ভোর চারটা। ফরিদপুরের ছোট্ট গ্রামে রাশেদা বেগমের কপালে হাত রাখতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ছোট ছেলে আরিফের কপাল জ্বলজ্বল করছে। ঘরে থার্মোমিটার নেই। দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলতে এখনো দেরি। একটু আগেও দুষ্টুমি করছিল শিশুটি, এখন নিস্তেজ, চোখে-মুখে এক অদ্ভুত অবসাদ। মায়ের বুকটা ধড়াস করে উঠল – “ওরে বাবা, এই করোনার সময় আবার জ্বর!” শুধু রাশেদা নন, রাজধানীর ব্যস্ত অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকা প্রবীণ আবুল কাশেম সাহেবও আজ ভোর থেকে গা ম্যাজম্যাজ করছেন, থার্মোমিটারে ১০১ ডিগ্রি দেখে মনে পড়ে গেল গত সপ্তাহে নাতির সর্দি-কাশি। জ্বর – এই ছোট্ট শব্দটিই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা ভয়, চিন্তা আর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে! কিন্তু জানেন কি, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপই পারে এই ভয়কে জয় করতে, অসুস্থতাকে জটিল হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণে আনতে। জ্বর হলে করণীয় বিষয়ে এই বিস্তৃত নির্দেশিকাটি আপনার ও আপনার প্রিয়জনের সুরক্ষার প্রথম সোপান হতে পারে। শুধু লক্ষণ চিনলেই হবে না, জানতে হবে কীভাবে ঘরোয়া যত্ন নেবেন, কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন, আর কোন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ছুটতে হবে – আসুন, প্রাণঘাতী ভুল এড়িয়ে জীবন বাঁচানোর এই জরুরি পাঠটি শুরু করি।
Table of Contents
জ্বর হলে করণীয়: আপনার জন্য জরুরি নির্দেশিকা (প্রথম ধাপ থেকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা)
জ্বর কোনো রোগ নয়, এটি শরীরের একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস বা অন্য কোনো সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেড়ে গেলেই আমরা জ্বর অনুভব করি। কিন্তু এই ‘প্রতিরক্ষা’ যখন অতিরিক্ত হয়ে ওঠে, বা যখন এর পেছনে লুকিয়ে থাকে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড বা কোভিড-১৯ এর মতো মারাত্মক কোনো কারণ, তখনই জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা জীবনরক্ষাকারী হয়ে দাঁড়ায়।
প্রাথমিক মূল্যায়ন ও ঘরোয়া পরিচর্যা (Home Care):
- তাপমাত্রা নির্ধারণ (The First Step is Measurement): সবার প্রথমে নিশ্চিত হোন যে জ্বর আসলেই আছে। হাত দিয়ে অনুমান নয়। একটি নির্ভরযোগ্য থার্মোমিটার ব্যবহার করুন। বগল (অ্যাক্সিলারি), মুখ (ওরাল) বা কান (টিমপ্যানিক) দিয়ে মাপুন। শিশুদের ক্ষেত্রে রেক্টাল থার্মোমিটার সবচেয়ে সঠিক ফল দেয় (ব্যবহারবিধি সঠিকভাবে মেনে চলুন)। মনে রাখুন:
- মুখে মাপা স্বাভাবিক তাপমাত্রা: প্রায় ৯৮.৬°F (৩৭°C)
- বগলে মাপা স্বাভাবিক তাপমাত্রা: প্রায় ৯৭.৬°F (৩৬.৪°C) – প্রায় ১°F (০.৫°C) কম হয়।
- জ্বর কখন বলে ধরা হয়? সাধারণত:
- প্রাপ্তবয়স্কদের মুখে মাপা ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি।
- শিশুদের রেক্টালে মাপা ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি।
- তাপমাত্রা লিখে রাখুন (সময় ও মান)। এটি ডাক্তারকে রোগের ধরণ বুঝতে সাহায্য করবে।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম (Rest is Non-Negotiable): জ্বর শরীরকে ক্লান্ত করে তোলে। অসুস্থ ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে উৎসাহিত করুন। কাজকর্ম, অফিস বা স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখুন। শরীরের শক্তি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় হওয়া দরকার।
- জলযোজন বজায় রাখা (Hydration: The Cornerstone of Fever Care): জ্বরে শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায় (ঘামের মাধ্যমে)। পানিশূন্যতা (Dehydration) জ্বরের লক্ষণকে খারাপ করতে পারে এবং জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই:
- প্রচুর পরিমাণে তরল দিন। পানি সবচেয়ে ভালো। এর পাশাপাশি ডাবের পানি, লেবুর রস, ফলের রস (প্রাকৃতিক, চিনি কম), স্যুপ (বিশেষ করে চিকেন স্যুপ), ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন (ওআরএস) দারুণ কার্যকর।
- শিশুদের ঘন ঘন বুকের দুধ বা ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে থাকুন।
- লক্ষ্য রাখুন প্রস্রাবের রঙের দিকে। হালকা হলুদ বা স্বচ্ছ হওয়া উচিত। গাঢ় হলুদ প্রস্রাব পানিশূন্যতার লক্ষণ।
- ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি, কোলা) এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন – এগুলো পানিশূন্যতা বাড়ায়।
- হালকা ও আরামদায়ক পোশাক (Dress for Comfort, Not for Sweating): ভুল ধারণা: গরম কাপড়ে জড়িয়ে ঘাম বের করলে জ্বর ছাড়বে। এটি বিপজ্জনক হতে পারে! এর ফলে শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে।
- হালকা, ঢিলেঢালা, সুতি কাপড় পরান।
- প্রয়োজনে একটি পাতলা চাদর ব্যবহার করুন।
- ঘরের পরিবেশ ঠাণ্ডা ও বাতাস চলাচলযুক্ত রাখুন। পাখা বা এসি ব্যবহার করুন (সরাসরি বাতাস রোগীর গায়ে না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন)।
- শরীর ঠাণ্ডা করার পদ্ধতি (Tepid Sponging – When and How): ওষুধ সেবনের পরেও তাপমাত্রা খুব বেশি (১০৪°F/৪০°C বা তার বেশি) থাকলে, বা ওষুধ খাওয়ানো সম্ভব না হলে (যেমন বমি করলে), শরীর স্পঞ্জ করে ঠাণ্ডা করা যেতে পারে। তবে সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি:
- কীভাবে করবেন? একটি পরিষ্কার নরম কাপড় বা স্পঞ্জ নরমাল লবণ-পানি বা সামান্য গরম পানিতে (কুসুম গরম) ভিজিয়ে নিন। খুব ঠাণ্ডা পানি বা বরফের পানি ব্যবহার করবেন না। এতে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে তাপ কমার বদলে আটকে যেতে পারে এবং কাঁপুনি শুরু হতে পারে।
- কোথায় করবেন? কপাল, বগল, কুঁচকি, হাত-পায়ের তালুতে এবং পিঠে আলতো করে মুছে দিন। এই জায়গাগুলোতে রক্তনালী ত্বকের কাছাকাছি থাকে, তাই তাপ দ্রুত ছড়ায়। পুরো শরীর মুছতে হবে না।
- কখন করবেন না? রোগীর কাঁপুনি থাকলে, ঠাণ্ডা লাগলে বা অস্বস্তি বোধ করলে এই পদ্ধতি বন্ধ করুন। কাঁপুনি শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে।
- ওটিসি জ্বর কমানোর ওষুধ (Over-the-Counter Medications – Use Wisely): প্যারাসিটামল (এসিটামিনোফেন) বা আইবুপ্রোফেন প্রাপ্তবয়স্ক এবং বড় শিশুদের জন্য সাধারণত নিরাপদ (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী)। তবে মনে রাখবেন:
- ডোজ: প্যাকেটের গায়ে লেখা ডোজ বা ডাক্তারের নির্দেশিত ডোজ মেনে চলুন। বেশি ডোজ লিভারের ক্ষতি (প্যারাসিটামলে) বা পাকস্থলীতে রক্তপাত (আইবুপ্রোফেনে) করতে পারে। শিশুদের জন্য বয়স ও ওজন অনুযায়ী সঠিক ডোজ নিশ্চিত করুন। কখনই শিশুকে অ্যাসপিরিন দেবেন না। রেয়েস সিনড্রোম নামক মারাত্মক অবস্থার ঝুঁকি থাকে।
- লক্ষ্য: ওষুধের লক্ষ্য রোগীকে আরাম দেওয়া, জ্বর পুরোপুরি নামিয়ে ফেলা নয়। তাপমাত্রা সামান্য কমলেও তা কার্যকর হয়েছে বলা যায় যদি রোগী কিছুটা সুস্থ বোধ করে।
- নিয়মিত বিরতি: জ্বর কমে গেলে বা রোগীর অবস্থা ভালো থাকলে ওষুধ বন্ধ রাখুন। শুধু জ্বরের জন্য ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
জ্বরের ধরন বুঝে নিন: সাধারণ, ডেঙ্গু না অন্য কিছু? (লক্ষণ বিশ্লেষণ ও ঝুঁকি নির্ণয়)
জ্বর আসলেই কি শুধু একটি সাধারণ সর্দি-কাশির অংশ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনও মারাত্মক রোগের সংকেত? জ্বর হলে করণীয় এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি হলো জ্বরের ধরন এবং অন্যান্য লক্ষণগুলো সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা। কারণ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড বা কোভিডের মতো রোগের প্রাথমিক লক্ষণও হতে পারে জ্বর।
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল রাখুন (Red Flags & Associated Symptoms):
- জ্বরের মাত্রা ও স্থায়িত্ব (High Grade & Prolonged):
- অত্যন্ত উচ্চ জ্বর (১০৪°F/৪০°C বা তার বেশি): এটি জরুরি অবস্থা নির্দেশ করতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী জ্বর: ২-৩ দিনের বেশি স্থায়ী হওয়া জ্বর, বিশেষ করে যদি ঘরোয়া পরিচর্যায়ও না কমে।
- ইন্টারমিটেন্ট বা রিমিটেন্ট জ্বর: বিশেষ করে ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ায় জ্বর চক্রাকারে আসে। ডেঙ্গুতে প্রায়ই ২-৭ দিন স্থায়ী হয়, ম্যালেরিয়ায় ৪৮ বা ৭২ ঘন্টা পরপর জ্বরের তীব্রতা বাড়তে পারে।
- গুরুতর সহযোগী লক্ষণ (Danger Signs): জ্বরের সাথে নিচের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে:
- তীব্র মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা: বিশেষ করে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ।
- অবিরাম বমি বা বমি বমি ভাব: যা খাওয়া-দাওয়া বা তরল গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
- পেটে তীব্র ব্যথা: বিশেষ করে ডান দিকের পাঁজরের নিচে (লিভার এলাকা, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের লক্ষণ হতে পারে)।
- শ্বাসকষ্ট বা দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস: নিউমোনিয়া, কোভিডের গুরুতর অবস্থা বা অন্য ফুসফুসজনিত সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
- বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা।
- খিঁচুনি (Convulsions/Seizures): বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে খুবই বিপজ্জনক।
- অতিরিক্ত দুর্বলতা, ঝিমুনি, বিভ্রান্তি বা অচেতন হওয়ার মতো আচরণ (Altered Mental Status): মস্তিষ্কে সংক্রমণ বা মারাত্মক পানিশূন্যতার লক্ষণ।
- ত্বকে র্যাশ (Skin Rash): বিশেষ করে লালচে ছোপছোপ দাগ (ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে সাধারণত জ্বর কমার সময় দেখা দেয়), ফুসকুড়ি, বা রক্তক্ষরণের চিহ্ন (পেটিকি – ছোট লাল-বেগুনি দাগ, নাক-মাড়ি দিয়ে রক্তপাত, কালো পায়খানা বা বমি – ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা ডিএসএস)।
- প্রস্রাব কমে যাওয়া বা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া।
- গলা ব্যথা, গিলতে কষ্ট বা ঘাড় শক্ত হয়ে আসা (Meningism): মেনিনজাইটিসের লক্ষণ হতে পারে।
- হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া বা রাতের ঘাম (Night Sweats): টিউবারকিউলোসিস (টিবি) বা অন্যান্য ক্রনিক সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন (When to Seek Medical Advice):
- শিশুদের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে ৩ মাসের কম বয়সী): যেকোনো মাত্রার জ্বরেই অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যান। নবজাতক ও ছোট শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এবং সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে পারে।
- শিশু (৩ মাস থেকে ২ বছর): জ্বর ১০০.৪°F (৩৮°C) বা তার বেশি হলে এবং:
- ২৪ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হলে।
- খাওয়া-দাওয়া কমে গেলে, অস্বাভাবিক কান্নাকাটি বা ঝিমুনি দেখা দিলে।
- র্যাশ, শ্বাসকষ্ট, বমি বা ডায়রিয়া থাকলে।
- বড় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক:
- জ্বর ১০৩°F (৩৯.৪°C) বা তার বেশি হলে।
- জ্বর ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হলে বা ঘরোয়া পরিচর্যায় না কমলে।
- উপরে উল্লিখিত যেকোনো একটি ‘গুরুতর সহযোগী লক্ষণ’ (রেড ফ্ল্যাগ) দেখা দিলে।
- দীর্ঘস্থায়ী রোগ (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, এইডস) থাকলে বা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ (স্টেরয়েড, কেমোথেরাপি) নিলে। এদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি এবং জ্বর গুরুতর হতে পারে।
- সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণ (বিশেষ করে ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা) করে থাকলে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা (Diagnostic Tests):
ডাক্তার লক্ষণ শুনে এবং শারীরিক পরীক্ষার পর প্রয়োজন মনে করলে কিছু টেস্ট লিখে দিতে পারেন। জ্বর হলে করণীয় এর অংশ হিসেবে নিজে থেকে টেস্ট করাতে যাওয়ার চেয়ে ডাক্তারের পরামর্শে টেস্ট করানোই উত্তম। সাধারণ টেস্টগুলোর মধ্যে আছে:
- সিবিসি (Complete Blood Count – CBC): সংক্রমণ (ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া), রক্তশূন্যতা বা প্লাটিলেট কাউন্ট কমে যাওয়া (ডেঙ্গুর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ) বোঝা যায়।
- সিআরপি (C-Reactive Protein) বা ইএসআর (Erythrocyte Sedimentation Rate): শরীরে প্রদাহের মাত্রা বোঝায়।
- ব্লাড কালচার (Blood Culture): রক্তে ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা এবং কোন অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে তা জানার জন্য।
- ইউরিন রুটিন (Urine Routine Examination) ও কালচার: ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন নির্ণয়ে।
- ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন/সেরোলজি (Dengue NS1 Antigen / Serology): ডেঙ্গু সন্দেহ হলে (বর্ষাকালে বিশেষভাবে প্রযোজ্য)।
- ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট টেস্ট (Malaria Parasite Test – MP): ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে (বিশেষ করে সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগ বা বিদেশ ভ্রমণ ইতিহাস থাকলে)।
- কোভিড-১৯ টেস্ট (COVID-19 Test – RAT/PCR): কোভিডের লক্ষণ থাকলে।
- চেস্ট এক্স-রে (Chest X-Ray): নিউমোনিয়া বা টিবি সন্দেহ হলে।
- অন্যান্য: নির্দিষ্ট সন্দেহ থাকলে টাইফয়েড টেস্ট (Widal, Typhidot), লিভার/কিডনি ফাংশন টেস্ট ইত্যাদি।
বিশেষ পরিস্থিতি ও গোষ্ঠীর জন্য জ্বর ব্যবস্থাপনা (শিশু, গর্ভবতী, প্রবীণ)
জ্বর হলে করণীয় এর নীতিমালা সাধারণত সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও, কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা ও ভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োজন হয়। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে দুর্বল বা জ্বরের জটিলতা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- শিশু ও নবজাতক (Infants and Children):
- অতিসতর্কতা: ৩ মাসের কম বয়সী শিশুর যেকোনো মাত্রার জ্বরই জরুরি। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। কোনোভাবেই অপেক্ষা করবেন না।
- ওষুধের ডোজ: প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন (৬ মাসের বেশি বয়সী) শিশুর ওজন অনুযায়ী সঠিক ডোজে দিতে হবে। বয়স অনুযায়ী ডোজ চার্ট দেখে নিন বা ডাক্তার/ফার্মাসিস্টকে জিজ্ঞাস করুন। শিশুকে কখনই অ্যাসপিরিন দেবেন না।
- পানিশূন্যতা: শিশুদের দ্রুত পানিশূন্যতা হয়। লক্ষণ: প্রস্রাব কম (২৪ ঘন্টায় ৩টির কম ভেজা ডায়পার), কান্নার সময় চোখে পানি না আসা, মুখ শুষ্ক, চোখ গর্তে ঢুকে যাওয়া, অতিরিক্ত ঝিমুনি বা বিরক্তি। ওআরএস (ORS) খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। খেতে না চাইলে চামচে বা ড্রপারে করে বারবার সামান্য পরিমাণে দিন। বমি করলেও কিছুক্ষণ পর আবার দেওয়া চেষ্টা করুন।
- খিঁচুনি (Febrile Seizures): কিছু শিশুর (সাধারণত ৬ মাস থেকে ৫ বছর) উচ্চ জ্বরের সাথে খিঁচুনি হতে পারে। ভয় পাবেন না। শিশুকে সাইডে কাত করে শুইয়ে দিন, আশেপাশে ধারালো বা শক্ত কিছু আছে কিনা সরিয়ে ফেলুন, শ্বাসনালী খোলা রাখুন। খিঁচুনি সাধারণত ১-২ মিনিটের মধ্যে থেমে যায়। থামার পর ডাক্তারের কাছে নিন। খিঁচুনি চলাকালীন মুখে কিছু দেবেন না বা জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করবেন না। দীর্ঘস্থায়ী (৫ মিনিটের বেশি) খিঁচুনি হলে জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করুন।
- লক্ষণ বোঝা: শিশু কথা বলে নিজের কষ্ট বুঝাতে পারে না। অস্বাভাবিক কান্না, অতিরিক্ত ঝিমুনি, খাওয়ায় অনীহা, শ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া, ত্বকের রঙের পরিবর্তন (ফ্যাকাশে বা নীলচে) – এসব লক্ষণ গুরুত্ব সহকারে নিন।
- গর্ভবতী মহিলা (Pregnant Women):
- ঝুঁকি: গর্ভাবস্থায় জ্বর (বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে উচ্চ তাপমাত্রা) ভ্রূণের বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে। গর্ভাবস্থায় ইমিউন সিস্টেম কিছুটা পরিবর্তিত থাকে, তাই সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
- ওষুধ নির্বাচন: গর্ভাবস্থায় জ্বরের ওষুধ নির্বাচনে সতর্কতা জরুরি। প্যারাসিটামল সাধারণত নিরাপদ (ডাক্তারের পরামর্শে)। আইবুপ্রোফেন বা ন্যাপ্রোক্সেনের মতো NSAIDs গর্ভাবস্থার দ্বিতীয়ার্ধে (বিশেষ করে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে) এড়িয়ে চলতে হবে, এগুলো ভ্রূণের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার গাইনোকোলজিস্ট বা ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
- কারণ নির্ণয়: গর্ভাবস্থায় জ্বরের কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। ইউটিআই, ভাইরাল ইনফেকশন বা অন্যান্য সংক্রমণ হতে পারে। দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।
- হাইড্রেশন ও বিশ্রাম: আরও বেশি গুরুত্বের সাথে পানিশূন্যতা রোধ করুন এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
- প্রবীণ ব্যক্তি (Elderly – ৬৫+ বছর):
- অস্বাভাবিক উপসর্গ: প্রবীণদের মধ্যে জ্বরের উপসর্গ স্পষ্ট নাও হতে পারে। স্বাভাবিক তাপমাত্রা বা সামান্য জ্বর নিয়েও গুরুতর সংক্রমণ থাকতে পারে। বিভ্রান্তি, ঝিমুনি, দুর্বলতা বা খাওয়ায় অনীহা প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
- জটিলতার উচ্চ ঝুঁকি: নিউমোনিয়া, ইউটিআই, ত্বকের সংক্রমণ (সেলুলাইটিস) বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন দ্রুত ছড়াতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী রোগ (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, কিডনি রোগ) থাকলে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রবীণদের মধ্যে বেশি দেখা দিতে পারে (পাকস্থলীর সমস্যা, কিডনি বা লিভারে প্রভাব)। ডাক্তারের নির্দেশনা সতর্কতার সাথে মেনে চলুন।
- পানিশূন্যতা: প্রবীণদের পানির পিপাসা কমে যায়, তাই জ্বরের সময় তাদের সচেতনভাবে বারবার তরল দিতে হবে। ওআরএস ভালো বিকল্প।
- দ্রুত চিকিৎসা: প্রবীণদের ক্ষেত্রে জ্বরকে কখনই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া: বর্ষায় জ্বরের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা
বাংলাদেশে, বিশেষ করে বর্ষাকালে (জুন থেকে অক্টোবর), জ্বরের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নামক দুটি মশাবাহিত রোগের কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে। এই রোগগুলো দ্রুত জটিল আকার ধারণ করতে পারে, তাই জ্বর হলে করণীয় তে এই দুটির জন্য আলাদা সতর্কতা জরুরি।
- ডেঙ্গু জ্বর (Dengue Fever):
- লক্ষণ: হঠাৎ খুব উচ্চ জ্বর (১০৪-১০৫°F), তীব্র মাথাব্যথা (বিশেষ করে চোখের পেছনে), পেশি ও হাড়ে ব্যথা (হাড়ভাঙ্গা জ্বর), শরীরে লাল র্যাশ (সাধারণত জ্বর কমার সময় ৩য়-৫ম দিনে দেখা দেয়), বমি বমি ভাব বা বমি, ক্ষুধামন্দা। গুরুতর রূপ (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার – DHF / ডেঙ্গু শক সিনড্রোম – DSS): জ্বর কমার পরপরই তীব্র পেটে ব্যথা (বিশেষ করে ডান পাঁজরের নিচে), অবিরাম বমি, দ্রুত শ্বাস, দুর্বলতা, অস্থিরতা, ঠাণ্ডা হাত-পা, ত্বকে রক্তক্ষরণের চিহ্ন (পেটিকি – ছোট লাল-বেগুনি দাগ, সহজে রক্তক্ষরণ), নাক-মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, কালো পায়খানা বা বমি, প্লাটিলেট কাউন্ট দ্রুত কমে যাওয়া (<১,০০,০০০/মিমি৩), প্লাজমা লিকেজ (শরীরের ভেতর তরল জমা – অ্যাসাইটিস, প্লুরাল ইফিউশন)।
- জ্বর হলে করণীয় (ডেঙ্গু সন্দেহে):
- প্রচুর তরল (পানি, ডাবের পানি, ওআরএস) পান করুন। পানিশূন্যতা রোধই প্রধান চিকিৎসা।
- শুধুমাত্র প্যারাসিটামল জ্বর ও ব্যথার জন্য ব্যবহার করুন। এসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন বা অন্যান্য NSAIDs একেবারেই নিষেধ। এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
- প্লাটিলেট কাউন্ট কমে গেলে বা গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আবশ্যক। স্যালাইন বা রক্তদানের প্রয়োজন হতে পারে।
- ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট (প্রথম ১-৫ দিনে) বা সেরোলজি টেস্ট (৪-৫ দিন পর) করান।
- মশারি টানিয়ে ঘুমান, ফুল হাতা জামা-প্যান্ট পরুন, মশা নিধনের ক্রিম ব্যবহার করুন যাতে অন্য মশা কামড় দিয়ে রোগ না ছড়ায়।
- ম্যালেরিয়া (Malaria):
- লক্ষণ: সাধারণত ঠাণ্ডা লাগা দিয়ে শুরু, তারপর প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে জ্বর চড়া (১০৪-১০৬°F), এরপর প্রচণ্ড ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া। এই চক্র (কোল্ড স্টেজ – হট স্টেজ – সুইটিং স্টেজ) ৪৮ ঘন্টা (পি. ভাইভ্যাক্স) বা ৭২ ঘন্টা (পি. ম্যালেরি) পরপর আসতে পারে। মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, দুর্বলতা। গুরুতর ম্যালেরিয়া (পি. ফ্যালসিপ্যারাম): জটিলতা (সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া – খিঁচুনি, অচেতনাবস্থা; রক্তস্বল্পতা, শ্বাসকষ্ট, কিডনি ফেইলিউর, হাইপোগ্লাইসেমিয়া)।
- জ্বর হলে করণীয় (ম্যালেরিয়া সন্দেহে – বিশেষ করে ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা থেকে ফেরার ১০-১৫ দিনের মধ্যে জ্বর এলে):
- দ্রুত ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট টেস্ট (ব্লাড ফর এমপি – Malaria Parasite Test) করান। দেরি করলে পি. ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়া মারাত্মক হতে পারে।
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ওষুধ সঠিক মাত্রায় ও সময় ধরে সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করুন।
- বিশ্রাম নিন ও পর্যাপ্ত তরল পান করুন।
- মশার কামড় থেকে বাঁচতে ব্যবস্থা নিন (মশারি, রিপেলেন্ট)।
জ্বর প্রতিরোধের উপায় ও দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যবিধি (Prevention is Better than Cure)
জ্বর হলে করণীয় জানার পাশাপাশি জ্বর ও এর অন্তর্নিহিত সংক্রমণ প্রতিরোধ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে অনেকটাই ঝুঁকি কমানো যায়:
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি (Personal Hygiene):
- হাত ধোয়া: সাবান-পানি দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে ঘন ঘন হাত ধোয়া (খাওয়ার আগে, টয়লেট ব্যবহারের পর, বাইরে থেকে ঘরে ঢোকার পর, নাক-মুখ স্পর্শ করার পর, অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর) সবচেয়ে কার্যকর উপায়। অ্যালকোহল-ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করুন।
- শ্বাসযন্ত্রের শিষ্টাচার (Respiratory Etiquette): হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু বা কনুই দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন। ব্যবহৃত টিস্যু ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিনে ফেলুন। হাত না ধুয়ে চোখ-নাক-মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলুন।
- পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা (Environmental Hygiene):
- মশা নিয়ন্ত্রণ (Mosquito Control): ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। বাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি (ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, পাত্র, ড্রাম, নালা ইত্যাদি) পরিষ্কার/উল্টে ফেলুন বা আবরিক্তা দিন। জানালা-দরজায় নেট লাগান। দিনে ও সন্ধ্যায় মশার কামড় থেকে বাঁচতে ফুল হাতা জামা-প্যান্ট পরুন, মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করুন। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
- বাসস্থান পরিষ্কার রাখা: নিয়মিত ঘরবাড়ি পরিষ্কার করুন, বিশেষ করে রান্নাঘর ও টয়লেট। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
- টিকাদান (Vaccination): অনেক সংক্রমণজনিত জ্বর প্রতিরোধযোগ্য:
- শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) মেনে চলুন (হাম, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, রোটাভাইরাস ইত্যাদি)।
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা (ফ্লু শট), নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়ার টিকা (বিশেষ করে প্রবীণ ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্তদের), কোভিড-১৯ বুস্টার ডোজ নিন।
- বিদেশ ভ্রমণের আগে প্রয়োজনীয় টিকা (যেমন ইয়েলো ফিভার, টাইফয়েড) সম্পর্কে জেনে নিন।
- সুস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন (Healthy Lifestyle):
- সুষম খাদ্যাভ্যাস: পুষ্টিকর খাবার (শাকসবজি, ফল, প্রোটিন, গোটা শস্য) খান। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে।
- পর্যাপ্ত পানি পান: সারাদিনে পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: দৈনিক ৭-৮ ঘন্টা গভীর ঘুম ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে।
- নিয়মিত ব্যায়াম: মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম (হাঁটা, সাইক্লিং, সাঁতার) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে। ধ্যান, যোগব্যায়াম, শখের কাজে মনোযোগ দিন।
- অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে (When Around Sick People):
- অসুস্থ ব্যক্তির খুব কাছাকাছি যাওয়া এড়িয়ে চলুন।
- তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র (গ্লাস, প্লেট, তোয়ালে) আলাদা করুন।
- অসুস্থ ব্যক্তিকে বাইরে না যেতে উৎসাহিত করুন (বিশেষ করে স্কুল-অফিস)।
জ্বর নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা ও সত্য (Myths vs. Facts)
জ্বর হলে করণীয় নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এসব ভুল ধারণা মেনে চললে অনেক সময় রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। আসুন কয়েকটি প্রচলিত ভুল ধারণা ও সত্য জেনে নিই:
- ভুল ধারণা ১: গরম কাপড়ে জড়িয়ে ঘাম বের করলে জ্বর ছাড়বে।
- সত্য: এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক! গরম কাপড়ে জড়িয়ে রাখলে শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে, এমনকি খিঁচুনিও হতে পারে। বরং হালকা পোশাক পরিয়ে ঘর ঠাণ্ডা রাখুন।
- ভুল ধারণা ২: জ্বর হলে গোসল করা যাবে না।
- সত্য: জ্বর হলে গোসল করা যাবে, বরং তা শরীর ঠাণ্ডা করতে সাহায্য করবে। তবে খুব ঠাণ্ডা পানিতে নয়, কুসুম গরম পানিতে গোসল করুন এবং গোসলের পর দ্রুত শুকিয়ে নিন যাতে ঠাণ্ডা না লাগে।
- ভুল ধারণা ৩: উচ্চ জ্বর মানেই মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে।
- সত্য: সাধারণত সংক্রমণের কারণে হওয়া জ্বরে (১০৫°F/৪০.৫°C এর নিচে) মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় না। তবে খিঁচুনি হলে সেটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। অতিরিক্ত উচ্চ তাপমাত্রা (হাইপারথার্মিয়া, যেমন হিট স্ট্রোকে) মারাত্মক হতে পারে।
- ভুল ধারণা ৪: সব জ্বরেই অ্যান্টিবায়োটিক দরকার।
- সত্য: বেশিরভাগ জ্বরই ভাইরাসজনিত, যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হয়। অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে ডায়রিয়া, ওষুধ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Antibiotic Resistance) তৈরি হতে পারে।
- ভুল ধারণা ৫: জ্বর কমানোর ওষুধ খেলে রোগ সেরে যায়।
- সত্য: জ্বর কমানোর ওষুধ (প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন) শুধু জ্বরের লক্ষণ কমায়, রোগের মূল কারণ (সংক্রমণ) দূর করে না। রোগের কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা (যেমন ভাইরাল হলে বিশ্রাম ও হাইড্রেশন, ব্যাকটেরিয়াল হলে অ্যান্টিবায়োটিক) প্রয়োজন।
- ভুল ধারণা ৬: ডেঙ্গু হলে পেঁপে পাতার রস খেলেই প্লাটিলেট বাড়বে।
- সত্য: পেঁপে পাতার রস খেলে প্লাটিলেট বাড়ে – এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ডেঙ্গুর একমাত্র কার্যকর চিকিৎসা হলো যথেষ্ট তরল গ্রহণ, বিশ্রাম এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে সাপোর্টিভ কেয়ার (স্যালাইন, রক্ত/প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন)। পেঁপে পাতার রস অনিয়ন্ত্রিতভাবে খেলে বরং পেটের সমস্যা হতে পারে।
জেনে রাখুন (FAQs)
জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর:
- প্রশ্ন: জ্বর কত হলে বিপজ্জনক?
- উত্তর: প্রাপ্তবয়স্কদের মুখে মাপা ১০৩°F (৩৯.৪°C) বা তার বেশি জ্বর বিপজ্জনক হতে পারে। তবে শুধু তাপমাত্রাই নয়, জ্বরের সাথে গুরুতর লক্ষণ (তীব্র মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বমি, খিঁচুনি, ত্বকে র্যাশ, পেটে ব্যথা, বিভ্রান্তি) থাকলেও তা জরুরি। ৩ মাসের কম বয়সী শিশুর যেকোনো মাত্রার জ্বরই (১০০.৪°F/৩৮°C বা তার বেশি – রেক্টাল) জরুরি অবস্থা।
- প্রশ্ন: জ্বর হলে কী খাওয়া উচিত?
- উত্তর: হালকা, সহজে হজম হয় এমন খাবার খান। স্যুপ (বিশেষ করে চিকেন স্যুপ), সুজি, খিচুড়ি, ভাত, সেদ্ধ সবজি, কলা, আপেলসস ভালো। ঝাল, ভারী, তৈলাক্ত বা ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রচুর তরল (পানি, ডাবের পানি, ওআরএস, লেবুর রস, স্যুপ) পান করা যাতে পানিশূন্যতা না হয়।
- প্রশ্ন: জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল নেওয়ার নিয়ম কী?
- উত্তর: প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারণত ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১ গ্রাম, প্রতি ৪-৬ ঘন্টা পর পর (দিনে সর্বোচ্চ ৪ গ্রামের বেশি নয়) নেওয়া যায়। শিশুদের জন্য ওজন অনুযায়ী ডোজ নিন (প্যাকেটের নির্দেশনা বা ডাক্তারের পরামর্শ মেনে)। ওষুধ খাওয়ার কমপক্ষে ৪-৬ ঘন্টা পার হওয়ার আগে আবার খাবেন না। লিভারের ক্ষতি হতে পারে। জ্বর কমে গেলে বা রোগী সুস্থ বোধ করলে ওষুধ বন্ধ রাখুন।
- প্রশ্ন: ডেঙ্গু জ্বর হলে কী করণীয়?
- উত্তর: প্রচুর তরল (ওআরএস, পানি, ডাবের পানি) পান করুন। শুধু প্যারাসিটামল জ্বর ও ব্যথার জন্য ব্যবহার করুন। এসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, ডিসপ্রিন একদম নিষিদ্ধ। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। প্লাটিলেট কাউন্ট ও অন্যান্য পরীক্ষা করান। গুরুতর লক্ষণ (তীব্র পেটে ব্যথা, অবিরাম বমি, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, রক্তক্ষরণের চিহ্ন) দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হোন। মশার কামড় থেকে নিজেকে ও অন্যকে রক্ষা করুন।
- প্রশ্ন: শিশুর জ্বর হলে খিঁচুনি হলে কী করব?
- উত্তর: ভয় পাবেন না। শিশুকে সাইডে কাত করে শুইয়ে দিন যাতে মুখের লালা বা বমি বেরিয়ে আসতে পারে। আশেপাশে ধারালো বা শক্ত কিছু সরিয়ে ফেলুন। শ্বাসনালী খোলা আছে কিনা নিশ্চিত করুন। জোর করে কিছু মুখে দেবেন না বা ধরে রাখার চেষ্টা করবেন না। খিঁচুনি সাধারণত ১-২ মিনিটে থামে। থামার পর দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিন। ৫ মিনিটের বেশি খিঁচুনি চললে বা শ্বাসকষ্ট হলে জরুরি বিভাগে কল করুন (৯৯৯ বা স্থানীয় জরুরি নম্বরে)।
- প্রশ্ন: জ্বর বারবার আসছে কেন? (Recurrent Fever)
- উত্তর: বারবার জ্বর আসার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে: সংক্রমণ পুরোপুরি সেরে না ওঠা (যেমন টিবি, ইউটিআই), নতুন সংক্রমণ, অটোইমিউন ডিজিজ (যেমন লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস), কিছু ক্যান্সার, বা ওষুধের প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘদিন ধরে বা বারবার জ্বর এলে দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান।
জ্বর শরীরের একটি সতর্কবার্তা, শত্রু নয়। এই নির্দেশিকায় আলোচিত জ্বর হলে করণীয় এর প্রতিটি ধাপ – সঠিক তাপমাত্রা মাপা থেকে শুরু করে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পানিশূন্যতা রোধ, সঠিক ওষুধের ব্যবহার, বিপজ্জনক লক্ষণ চিনে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া এবং বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী ও প্রবীণদের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন – মেনে চললেই আপনি এই প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়াকে সহজভাবে সামাল দিতে পারবেন। মনে রাখবেন, ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মৌসুমে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং কখনই অযথা আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিন। এই জ্ঞানই আপনার পরিবারের সদস্যদের অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষার প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। জ্বর হলে করণীয় সম্পর্কে এই জরুরি নির্দেশিকা আপনার প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন, সচেতনতা ছড়িয়ে দিন – কারণ একটি সঠিক সিদ্ধান্তই পারে একটি মূল্যবান জীবন বাঁচাতে। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।