বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : পৃথিবীতে ক্ষিপ্রগতিতে উড়তে সক্ষম যেসব পাখি আছে, তার মধ্যে হামিংবার্ড একটি। এ পাখির ডানার তীব্র গতি ও প্রাণবন্ততা যে কারো নজর কাড়ে, এর জটিল মাংসপেশী ডানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। একটি রোবটের জন্য তা নকল করা এক কঠিন কাজ। সাধারণত, আমাদের দেখা ছোট ডানাওয়ালা রোবট এর ডানা ঝাপটে ঝাপটে চলে।
মানটানার পারডিউ বিশ^বিদ্যালয়ের বায়ো-রোবটিক ল্যাবরেটরিতে ঝিনইয়ান দেং ও তার ছাত্ররা একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়ে এমন একটি ডানাওয়ালা রোবট তৈরি করেছেন, যেটি দেখতে ঠিক একটি হামিংবার্ডের মতো। এর ক্ষিপ্রগতি এটিকে সক্ষম করে তুলেছে ঠিক একটি হামিংবার্ডের মতো কাজ করতে। এর আকার ও গড়ন ঠিক একটি হামিংবার্ডের মতোই। এটি যখন চালু থাকে তখন মনে হয় এটি যেনো হামিংবার্ডের মতোই জীবন্ত ও প্রাণবন্ত। আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটি এর ডানাগুলোকে ব্যবহার করে সেন্সর হিসেবে। এই সেন্সর ব্যবহার করে রোবটটি চলার সময় এর সামনে পড়া কোনো বস্তুর উপস্থিতি জেনে নিতে পারে।
রোবটিস্টেরা তাদের প্রকৌশলজ্ঞান কাজে লাগিয়ে এটিকে এমন সক্ষম করে তুলেছেন যে, এটি অনেকটা হামিংবার্ডের মতোই আচরণ করতে পারে। রোবটিস্টেরা এটিকে এমনভাবে মেশিন লার্নিংয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলেছেন যে, এটি হামিংবার্ডের মতো অ্যাক্রোবেটিক কাজও চালাতে পারে। এর অর্থ এটি কোনো সিমুলেশন বা ভান করা শেখার পর এই রোবট জানে কী করে এর চারপাশে ঘুরতে পারে। হামিংবার্ডের মতো উড়তে পারা ও একটি পোকার মতো আকাশে স্থিরভাবে থাকতে পারা, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারা এবং একই সাথে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমে প্রশিক্ষিত হওয়া ইত্যাদি সবকিছু মিলে এই হামিংবার্ড রোবট অনেকটা জীবন্ত হামিংবার্ডের মতো কাজ করতে সক্ষম। এটি কোনো বিধ্বস্ত ভবন বা বিপজ্জনক স্থানে আটকে পড়া লোকদের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে সহায়তাকারী
হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই রোবটিক হামিংবার্ড ওড়ে এর নিজস্ব চাকার সাহায্যে, যে চাকাটি চলে একটি জ্বালানি উৎসের সাহায্যে। তবে শিগগিরই এটিতে এর বদলে সংযুক্ত করা হবে ব্যাটারি। তখন এটি চলবে ব্যাটারির সাহায্যে।
রোবটটির কোনো চোখ নেই। না দেখেও এটি অপরিহার্যভাবে এর চারপাশের একটি মানচিত্র তৈরি করে নিতে পারে। এর ফলে এটি কোনো অন্ধকার স্থানেও আটকে পড়া কোনো লোকের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে। শিগগিরই একটি সেন্সর সংযোজন করে এর নির্মাতারা এটিকে দেখার ক্ষমতাসম্পন্ন করে তুলতে পারেন এমনটি জানিয়েছেন পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ঝিনইয়ান দেং।
এ এক ভিন্ন পদার্থবিজ্ঞান
ঝনইয়ান দেং জানান প্রকৌশলীরা প্রচলিত এয়ারোডিনামিকস তথা উড্ডয়ন গতিবিদ্যা অবলম্বনে কাজ করে অতি ছোট আকারের ড্রোন তৈরি করতে পারেন না। এসব ড্রোন তাদের ভার বহনে সক্ষম হওয়ার মতো উত্তোলন ক্ষমতা বা লিফট পাওয়ার ধারণ করতে পারে না। কিন্তু হামিংবার্ড রোবট প্রচলিত এয়ারোডিনামিকস ব্যবহার করে না; এবং এগুলোর ডানা স্থিতিস্থাপক; স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। এর পেছনে কাজ করে ভিন্ন ধরনের এক পদার্থবিজ্ঞান। এয়ারোডিনামিকস অন্তর্নিহিতভাবে অস্থিতিশীল। এর অ্যাটাক চলে বেশি কোণ ও বেশি উচ্চতায়। ফলে এর আকার ছোট করা সম্ভব হয়েছে।
গবেষকেরা বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করে আসছেন হামিংবার্ডের উড্ডয়ন ডিকোড করার জন্য। অর্থাৎ তারা জানতে চেয়েছেন হামিংবার্ডের ওড়ার কৌশল। কারণ, এরা চান এদের রোবটকে এমন জায়গায় উড়তে সক্ষম করে তুলতে, যেখানে অধিকতর বড় আকারের রোবট উড়তে পারে না। ২০১১
সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সংস্থা ‘ডিএআরপিএ’ রোবটিক হামিংবার্ড সৃষ্টির জন্য চালু করে ‘এয়ারোভায়রনমেন্ট’ নামের একটি কোম্পানি। তাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি রোবট বানানো, যেটি কাজ করবে জীবন্ত হামিংবার্ডের চেয়েও প্রাণবন্তভাবে। তাদের তৈরি হামিংবার্ড ছিল একটি জীবন্ত হামিংবার্ডের চেয়ে একটু বেশি ভারী এবং তা হামিংবার্ডের মতো ততটা ক্ষিপ্রগতির ছিল না। এর উড্ডয়ন ছিল হেলিকপ্টারের মতো। এর প্রয়োগ-কৌশল ছিল সীমিত। সব সময় এর রিমোট কন্ট্রোলের জন্য একজন লোককে এর পেছনে লেগে থাকতে হতো।
১২ গ্রাম রোবট
দেং-এর গ্রুপ ও এর সহযোগীরা মানটানায় তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে হামিংবার্ডের ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন কয়েকটি গ্রীষ্ম মৌসুমে। এরা লক্ষ করেছেন হামিংবার্ডের বেশ কিছু কৌশল। যেমন হঠাৎ করেই দ্রুত ১৮০ ডিগ্রি মোড় ঘোরার বিষয়টি। এরপর তারা হামিংবার্ডের এ কৌশল ট্র্যানস্লেট করেন কমপিউটার অ্যালগরিদমে। আর রোবট তা শিখতে পারে যখন একে সংযুক্ত করা হয় একটি সিমুলেশনের সাথে।
তা ছাড়া এরা আরো সমীক্ষা চালান পোকামাকড় ও হামিংবার্ডের পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। এই সমীক্ষা গবেষকদের কাজে লাগে হামিংবার্ডের চেয়েও ছোট আকারের একটি রোবট তৈরিতে; এমনকি পোকার আকারের রোবট তৈরিতে। এরা যেভাবে ওড়ে, তার সাথে কোনো আপস না করেই গবেষকেরা এই ছোট আকারের রোবট তৈরি করতে সক্ষম হন। রোবটটি যত বেশি ছোট হবে, এর ডানার ঝাপটার কম্পনও তত বেশি হবে, উড়বেও তত বেশি কার্যকরভাবে।
রোবটটির বডি তৈরি থ্রিডি-প্রিন্টারে। এর ডানাগুলো তৈরি কার্বন ফাইবার দিয়ে। ডানাগুলোতে রয়েছে লেজার-কাট মেমব্রেইন। গবেষকেরা একটি হামিংবার্ড রোবট তৈরি করেছেন, যার ওজন ১২ গ্রাম যা একটি পূর্ণবয়স্ক হামিংবার্ডের গড় ওজনের সমান। তারা আরেকটি রোবট বানিয়েছেন পোকার আকারের, যার ওজন ১ গ্রাম। এই হামিংবার্ড রোবটটি এর ওজনের চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে উড়তে পারে সর্বোচ্চ ২৭ গ্রাম পর্যন্ত। বেশি ওজন উত্তোলনে সক্ষম এসব রোবট ডিজাইন করতে গবেষকদেরকে শেষ পর্যন্ত ব্যাটারি ও সেন্সিং টেকনোলজি নিয়ে প্রচুর কাজ করতে হয়েছে। যেমন কাজ করতে হয়েছে ক্যামেরা বা জিপিএস নিয়ে। বর্তমানে উড্ডয়নের সময়
রোবটটির প্রয়োজন হয় একটি জ্বালানি উৎসের সাথে সংযুক্তি। তবে গবেষকেরা বলছেন, এটি হয়তো আর বেশি দিন প্রয়োজন হবে না। তখন রোবটটি শব্দহীনভাবে উড়তে পারবে অনেকটা জীবন্ত একটি হামিংবার্ডের মতো। তখন এটি আরো বেশি উপযুক্ত হবে গোপন অপারেশনের জন্য। তখন উত্তাল পরিবেশেও এটি শান্তভাবে কাজ করতে পারবে। গবেষকেরা এই বিষয়টি প্রদর্শন করেছেন একটি তেলের ট্যাঙ্কে পরীক্ষা চালানোর সময়।
রোবটটির জন্য প্রয়োজন শুধু দুটি মোটর। এর দুটি ডানা আলাদা আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেং বলেন ‘একটি প্রকৃত হামিংবার্ডের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রুপের মাংসপেশী। কিন্তু রোবট হামিংবার্ড হতে হবে যথাসম্ভব হালকা, যাতে এর পারফরম্যান্স ভালো হয়। এই রোবট আমাদেরকে শুধু উদ্ধার অভিযানেই সহায়তা করবে না, জীববিজ্ঞানীদের অধিকতর আস্থার সাথে সহায়তা করবে প্রাকৃতিক পরিবেশে হামিংবার্ড পর্যবেক্ষণে, বাস্তবসম্মত রোবটের সেন্স ব্যবহার করে। আমরা এই রোবট নির্মাণে জীববিজ্ঞান থেকে শিক্ষা নিয়েছি। এখন জীববিজ্ঞান-সম্পর্কিত আবিষ্কার চলতে পারে এই রোবটের সাহায্যে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।