাগ ছিল।
‘আমি আর অন্য মৃতদেহের দিকে তাকাতে পারিনি। আমি বেরিয়ে আসি,’ তিনি স্মরণ করেন।
কিন্তু তবুও তিনি স্বস্তি বোধ করেছিলেন, কারণ এটি তার ভাইয়ের মৃতদেহ ছিল না। তার ভাই একজন পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি ২০১৮ সালে বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন।
মর্গের ভেতরে অন্যরাও তাদের প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজতে ব্যস্ত ছিল, বেওয়ারিশ লাশের সারির দিকে তাকিয়ে একটুখানি আশার খোঁজে তারা যে হয়ত এবারই পেয়ে যাবে সেই প্রত্যাশিত মৃতদেহটি। সাইরাও খুব দ্রুত লাশ খোঁজার মতো এই ভয়াবহ কাজের সঙ্গে নিজেকে অনেকটা খাপ খাইয়ে নেন। একটি মর্গ থেকে আরেকটিতে যাওয়া, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা: টিউবলাইটের ঝাপসা আলো, পচনের দুর্গন্ধে ভারি বাতাস আর জীবাণুনাশকের তীব্র উৎকট গন্ধ। বিবিসির অনুসন্ধানে এমন সব উঠে এসেছে।
প্রত্যেক সফরে তিনি আশা করতেন, তিনি যেন কখনো তা খুঁজে না পান যা তিনি খুঁজছেন। সাত বছর কেটে গেছে, এখনো তিনি খুঁজে পাননি।
কর্মকর্তাদের মতে, গত দুই দশকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী হাজার হাজার জাতিগত বেলুচ ব্যক্তিকে গুম করেছে। অনেককে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই আটক করা হয়েছে, আবার অনেককে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহ দমনের নামে।
পাকিস্তান সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দাবি করে যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে অথবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
কয়েক বছর পর কিছু লোক ফিরে আসে, মানসিক ও শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে—কিন্তু অনেকে আর ফিরে আসে না। তাদের অনেকের মৃতদেহ পাওয়া যায় বেলুচিস্তানের অচিহ্নিত গণকবরগুলোতে, যেগুলো এতটাই বিকৃত যে সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
এবং এরপর আসে অপেক্ষারত নারীদের গল্প যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের নিখোঁজ প্রিয়জনদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
তরুণ থেকে বৃদ্ধ, সবাই এই প্রতিবাদে শামিল হয়, তাদের মুখ ক্লান্ত ও বেদনায় ভরা, হাতে উঁচিয়ে ধরে পুরোনো হয়ে যাওয়া ছবি, তাদের ভালোবাসার মানুষদের, যারা আর তাদের জীবনে নেই।
যখন সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিকরা তাদের বাড়িতে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন, তারা আমাদের চায়ের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল—চিপসানো কাপের মধ্যে কালো চা, সুলেমানি চা। আর সঙ্গে ছিল তাদের শোকগাঁথা ভারি কণ্ঠস্বর, যা দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তাদের অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে তাদের বাবা, ভাই বা ছেলেরা নিরপরাধ এবং কেবল রাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য অথবা ‘সমষ্টিগত শাস্তি’র শিকার হিসেবে তাদের তুলে নেয়া হয়েছে।
সাইরা বালুচ তাদেরই একজন। সাইরার আশা এখনো বেঁচে আছে।
তিনি বলেন, পুলিশ ও রাজনীতিবিদদের কাছে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার ভাই সম্পর্কে কোনো উত্তর পাননি, তাই শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতিবাদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
মুহাম্মদ আসিফ বালোচ ২০১৮ সালের আগস্টে আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী নুশকি শহর থেকে আরও ১০ জনের সঙ্গে আটক হন।
তার পরিবার প্রথমে টিভিতে তার ছবি দেখে জানতে পারে যে তিনি আটক হয়েছেন। ছবিতে তাকে ভীত ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল।
কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, আটক ওই ব্যক্তিরা ‘সন্ত্রাসী’ এবং আফগানিস্তানে পালিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু মুহাম্মদের পরিবার বলেছিল, তিনি কেবল বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিলেন।
সাইরা বলেন, মুহাম্মদ ছিলেন তার ‘সেরা বন্ধু’, সব সময় হাসিখুশি ও মজার মানুষ।
‘আমার মা উদ্বিগ্ন থাকেন যে, তিনি হয়তো একদিন ছেলের হাসির স্মৃতি ভুলে যাবেন।’
সেই দিন, যেদিন মুহাম্মদ নিখোঁজ হন, সাইরা একটি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল এবং সে উচ্ছ্বাস নিয়ে তার ভাইকে জানাতে চেয়েছিল যে তার ‘সবচেয়ে বড় সমর্থক’।
মুহাম্মদ তাকে কোয়েটার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।
‘আমি তখন ভাবিনি যে কোয়েটায় আমার প্রথম যাওয়া হবে একটি প্রতিবাদে অংশ নিতে, তার মুক্তির দাবি জানাতে,’ সাইরা বলেন।
যে ১০ জনের সঙ্গে মুহাম্মদকে আটক করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে তিনজন ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছিল, কিন্তু তারা কখনো প্রকাশ্যে বলেনি তাদের সঙ্গে কী ঘটেছিল।
মুহাম্মদ আর ফিরে আসেননি।
নির্জন পথ, অনুর্বর ভূমি: পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানে যাওয়া মানে এক অন্য জগতে প্রবেশ করা।
এটি বিশাল, দেশের প্রায় ৪৪ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ।
এখানে মাটির নিচে আছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, তামা ও স্বর্ণের বিপুল সম্পদ।
এর বিস্তৃতি আরব সাগরের তট পর্যন্ত, যেখানে অপরপ্রান্তে রয়েছে দুবাইয়ের মতো শহর, যা মরুভূমি থেকে উঠে এসে পরিণত হয়েছে আকাশচুম্বী অট্টালিকার ঝলমলে নগরীতে।
কিন্তু বেলুচিস্তান এখনো সময়ের বাইরে আটকে আছে।
নিরাপত্তার কারণে অনেক এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ, এবং বিদেশি সাংবাদিকদের সাধারণত প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না।
এখানে চলাচলও কষ্টকর।
পথগুলো দীর্ঘ এবং জনশূন্য যা বিচ্ছিন্ন পাহাড় ও মরুভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।
যত দূর এগোবেন, ততই পরিকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে—সড়কের জায়গায় কেবল ধূলিময় পথ, যেখানে কদাচিৎ কিছু যানবাহন চলাচল করে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত, পানির সংকট তীব্র।
স্কুল ও হাসপাতালের অবস্থা দুর্দশাগ্রস্ত।
বাজারগুলোতে, কাদামাটির তৈরি দোকানের সামনে পুরুষ বিক্রেতারা বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়। তবে ক্রেতার সংখ্যা খুব কম।
এখানকার ছেলেরা, যারা পাকিস্তানের অন্যান্য জায়গায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, তারা এখান থেকে কেবল পালানোর কথা ভাবেন। হয়তো করাচি বা উপসাগরীয় দেশগুলোতে বা যেকোনো এমন জায়গায়, যা এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।