শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেশে নজরদারির সরঞ্জাম কেনার বিষয় খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
কমিটি খতিয়ে দেখবে এসব সরঞ্জাম কীভাবে, কোথা থেকে এবং কত দামে কেনা হয়েছে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, সারভেইলেন্স যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে, আবার কিছু অনুযায়ী ২০০ মিলিয়ন ডলারে এসব যন্ত্র কেনা হয়েছিল।
শফিকুল আলম বলেন, ‘গত স্বৈরাচারী সরকার বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক অধিকার হরণের জন্য নজরদারির যন্ত্রপাতি ও স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে। এই অবৈধ নজরদারি মানুষের ন্যূনতম বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। সংবিধানে থাকা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।’
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কমিটি এসব বিষয় তদন্ত করবে-কত টাকা খরচ হয়েছে, কোথা থেকে সরঞ্জাম কেনা হয়েছে এবং ব্যবহার কিভাবে করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক সরঞ্জাম ইসরায়েল থেকে আনা হয়েছে।
বৈঠকে চলমান সংস্কার নিয়ে আলোচনা করা হয়। শফিকুল আলম জানান, সংস্কার কমিশনগুলোর ১২১টি সুপারিশের মধ্যে ১৬টি ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৪টি আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে এবং বাকিগুলো বাস্তবায়নাধীন। নতুনভাবে আরও ২৪৬টি সুপারিশ এসেছে। মোট ৩৬৭টি সুপারিশের মধ্যে ৩৭টি ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে।
তিনি বলেন, শ্রম বিষয়ক ৮২টি সুপারিশের মধ্যে অনেকগুলো বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নারী বিষয়ক ৭১টি সুপারিশও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য খাত ও গণমাধ্যম সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলিও প্রক্রিয়াধীন।
প্রেস সচিব আরও বলেন, পুলিশের মারণাস্ত্র কেনার বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কীভাবে কেনা হয়েছিল এবং ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোও কমিটি তদন্ত করবে।
টেকনোগ্লোবাল ইনস্টিটিউট-এর সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে ১৬০ টিরও বেশি নজরদারি প্রযুক্তি এবং স্পাইওয়্যার আমদানি ও ব্যবহার করেছে।
তবে এই সাইবার নজরদারি রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্য করে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় এবং গণবিক্ষোভের সময়।
অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে এসব প্রযুক্তি প্রায়শই অস্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া এবং তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় আনা হয়েছে।
এক বছর ধরে চলা গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি ৭০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সন্ত্রাস দমনের অজুহাতে এই নজরদারির বিস্তার ঘটে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশিং ঐতিহ্য থেকে আধুনিক সাইবার-ভিত্তিক নেটওয়ার্কে রূপান্তরিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যে ধরনের প্রযুক্তি আমদানি করেছে তার মধ্যে রয়েছে আইএমএসআই ক্যাচার, ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টর অ্যান্ড সেলিব্রাইট, ফিনফিশার, প্রিডেটর-এর মতো উন্নত স্পাইওয়্যার। এসব প্রযুক্তি বিস্তৃত এবং প্রায়শই পরোয়ানা ছাড়া নজরদারি চালানোর সুযোগ করে দেয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই ১৯০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে ইসরায়েলি-উৎস থেকে আসা প্রযুক্তিগুলোর জন্য। এই প্রযুক্তিগুলোর বেশিরভাগই বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বৈরাচারী শাসনও ব্যবহার করছে।
র্যাব ও পুলিশ ওয়াই-ফাই ও মোবাইল নেটওয়ার্ক ইন্টারসেপশন, সিগন্যাল জ্যামিং এবং বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে।
এছাড়া ডিজিএফআই প্রাথমিকভাবে সেল নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ, ট্যাপ করা এবং সিগন্যাল জ্যামিংয়ের জন্য অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করেছে। ২০১৫ সালে তারা সিটিজেন ল্যাব থেকে ফিনফিশার নামের একটি কম্পিউটার স্পাইওয়্যার কিনেছিল, যা ডিভাইসে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করে ডেটা চুরি করতে পারে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের কাছে নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। সবচেয়ে সমালোচিত বিষয় হলো, ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সেলেব্রাইট (Cellebrite), এনএসএ গ্রুপ (পেগাসাস), ইনটেলেক্সা, কোরালকো টেক এবং ইউটিএক্স টেকনোলজিস-এর মতো ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোর তৈরি প্রযুক্তি সাইপ্রাস, সিঙ্গাপুর ও হাঙ্গেরির মতো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এ ছাড়াও তুরস্কের স্পাইওয়্যার ফার্ম বিলগি টেকনোলজি টাসারিম (Bilgi Teknoloji Tasarim-BTT)-ও নজরদারি সরঞ্জাম বিক্রি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নজরদারি ব্যবস্থার এই বিস্তারের পেছনে রয়েছে আইনি দুর্বলতা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১, টেলিগ্রাফ আইন, ১৮৮৫ এবং ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইন, ১৯৩৩-এর মতো পুরোনো আইনগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে ব্যাপক নজরদারির ক্ষমতা দেয়।
এই নজরদারি কার্যক্রমে কোনো সংসদীয় তদারকি, বিচারিক সম্পৃক্ততা বা জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। ফলে, রাষ্ট্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা জনগণের সুরক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নজরদারি প্রযুক্তির ক্রয় নাটকীয়ভাবে বেড়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই প্রযুক্তিগুলো রাজনৈতিক ও নাগরিক আন্দোলন দমনে ব্যবহৃত হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতেও র্যাব-কে জনসমাবেশ ও বিক্ষোভে ব্যবহারের জন্য মোবাইল ইন্টারসেপশন ডিভাইস কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রতিবেদনে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। যদি এই ধরনের সংস্কার না করা হয়, তবে দেশটিতে ডিজিটাল স্বৈরাচারী শাসনের মডেল আরও শক্তিশালী হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেখানে নজরদারি জনগণের স্বার্থ বা নিরাপত্তার বদলে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।