ভোরবেলার ফজর আজানের সুরেলা ধ্বনি। মক্কার পবিত্র মাটিতে সিজদারত লাখো মানুষের সারি। গোলাকার কাবা শরীফের চারপাশে প্রদক্ষিণরত ভক্তজনের এক অদ্ভুত ঐকতান। এই দৃশ্যগুলো শুধু চোখে দেখার জন্য নয়, হৃদয়ে অনুভব করার জন্য লাখো মুসলিমের আজীবনের স্বপ্ন – হজ। কিন্তু এই স্বপ্নপূরণের পথ কাঁটায় ভরা। ভিসা জটিলতা, আর্থিক প্রস্তুতি, শারীরিক কষ্ট, আবেগের জোয়ার – সব মিলিয়ে হজযাত্রার প্রস্তুতি একটি সুবিশাল, জটিল, অথচ পবিত্র দায়িত্ব। এটি শুধু একটি যাত্রা নয়; এটি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের জন্য আত্মার গভীর প্রস্তুতি। হজযাত্রার প্রস্তুতি নেওয়ার এই যাত্রাপথে আপনাকে এক মুহূর্তও বিভ্রান্ত বা অনিশ্চিত থাকতে দেবেন না এই গাইড। এখানে পাবেন ধাপে ধাপে, বাস্তবসম্মত, আইনগতভাবে নির্ভুল এবং হৃদয়স্পর্শী সব দিকনির্দেশনা, যাতে আপনার হজ হয় শান্তিময়, তৃপ্তিদায়ক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সোপান।
Table of Contents
হজযাত্রার প্রস্তুতি: শুরুতেই যা অপরিহার্য – মন, অর্থ ও নিয়তের পরিশুদ্ধি
হজযাত্রার প্রস্তুতি শুরুর আগে প্রথমেই হৃদয়ে বসাতে হবে একটাই প্রশ্ন: “আমি কেন হজ করছি?” শুধু সামাজিক রেওয়াজ, প্রতিবেশীর চাপ বা ধনদৌলত প্রদর্শনের জন্য নয় – একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, নিঃস্বার্থভাবে এই মহান ইবাদতের নিয়ত করতে হবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (বুখারী ও মুসলিম)। এই নিয়তের পরিশুদ্ধিই হলো হজযাত্রার প্রস্তুতির ভিত্তিপ্রস্তর। এরপর আসে আর্থিক প্রস্তুতি। হজ একটি আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলিমের উপর ফরজ। তাই:
- হালাল উপার্জন নিশ্চিত করুন: হজের খরচের প্রতিটি টাকা হালাল উৎস থেকে আসা অপরিহার্য। সন্দেহজনক বা হারাম অর্থে হজ করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
- বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরি করুন: বাংলাদেশ থেকে হজের প্যাকেজের খরচ সরকারি-বেসরকারি ভেদে ৫ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে (২০২৪ সাল অনুযায়ী)। এর বাইরে থাকবে:
- জাকাত/ফিতরা: যদি বাকি থাকে।
- পরিবারের ভরণপোষণ: হজের সময় ও পরে ফেরত আসা পর্যন্ত পরিবারের সুব্যবস্থা।
- জরুরি তহবিল: অসুস্থতা বা অন্য কোনো জরুরি অবস্থার জন্য আলাদা সঞ্চয়।
- সাদাকাহ/হাদিয়া: পবিত্র স্থানে দান ও স্বজনদের জন্য উপহারের খরচ।
- সরকারি কোটা বনাম বেসরকারি এজেন্সি: বাংলাদেশে হজ ব্যবস্থাপনা প্রধানত দুইভাবে হয়।
- সরকারি কোটা: ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে হজ অফিসের মাধ্যমে। প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, খরচ তুলনামূলক কম, কিন্তু লটারির মাধ্যমে সিলেকশন হয়। আবেদন সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়। বাংলাদেশ হজ অফিসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে সর্বশেষ গাইডলাইন ও আবেদন ফর্ম ডাউনলোড করুন।
- বেসরকারি এজেন্সি (প্রাইভেট হজ প্যাকেজ): বাংলাদেশ হজ অফিস কর্তৃক অনুমোদিত এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে। খরচ বেশি, কিন্তু সার্ভিস ও সুযোগ-সুবিধা ভিন্ন হতে পারে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: বিমান, আবাসন, খাদ্য, ট্রান্সপোর্টেশন – প্রতিটি বিষয়ের বিস্তারিত চুক্তিনামা (যাতে এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর, পরিষেবার বিবরণ, জরুরী যোগাযোগ স্পষ্ট থাকে) লিখিতভাবে নিতে হবে এবং বাংলাদেশ হজ অফিসের তালিকায় এজেন্সিটি আছে কিনা নিশ্চিত হতে হবে। “আমাদের এজেন্সি বিশ্বস্ত” – এই কথায় বিশ্বাস করবেন না, লিখিত প্রমাণ চাই।
মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি: হজ সহজ নয়। প্রচণ্ড গরম, বিশাল জনসমাগম, দীর্ঘ ভ্রমণ, নতুন পরিবেশ – মানসিক ধৈর্য ও সহনশীলতা অপরিহার্য। ধর্মীয় গ্রন্থাবলী (কুরআন, হাদিসের সহজ ব্যাখ্যা) পড়ে হজের তাৎপর্য, রীতিনীতি ও করণীয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করুন। ধ্যান, জিকির-আজকার বাড়িয়ে নিজের অন্তরকে প্রশান্ত রাখার চেষ্টা করুন।
হজযাত্রার প্রস্তুতি: কাগজপত্র, স্বাস্থ্য ও আবশ্যিক আইটেমের বিস্তারিত চেকলিস্ট
কাগজপত্র ছাড়া এক পাওয়া যায় না, বিশেষ করে হজের মতো আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় ভ্রমণে। এদিকে ভিসা, পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য – সবকিছুতেই হতে হবে নির্ভুল।
- পাসপোর্ট ও ভিসা:
- পাসপোর্টের মেয়াদ হজ সমাপ্তির পর অন্তত ছয় মাস থাকতে হবে।
- ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কাগজ (আবেদন ফর্ম, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, হজ এজেন্সির নিশ্চয়তা পত্র, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি) সময়মতো জমা দিতে হবে। ভুলে যাবেন না: ভিসা প্রক্রিয়া এজেন্সি বা হজ অফিসের মাধ্যমে হয়, আপনার সরাসরি ভূমিকা সীমিত। তবে কপিগুলো নিজের কাছে রাখুন।
- পাসপোর্ট ও ভিসার একাধিক ফটোকপি (রঙিন) তৈরি করুন, আলাদা ব্যাগে রাখুন। ফোনে স্ক্যান্ড কপি সেভ করুন।
- স্বাস্থ্য প্রস্তুতি: আপনার হজযাত্রার প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ
- ফুল বডি চেকআপ: হজের কয়েক মাস আগেই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কিডনি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির পরীক্ষা করান। ডাক্তারের পরামর্শে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিন। সৌদি আরব সরকার বাধ্যতামূলক কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা চায় (যেমন: মেনিনজাইটিস, ফ্লু, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনেশন – বছরের নির্দেশনা অনুযায়ী)।
- অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ: নিজের নিয়মিত ওষুধ (চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অবশ্যই সঙ্গে রাখুন, ইংরেজিতে লেখা) পর্যাপ্ত পরিমাণে নিন (সফরের সময়সহ অতিরিক্ত ১৫-২০ দিনের)। সাধারণ ওষুধ (প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, ডায়রিয়ার ওষুধ, ORS, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, সানস্ক্রিন লোশন SPF 50+, পেইন রিলিভিং জেল, ইলেক্ট্রোলাইট পাউডার) নিতে ভুলবেন না।
- ডেন্টাল চেকআপ: দাঁতের ব্যথা হজের পবিত্র মুহূর্তগুলো নষ্ট করে দিতে পারে।
- চশমা/লেন্স: অতিরিক্ত চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স এবং সলিউশন নিন।
- স্বাস্থ্যবিমা: হজের জন্য নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিমা নেওয়া বাধ্যতামূলক (সাধারণত এজেন্সি/হজ অফিসের মাধ্যমে ব্যবস্থা হয়), তবে অতিরিক্ত ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স নেওয়াও বিবেচনা করুন।
- প্যাকিং লিস্ট: হালকা কিন্তু প্রয়োজনীয়
- ইহরাম: সুতি বা অন্যান্য হালকা কাপড়ের তৈরি কমপক্ষে দুই সেট ইহরাম (পুরুষের জন্য সাদা, নারীর জন্য সাধারণ পোশাক কিন্তু নির্দিষ্ট নিয়ম)। ইহরামের জন্য সেলাইবিহীন স্যান্ডেল বা ফ্লিপ-ফ্লপ।
- সাধারণ পোশাক: হজ শেষে মদিনা বা অন্যত্র থাকার সময়ের জন্য হালকা সুতি পোশাক (মেয়েদের আবায়া/হিজাব বাধ্যতামূলক)।
- প্রার্থনার সরঞ্জাম: ছোট্ট পকেট কুরআন, জায়নামাজ (হালকা ওয়াটারপ্রুফ), তাসবিহ, কিবলা কম্পাস (ফোনের অ্যাপও কাজে দেয়, তবে ব্যাকআপ ভালো)।
- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা: ট্রাভেল সাইজ টুথপেস্ট-ব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু, টাওয়েল (মাইক্রোফাইবার দ্রুত শুকায়), টিস্যু, ওয়েট উইপস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
- অন্যান্য: ছাতা (UV প্রোটেকশন), পানির বোতল (রিফিলযোগ্য), ছোট ব্যাকপ্যাক (দৈনন্দিন ব্যবহার), পাওয়ার ব্যাংক, চার্জার, সৌদি সিম কার্ড (প্রায়ই এজেন্সি দেয়, নাহলে কিনুন), বাংলাদেশি টাকার কিছু নোট (প্রাথমিক খরচের জন্য), সৌদি রিয়াল। গুরুত্বপূর্ণ: সব জিনিসের লেবেল লাগিয়ে রাখুন (নাম, বাংলাদেশি মোবাইল নম্বর, গ্রুপ নম্বর)।
স্মরণীয়: হজযাত্রার প্রস্তুতির এই ধাপে বিমান সংস্থা ও সৌদি কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ নিষিদ্ধ সামগ্রীর তালিকা (যেমন: ধারালো জিনিস, বড় পারফিউম বোতল, নির্দিষ্ট ওষুধ বিনা প্রেসক্রিপশনে) অবশ্যই চেক করুন। অতিরিক্ত লাগেজের চেয়ে কম লাগেজে প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়াই উত্তম।
মক্কা-মদিনায় অবস্থান ও ইবাদত: সময় ব্যবস্থাপনা ও মানসিক প্রস্তুতি
হজযাত্রার প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ হলো সৌদি আরবে পৌঁছে কীভাবে সময় কাটাবেন, কীভাবে ইবাদত করবেন তার পরিকল্পনা। বিশাল জনসমুদ্রে নিজেকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন।
- মক্কায় পৌঁছানো ও উমরাহ:
- সাধারণত হজযাত্রীরা প্রথমে জেদ্দায় পৌঁছে মক্কায় যান। মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান) পার হওয়ার আগেই ইহরাম বেঁধে নিতে হবে। এখানেই শুরু হয় পবিত্রতা।
- কাবা শরীফে প্রথম দর্শন: আবেগে আপ্লুত হওয়া স্বাভাবিক। তবে ভিড় সামলাতে হবে। তাওয়াফ (৭ চক্কর) ধীরে, স্থির মনে আদায় করুন। ভিড়ে ধাক্কা-ধাক্কি এড়িয়ে চলুন। নারীরা সাধারণত পুরুষদের থেকে আলাদা/উচ্চতর এলাকায় তাওয়াফ করেন।
- সাঈ (সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে ৭ বার দৌড়ানো/হাঁটা): এখন এয়ারকন্ডিশন্ড টানেলে করা হয়। ধৈর্য ধরে ধাপে ধাপে সম্পন্ন করুন।
- হেড শেভ/ট্রিম (হালক): পুরুষরা মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করবেন, নারীরা চুলের ডগা সামান্য কাটবেন। এতে উমরাহ সম্পন্ন হয় এবং ইহরাম খুলে যায়।
- হজের দিনগুলোর প্রস্তুতি (৮-১৩ জিলহজ):
- ৮ জিলহজ (তারবিয়ার দিন): মক্কা থেকে মিনায় যাত্রা। মিনায় অবস্থান, নামাজ আদায় (কসর করে)। মানসিক প্রস্তুতি নিন: পরের দিন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়ানোই হজের মূল কর্ম।
- ৯ জিলহজ (আরাফাতের দিন): সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। ফজরের পর মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, দোয়া, জিকির, ইস্তেগফারে কাটানো ফরজ। এক মুহূর্তও আরাফাতের সীমানা ছেড়ে বের হবেন না। প্রচুর পানি পান করুন, ছাতা ব্যবহার করুন। দোয়া-ই আরাফাহ: এই দিনের দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপক সুসংবাদ রয়েছে। নিজের, পরিবারের, সমগ্র উম্মাহর জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করুন।
- সূর্যাস্তের পর: আরাফাত থেকে মুজদালিফায় যাত্রা। এখানে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করে রাত কাটাতে হবে। কঙ্কর (ছোট পাথর) সংগ্রহ করুন (৭০টি, পরের দিনের জন্য)।
- ১০ জিলহজ (ঈদের দিন): ফজরের পর মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরুন। জামারাতুল আকাবায় শয়তানকে সাতটি কঙ্কর মারুন (রমি)। তারপর কুরবানি দিন (নিজে করতে না পারলে এজেন্সির মাধ্যমে ব্যবস্থা হয়)। এরপর হালক (মাথা মুন্ডন/চুল কাটা)। এখন ইহরাম খুলে গেল। মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত (ফরজ তাওয়াফ) ও সাঈ আদায় করুন (যদি উমরাহতে না করে থাকেন)।
- ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ (তাশরিকের দিন): মিনায় অবস্থান। প্রতিদিন তিন জামরায় (ছোট, মধ্যম, বড়) সাতটি করে মোট ২১টি কঙ্কর মারুন (অপেক্ষাকৃত কম ভিড়ে, সাধারণত দুপুরের পর)। ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করলে ১৩ জিলহজের রমি করা জরুরি নয়।
- মদিনায় জিয়ারত: হজ শেষে মদিনায় রাসূল (সা.)-এর রওজা মুবারক জিয়ারত করা সুন্নত। এখানকার আবহাওয়া তুলনামূলক ভালো।
- মসজিদে নববীতে নামাজ: এখানে এক নামাজ অন্য মসজিদে (মসজিদে হারাম ছাড়া) এক লক্ষ নামাজের সমান।
- রওজা শরীফ জিয়ারত: শান্তভাবে সালাম পেশ করুন, দোয়া করুন। ভিড় ও ধাক্কাধাক্কি পরিহার করুন। মহিলাদের জন্য আলাদা সময়/জায়গার ব্যবস্থা থাকে।
- জিয়ারতের স্থান: উহুদ পাহাড়, কুবা মসজিদ, মসজিদে কিবলাতাইন ইত্যাদি।
ভিড় ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা:
- গ্রুপে থাকুন: এজেন্সির মুয়াল্লিম/গাইডের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখুন। গ্রুপের সদস্যদের ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করুন।
- আইডি কার্ড/ব্রেসলেট: সবসময় পরিধান করুন।
- মিটিং পয়েন্ট: হারিয়ে গেলে কোথায় মিলিত হবেন তা আগেই ঠিক করুন।
- ধৈর্য ও ভদ্রতা: ভিড়ে উত্তেজিত হবেন না। ধাক্কা দিবেন না। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ (হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির) বলতে বলতে এগিয়ে যান।
- জরুরি নম্বর: সৌদি কর্তৃপক্ষ ও এজেন্সির জরুরি নম্বর ফোনে সেভ করুন।
হজ পরবর্তী জীবন: ফিরে আসা এবং দায়িত্ব
হজযাত্রার প্রস্তুতি শুধু সৌদি আরব যাওয়ার আগে নয়, ফিরে আসার পরও জরুরি। কবুল হজের আলামত হলো ব্যক্তির আচরণ ও জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন।
- গুনাহ থেকে তাওবা ও দূরত্ব: কবুল হজের পর যেন পূর্বের গুনাহে ফিরে না যাওয়া যায়।
- নিষ্ঠার সাথে ফরজ ইবাদত: নামাজ, রোজা, জাকাতের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া।
- সদাচরণ: পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজের সাথে উত্তম আচরণ, সত্য কথা বলা, আমানতদারিতা।
- অনুভূতি শেয়ার: পরিবার ও অন্যদের সাথে হজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা শেয়ার করা, তাদের উৎসাহিত করা।
- দায়িত্ব: হজ ফরজ হওয়ার শর্ত (শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সক্ষমতা) অন্যদের মাঝে তৈরি হলে, তাদের হজে সাহায্য করা বা উৎসাহ দেওয়া।
হজযাত্রার প্রস্তুতি কখনোই শুধু বাহ্যিক প্রস্তুতির বিষয় নয়। এটি হৃদয়ের গভীর থেকে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেওয়ার, আত্মশুদ্ধির, ধৈর্য ও ত্যাগের এক মহান প্রশিক্ষণ। প্রতিটি ধাপ – নিয়ত থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত – ইবাদতের অংশ। সঠিক প্রস্তুতি, সচেতনতা এবং একাগ্র নিয়তই পারে এই পবিত্র সফরকে করে তুলতে সার্থক ও আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।
এই পবিত্র হজযাত্রার প্রস্তুতির যাত্রাপথে এই গাইড আপনার পাথেয় হোক। মনে রাখবেন, আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা (তাওয়াক্কুল) এবং সাধ্যমত চেষ্টা (তদবীর) – এই দুয়ের সমন্বয়েই সফলতা। আপনার হজ কবুল হোক, আপনার ত্যাগ ও কষ্ট আল্লাহর দরবারে মঞ্জুর হোক, এবং এই সফর আপনার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দিক – আমিন। এখনই শুরু করুন আপনার আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক প্রস্তুতি, আপনার স্বপ্নের হজযাত্রাকে বাস্তবে রূপ দিন।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: হজযাত্রার প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী?
উত্তর: হজযাত্রার প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়তের পরিশুদ্ধি। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করতে হবে, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। এরপরই আসে আর্থিক প্রস্তুতি – হালাল উপার্জন থেকে হজের খরচ মেটানো এবং শারীরিক প্রস্তুতি – ফিটনেস ও প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা।
প্রশ্ন: হজের জন্য কত টাকা খরচ হয়? সরকারি নাকি বেসরকারি প্যাকেজ ভালো?
উত্তর: ২০২৪ সালের হিসেবে বাংলাদেশ থেকে হজের খরচ সরকারি প্যাকেজে প্রায় ৫-৬ লক্ষ টাকা এবং বেসরকারি প্যাকেজে ৬-৮ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে। সরকারি প্যাকেজ তুলনামূলক সস্তা ও স্বচ্ছ, কিন্তু লটারির মাধ্যমে নির্বাচন হয়। বেসরকারি প্যাকেজে খরচ বেশি, তবে সার্ভিস ও সুযোগ-সুবিধা ভিন্ন হতে পারে। সরকারি হজ অফিসের অনুমোদন আছে এমন এজেন্সি বেছে নিন এবং সবকিছু লিখিত চুক্তিতে নিন।
প্রশ্ন: হজে কী কী স্বাস্থ্য প্রস্তুতি নেবেন?
উত্তর: হজের আগে অবশ্যই পূর্ণ শরীরের চেকআপ করান (হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কিডনি ইত্যাদি)। বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন (মেনিনজাইটিস, ফ্লু, কোভিড-১৯ – নির্দেশনা অনুযায়ী) সময়মতো নিন। নিজের নিয়মিত ওষুধ (চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনসহ) পর্যাপ্ত পরিমাণে নিন। সাধারণ ওষুধ (প্যারাসিটামল, ডায়রিয়ার ওষুধ, ORS, সানস্ক্রিন), ডেন্টাল চেকআপ এবং চশমা/লেন্সের ব্যাকআপ নেওয়া জরুরি। প্রচুর পানি পান ও বিশ্রামের অভ্যাস করুন।
প্রশ্ন: হজের সময় মক্কা-মদিনায় নিরাপত্তা ও ভিড় সামলাবেন কীভাবে?
উত্তর: সবসময় গ্রুপে থাকুন এবং মুয়াল্লিম/গাইডের সংস্পর্শে থাকুন। আইডি কার্ড/ব্রেসলেট সবসময় পড়ে রাখুন। গ্রুপ মেম্বার ও গাইডের ফোন নম্বর সংরক্ষণ করুন এবং মিটিং পয়েন্ট ঠিক করুন। ভিড়ে ধৈর্য ধারণ করুন, ধাক্কাধাক্কি এড়িয়ে চলুন, ‘লাব্বাইক’ পড়তে থাকুন। জরুরি প্রয়োজনে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা এজেন্সির জরুরি নম্বরে ফোন করুন। সতর্ক থাকুন, তবে ভয় পাবেন না – সৌদি কর্তৃপক্ষ হজের সময় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়।
প্রশ্ন: হজের পর কী কী করণীয়? হজ কবুল হয়েছে বুঝব কীভাবে?
উত্তর: হজ ফেরার পর গুনাহ থেকে সত্যিকারের তাওবা করুন এবং আগের গুনাহে ফিরে যাবেন না। নিষ্ঠার সাথে ফরজ ইবাদত (নামাজ, রোজা, জাকাত) আদায়ে মনোযোগ দিন। পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের সাথে উত্তম আচরণ করুন, সত্য বলুন, আমানতদার হোন। হজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। হজ কবুলের নির্দিষ্ট নিশানী নেই, তবে হজের পর ব্যক্তির জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন (আল্লাহভীতি, ইবাদতে আগ্রহ, চরিত্রের উন্নতি) আসা এবং পূর্বের গুনাহ পরিত্যাগ করার প্রবণতাই এর বড় আলামত।
প্রশ্ন: হজের সময় মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ব্যবহার করা যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যায় এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ (গাইড/পরিবারের সাথে যোগাযোগ, জরুরি প্রয়োজন)। তবে ইবাদতের সময় (তাওয়াফ, সাঈ, নামাজ, আরাফাতের দোয়ার সময়) ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকাই উত্তম, যাতে ইবাদতে মনোনিবেশ করতে পারেন। ছবি তোলার ক্ষেত্রে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর ভেতর সাধারণত ছবি তোলা নিষেধ (বিশেষ করে নামাজের সময় বা কাবার খুব কাছাকাছি)। বাইরে ও জিয়ারত স্থানে সতর্কতার সাথে ছবি তোলা যায়। অন্য হাজিদের ছবি তোলার আগে অনুমতি নেওয়া উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।