জুমবাংলা ডেস্ক : বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ৫৮০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি চলমান রেখেছেন নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই। এবার ঈদে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি গরু জবাই করে মানুষকে কম দামে মাংস খাওয়ানোর ইচ্ছে রয়েছে তার। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে এমন উদ্যোগ নিয়েছে এ মাংস বিক্রেতা।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত উপজেলার নশিপুর ইউনিয়নের কদমতলী তিনমাথা স্ট্যান্ড মোড় এলাকায় কালু কসাইয়ের ‘গোশত ঘর’ নামক দোকানে ক্রেতাদের ভীড় চোখে পড়ে।
বিগত এক বছর ধরে অতি মুনাফালোভীদের ভীড়ে কম দামে মাংস বিক্রি করে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন কালু কসাই। যেখানে রমজানের আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন বাজারে গরুর মাংস ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায় কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়। সেখানে তিনি ৫৮০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করে সারাদেশে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন তিনি। টিসিবি কিংবা বেসরকারি কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, মানবিকতার এমন এক নজির গড়েছেন তিনি। সম্প্রতি বিষয়টি সংবাদ মাধ্যম, লোকমুখে এবং ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় এখন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ভিড় থাকছে তার দোকানে।
টিনের ছাপড়ার দোকানটি ছোট হলেও এই বিক্রেতার মনের উদারতা পৌঁছেছে অনন্য উচ্চতায়। দ্রব্যমূল্যের আগুনে পুড়তে থাকা মানুষের কাছে কম মূল্যে মাংস কিনতে পারায় প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যেন প্রশান্তির। কারণ কষ্ট করে ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করলে বাজার মূল্যের চেয়ে ১৪০ টাকা কমে মিলছে এক কেজি গরুর মাংস।
বগুড়া শহরের প্রাণ কেন্দ্র সাতমাথা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে কমদতলী মোড়। বাগবাড়ী সড়কের এই মোড় এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে কালু কসাইয়ের ‘গোশত ঘর’ হিসেবে। শহর থেকে ৩০ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় ছুটছেন ক্রেতারা। যাতায়াতে ৬০ টাকা খরচ হলেও বাজারের চেয়ে সাশ্রয় হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ক্রেতারা সকাল থেকেই মাংস কিনতে কালু কসাইয়ের দোকানে জড়ো হয়েছেন। দোকানে ৩টি গাছের গুড়িতে মাংস কাটা হচ্ছে। তবুও ক্রেতাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাংস পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ক্রেতাদের কেউ কেউ ৫ কেজি থেকে ১০ কেজি, কেউবা ২০ থেকে ৩০ কেজি মাংস কিনতে এসেছেন। অনেকে আবার ১ কেজি থেকে ২ কেজি মাংস কিনতে এসেছেন। ক্রেতাদের অধৈর্যপনায় অনেক সময় ক্রেতাদের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কালু কসাই ও তার সহযোগিদের।
স্থানীয়রা জানান, এরা আগে বাগবাড়ি বাজারে বসতো। কিছুদিন আগেও কালু কসাই ৫৫০ টাকা দরে মাংস বিক্রি করেছেন। হাটে গরুর দাম বেশি বলে এখন ৫৮০ টাকায় বিক্রি করছেন। চোখের সামনেই গরু জবাই করে এবং কেটে বিক্রি করে। কম দাম হওয়ায় বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ আসপাশের জেলাগুলো থেকে মাংস কিনতে এখানে ক্রেতারা ভীড় করেন। বাজারে মাংসের যা দাম তাতে গরীব মানুষদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কালু কসাই মাংসের দাম কম রাখায় গরিব মানুষ ৫০০ গ্রাম মাংসও কিনতে পারছে। বাজারে যেসময় মাংস ৬০০ টাকা কেজি ছিল তখনও তিনি কেজিতে ৫০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে কম রেখেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জন্য কিছুটা উপকার করতে পেরে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করেন দোকানের কর্মীরাও।
এদিকে দুরদূরান্ত থেকে আসা অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন মাংস কিনতে আসায় এলাকার মানুষ সঠিক সময়ে কালুর দোকান থেকে মাংস নিতে পারেন না। দূর-দূরান্তের মানুষ এলাকার অতিথি, এ জন্য তাদের আগে মাংস দিয়ে বিদায় করতে হয়। এলাকার যারা মাংস নিতে চান তারা আগেই বলে যান, পরে এসে মাংস নেন বলেও মন্তব্য এলাকাবাসির।
ক্রেতা সৌরভ খন্দকার, মুমিনুল হক, সাজ্জাদ হোসেন জানান, তারা তিন বন্ধু বগুড়া সদর উপজেলার খান্দার ও কৈইগাড়ি এলাকার বাসিন্দা। ব্যবসার কাজে অনেক আগে থেকেই এ সড়কটি প্রায় ব্যবহার করতে হয় তাদের। চলাফেরার সুবাদে তারা জানতে পারে এখানে কম দামে মাংস বিক্রি হয়। একারণে তারা তিন বন্ধু গত কয়েক মাস যাবত এখান থেকেই নিয়েমিতভাবে মাংস ক্রয় করছেন।
তারা বলেন, শহরের খান্দার, ফতেহ আলী বাজার, বাংলাদেশ ব্যংকের সামনেসহ বিভিন্ন স্থানে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায়। সেসব দোকানের তুলনায় কালু কসাইয়ের দোকানে মাংসের দাম অনেক কম। তবে এখানে কিছুদিন আগেও ৫৫০ টাকায় মাংস কিনেছেন তারা। সেই মাংস এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়। তবুও শহরের দোকানগুলো থেকে কম।
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলা থেকে মাংস কিনতে আসা জিল্লুর রহমান জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরে ৫৮০ টাকায় মাংস বিক্রির খবর জানতে পেরে প্রায় ৩৫-৪০ কিলোমিটার দুর থেকে তিনি মাংস কিনতে এসেছেন। ১০ কেজি মাংস কিনবেন বলে মনোস্থির করেছেন। অপেক্ষা করছি। ভিড় থাকায় এখনো মাংস পাননি।
নজরুল ইসলাম ওরফে কালু কসাই জানান, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আবু হোসেন স্নাতকে (সম্মান) পড়ার পাশাপাশি তার ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। আর ছোট ছেলে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। গত ১ বছর যাবত তিনি এই মোড়ে মাংস বিক্রি শুরু করেন। এরআগে তিনি উপজেলার বাগবাড়ী বাজারে মাংস বিক্রি করতেন। সেখানে খাজনা বাড়ানো নিয়ে ঝামেলার কারণে হাটে দোকান না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এই মোড়ে দোকান দিয়ে বসেন। হাট থেকে সরে আসার পরেই তিনি অল্প লাভে মাংস বিক্রি শুরু করেন। সে সময় হাটে মাংস বিক্রি হতো ৫৫০ টাকায় আর শহরে ৬০০ টাকায়। তখন তিনি ৫০০ টাকায় বিক্রি শুরু করেন। কম দামে বিক্রির কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে আস্তে আস্তে তার দোকানে ক্রেতা বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, এখন দিনে ৪ থেকে ৬টা পর্যন্ত গরু জবাই করছি। আমার এখানে মাংসের চাহিদা বেশি। দোকানের কোনো খরচ নেই। অন্য যেকোনো বাজারের দোকান হলে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এখানে সেই খরচ নেই। এছাড়া আমি তেমন লাভ করি না। ৪ থেকে ৫টা গরুর মাংস বিক্রি করলে প্রতিদিন আমার ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লাভ হয়। এর মধ্যে ৬ জন কর্মচারীকে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। আমার লাভ হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এ কারণে কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারছি বলেনও মন্তব্য করেন তিনি।
মাংসের কেজি কত টাকা হলে ব্যবসায়ীরা লাভে থাকবে জানতে চাইলে কসাই কালু বলেন, বর্তমান বাজারে ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা কেজি বিক্রি হলেই ব্যবসায়ীরা লাভ করতে পারবেন। এখন বাজারে যে দাম চলছে সেটা অতিরিক্ত বেশি। তারা অতিরিক্ত মুনাফার লোভ করছে। গরু প্রতি তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ করতে চায়। কিন্তু আমি চাই সবাই মাংস খেতে পারুক। কর্মচারীদের বেতন দিয়ে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা লাভ হলেই যথেষ্ট। যেখানে হাটের টোল কম, সেসব এলাকার কসাইরা চাইলেই কম দামে মাংস বিক্রি করতে পারেন। এতে হয়তো লাভ কম হবে, কিন্তু মানুষের উপকার হবে।
কমদামে মাংস বিক্রিতে নিষেধে কোনো চাপ আসছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কম দামে বিক্রি করায় মাংস সমিতি থেকে তার উপর কোনো চাপ নেই। তবে হাটের ইজারাদাররা চাপ সৃষ্টি করছে যেন আবার হাটে দোকান করি। তিনি প্রতি হাটে ৪ হাজার টাকা খাজনা দিয়ে দোকান করতে পারবে না বলে দিয়েছেন।
কালু কসাইয়ের বড় ছেলে আবু হোসেন জানান, স্নাতকে পড়াশোনার পাশাপাশি বাবাকে সহযোগিতা করেন তিনি। তাদের দোকানে যারা মাংস কিনে খাবে শুধু তাদের কাছেই মাংস বিক্রি কার হয়। কিন্তু কেউ কিনে নিয়ে ব্যবসা করবে তাদের কাছে মাংস বিক্রি করা হয় না। অন্যরা মাংস আলাদা করে বিক্রি করেন। কলিজা, ফুসফুস, মাথা, তেল এগুলোতো আলাদা করে বিক্রি করেন। সেগুলোর দাম তো মাংসের চেয়ে কম। আর তারা কলিজা, ফুসফুস, মাথা, তেল সব মিক্সিং করেই বিক্রি করেন। আর এ কারণে অতি লাভ ছাড়া একটু কমে বিক্রি করতে পারছেন।
তিনি বলেন, অন্য কসাইরা যেখান থেকে গরু কেনেন, সেখান থেকে তারাও কেনেন। তবে তাদের গরুর মধ্যে বকনা গরুর সংখ্যাই বেশি। এ কারণেই কিছুটা কমদামে বিক্রি করতে পারছেন।
গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আফতাবুজ্জামান-আল-ইমরান জানান, বাজার বা হাট এলাকার বাইরে কেউ কম লাভে মাংস বিক্রি করতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার কোনো ইজারাদার বা অন্য ব্যবসায়ীদের নেই। নজরুল ইসলাম কালু সততার সঙ্গে কম লাভে মাংস বিক্রি করলে উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।