জুমবাংলা ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে মেডিকেল বা জরুরি ভিসা বাদে অন্য কোনো ভিসা দিচ্ছে না ভারত সরকার; এর মধ্যে আবার ৫ ভিসা আবেদন কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে কাজ চলায় মেডিকেল ভিসাপ্রত্যাশীদের অনেকে পাচ্ছেন না ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এতে বিভিন্ন জটিল রোগ নিয়ে ভারতে চিকিৎসা করাতে আগ্রহী রোগী ও স্বজনরা পড়েছেন বিড়ম্বনায়।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়লদহ বাসিন্দা আখতারি বানু ২০১৭ সাল থেকে চেন্নাইয়ের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ (সিএমসি) হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ওই হাসপাতালে চারটি অস্ত্রোপচার হয় তার। সর্বশেষ জুলাই মাসের শুরুতে তার সাইনাসের অপারেশন হয়।
তিন মাসের ফলোআপে ভারতে যেতে ২৫ অক্টোবর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন আখতারি বানু। কিন্তু ভিসা আবেদন জমা দিতেই পড়েছেন বিপত্তিতে। রাজশাহীর ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে অনলাইনে আবেদন করে ফি জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
একদিকে অপারেশনের জায়গায় সংক্রমণ হচ্ছে, অন্যদিকে ভিসা আবেদন জমা দিতে ব্যর্থতা- উপায়ন্তর না দেখে রাজশাহীতে ভারতের সহকারী হাই কমিশনারের কার্যালয়ে ছুটে যান আখতারি বানু। কিন্তু তাতেও ভিসা মেলেনি।
এই নারী বলেন, “অনেকবার চিকিৎসা করিয়েছি ওখানে। ভিসাও ঠিকঠাক পেয়েছি। কিন্তু এবার টাকাই জমা দিতে পারছি না।
“আমি ক্যান্সারের রোগী। তিন মাস আগে হয়েছে সাইনাস অপারেশন। তার আগে ওভারিতে আরেকটি অপারেশন হয়েছে। এখন সাইনাসের অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কী করব।”
এদিকে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর কারফিউ জারি হলে ১৮ জুলাই থেকে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হয়। এরপর দৈনিক ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রগুলো বন্ধ অব্যাহত থাকে।
গণআন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সরকার পতনের দুদিন পর এক ঘোষণায় ইন্ডিয়ান ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (আইভিএসি) জানায়, “অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত আইভিএসি বন্ধ থাকবে। পরবর্তী আবেদনের তারিখ এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হবে এবং পরবর্তী কার্যদিবসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।”
ওই মাসের মাঝামাঝি সময়ে সীমিত পরিসরে ভিসা আবেদনকেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। এরপর ১৬ অগাস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাণধীর জয়সওয়াল বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কেবল সীমিত পরিসরে জরুরি ও মেডিকেল ভিসা ইস্যু করবে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন।
এরপর পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে বিক্ষোভ দেখান ভিসাপ্রত্যাশীরা। এমন অবস্থায় নিরাপত্তার কারণে যমুনা ফিউচার পার্ক এবং সাতক্ষীরার ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৩ সেপ্টেম্বর শুধু পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার জন্য ১৬টির মধ্যে ১৩টি ভিসা আবেদনকেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, রংপুর এবং রাজশাহীর ভিসা আবেদনকেন্দ্র সীমিত পরিসরে কাজ শুরু করে।
২৯ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের এক খবরে বলা হয়, ‘বিক্ষোভ ও হাই কমিশনকে হুমকির’ কারণে এ সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ২০ হাজার পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছে হাই কমিশন।
এর মধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বর এক ঘোষণায় আইভিএসি জানায়, “ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও খুলনায় পাঁচটি স্থানে আইভিএসিগুলি জরুরি মেডিকেল এবং স্টুডেন্ট ভিসার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকদের সীমিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লট দেওয়া শুরু করেছে।
“এছাড়া, এই পাঁচটি আইভ্যাক (বা আইভিএসি) জরুরি ক্ষেত্রে সীমিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লটও খুলেছে, যেখানে বাংলাদেশি ছাত্র এবং কর্মীদের তৃতীয় দেশে যেতে হবে এবং যার জন্য তাদের ইতোমধ্যে ভারতে বিদেশি দূতাবাসে ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে।”
ওই ঘোষণায় বলা হয়, “পরবর্তী তারিখে আইভ্যাক তার স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু না করা পর্যন্ত এই পরিষেবাগুলো সীমিতই থাকবে।”
পরিষেবা সীমিত থাকার কারণে জরুরি মেডিকেল ভিসাপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের অনেকে প্রত্যাশিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছেন না। এ নিয়ে আখতারি বানুর মতো অনেক রোগী এবং তাদের স্বজনরা জটিলতায় পড়েছেন।
নিজের এমন অবস্থার মধ্যে বছরখানেক আগে বিয়ে হওয়া মেয়ের জামাইয়ের চিকিৎসাও যুক্ত হয়েছে রাজশাহীর আখতারি বানুর বিড়ম্বনায়।
বাংলাদেশে একটি অস্ত্রোপচারের পর বায়োপসি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তার জামাতার শরীরেও বেঁধেছে ক্যান্সার। তার দ্বিতীয় ধাপে থাকা ক্যান্সারের চিকিৎসাটাও ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল সেন্টার-সিএমসিতে করাতে চাচ্ছেন তিনি।
২৪ অক্টোবরে সিএমসিতে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ভিসা আবেদন করেও ফি জমা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না।
ভিসা আবেদনকারীরা বলছেন, অন্যান্য ক্যাটাগরিতে যাই হোক, ভারতে মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে কাগজপত্র আর হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক থাকলে সহজে ভিসা পাওয়া যায়। কিন্তু এখন মেডিকেল ভিসায়ও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
চিকিৎসা নিয়ে জটিলতার মধ্যে ভিসা সমস্যার সমাধান যেন দ্রুত হয়, সেই আকুতি জানাচ্ছেন আখতারি বানুর পরিবারের সদস্যরা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী তৃষা সামীরা ২০২৩ সালের মার্চ থেকে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছেন কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে।
তিন মাসের ফলোআপে অগাস্টে যাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-আন্দোলন ঘিরে পরিস্থিতির কারণে যাওয়া হয়নি। স্বল্প পরিসরে ভিসা প্রক্রিয়া চালুর পর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে আবেদনের কাজ শুরু করেন।
গত ১ অক্টোবর অনলাইনে আবেদন করে এখন তার সংগ্রাম ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার স্লট প্রাপ্তির; ১১ দিন চেষ্টা করেও কাঙ্ক্ষিত সূচি তিনি পাননি।
কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ার কথা তুলে ধরে তৃষা বলেন, “নিয়মিত চিকিৎসার মধ্যে থাকায় আম্মার লিভারে পানি জমেনি। কিন্তু এখন চিকিৎসা না হওয়ায় সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
বাংলাদেশে যে চিকিৎসককে দেখানো হত রোগীকে, সেই চিকিৎসককে না পাওয়ার কথা বলেন তৃষা। এক ধরনের চিকিৎসা থেকে সরে আরেকজনের চিকিৎসায় যাওয়া নিয়েও শঙ্কায় আছেন তিনি।
ব্যাংক কর্মকর্তা রোকসানা জুঁথির অ্যাম্পিউলারি ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার জুলাইতে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা কয়েকদিন ভালো থাকে তো কয়েকদিন খারাপ।
৫৮ বছর বয়সী বাবাকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য জুঁথি নিয়ে যেতে চান মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সে অনুযায়ী হাসপাতালের আমন্ত্রণপত্রও সংগ্রহ করেছেন।
কিন্তু সেপ্টেম্বরে স্বল্প পরিসরে ভিসা কার্যক্রম শুরুর পর অনলাইনে আবেদন করেও এখন পর্যন্ত আবেদনপত্র জমার সূচি পাচ্ছেন না।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এখন জুঁথির বাবা ঢাকার একটি হাসপাতালেই ভর্তি আছেন। অপেক্ষায় আছেন কখন মিলবে ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার শিডিউল।
ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার কথা তুলে ধরে জুঁথি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আবেদন করেছি কয়েকবার। আবেদনের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যায়, কিন্তু স্লট পাচ্ছি না।
“ওদিকে বাবা কিছুদিন বাইরে থাকেন, আবার শরীর খারাপ হয়; হাসপাতালে নেওয়া লাগে। বুঝতেছি না আসলে কী হবে।”
রোগীদের এই সঙ্কটের বিষয়ে কথা বলতে ভারতীয় হাই কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, তবে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
গত সেপ্টেম্বরের শেষে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বৈঠকে ভিসা জটিলতার প্রসঙ্গ আসে।
পরে উপদেষ্টা বলেছিলেন, “ভিসা নিয়ে একটু কথাবার্তা বলেছি। ভিসা যারা দিচ্ছেন, তাদের অনেকতো ভারতে চলে গেছেন। তাদের সুবিধাটা পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আমরা আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যে এটা চালু হয়ে যাবে। এখন শুধু স্বাস্থ্যবিষয়ক ভিসা দেওয়া হচ্ছে।
“খুব দ্রুত তারা ভিসা দেওয়া চালু করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, খুব বেশিদিন হয়ত সময় লাগবে না।”
ভারত সরকারের তথ্যের বরাতে দ্য প্রিন্টের ৩০ সেপ্টেম্বরের খবরে বলা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের জন্য প্রায় ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করেছিল ভারত। এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ ছিল মেডিকেল ভিসা।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৫ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের জন্য ৮ লাখ ভিসা ইস্যু করা হয়েছিল। যার মধ্যে মেডিকেল ভিসা ছিল ২ লাখ।
বিগত বছরগুলোতে পর্যটন ও ব্যবসার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। দেশে এখন সব ধরনের চিকিৎসার সুযোগ থাকার পরও ভারতের যাওয়ার এই প্রবণতা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে।
তবে যারা চিকিৎসার জন্য ভারতকে বেছে নেন, তারা বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের নিয়ে আস্থার সংকট এবং ভারতে তুলনামূলক কম খরচে ভালো সেবা পাওয়ার কথা বলেন।
সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।