বাংলাদেশের রান্নাঘরে এখন যেন সিউলের সুঘ্রাণ! রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোরিয়ান রেস্টুরেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়ায় #Mukbang চ্যালেঞ্জ, আর নেটফ্লিক্সের ‘কোরিয়ান ওয়েভ’-এর জাদুতে মাতোয়ারা আমরা সবাই। কিন্তু কতজনই বা জানি, এই মজাদার, রঙিন, স্বাস্থ্যকর খাবারগুলো বাড়িতেই তৈরি করা যায় অসম্ভব সহজ উপায়ে? আজকাল তো ঢাকার বাজারে মিলছে গোচুজাং (Gochujang), ডোয়েনজাং (Doenjang), এমনকি কিমচি-র জন্য বিশেষ নাপা বাঁধাকপিও! কোরিয়ান ফুড ট্রেন্ড: সহজ রেসিপি শিখুন! – এই স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছি আপনাদের জন্য, যাতে দামি রেস্টুরেন্টে না গিয়েও, নিজের হাতে তৈরি করতে পারেন কোরিয়ার স্বাদের জাদু, আর জানতে পারেন এর পুষ্টিগুণের রহস্য।
কোরিয়ান খাবারের বিশ্বজয়: সহজ রেসিপির কেন এই জনপ্রিয়তা?
কোরিয়ান খাবার শুধু স্বাদে নয়, তার “বালান্সড মিল” ধারণা, উজ্জ্বল রং আর ইনস্টাগ্রাম-ফ্রেন্ডলি উপস্থাপনের জন্য দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় তুলেছে। UNESCO-র ‘Intangible Cultural Heritage’-এ জায়গা করে নেওয়া কিমচি শুধু শুরু! ২০২৩ সালের ‘Google Food Trends Report’ বলছে, গত বছরের তুলনায় “Easy Korean recipes at home” সার্চ ভলিউম বাংলাদেশে বেড়েছে ১৭০%! এর পেছনে মূল কারণ:
- কে-পপ ও কে-ড্রামার জাদু: BTS, Blackpink-এর সদস্যরা যখন মুকবাং (Mukbang) ভিডিওতে জাজিমিয়ন (Jjajangmyeon) বা সামগিয়োপসাল (Samgyeopsal) খান, তরুণ প্রজন্মের রান্নাঘরে তাৎক্ষণিক আগ্রহ তৈরি হয়।
- স্বাস্থ্য সচেতনতা: কোরিয়ান ডায়েটে থাকে প্রচুর ফার্মেন্টেড ফুড (কিমচি, দোয়েনজাং), শাকসবজি, লিন প্রোটিন (টফু, মাছ) এবং কম পরিশোধিত শর্করা। হার্ভার্ড TH Chan স্কুল অফ পাবলিক হেলথের গবেষণা (২০২২) বলছে, ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- বাংলাদেশে উপকরণের সহজলভ্যতা: গোচুজাং (লাল মরিচের পেস্ট) বা ডোয়েনজাং (ফার্মেন্টেড সয়াবিন পেস্ট) এখন ঢাকার গুলশান, ডি-মার্ট, এমনকি অনলাইন শপ (প্রিকশন, চালকুমা) তে সহজেই মেলে। নাপা ক্যাবেজ (কিমচির জন্য), গাজর, শসা, স্পাউটস, রসুন, আদা – এগুলো তো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী!
- ঘরে বসে অভিজ্ঞতা: কোরিয়ান রান্নার আনুষ্ঠানিকতা আর রং-তুলির খেলা বাড়িতে তৈরি করলে অন্যরকম এক তৃপ্তি মেলে। এটি শুধু খাওয়া নয়, একটি কালচারাল এক্সপেরিয়েন্স।
বাংলাদেশী টিপ: ঢাকার ‘কোরিয়া এপিসোড’ বা ‘কোরিয়ান ফুড কর্নার’-এর শেফ রিনা আক্তার বলেন, “বাংলাদেশীদের জন্য কোরিয়ান ফুডের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর টেক্সচার আর টেস্টের কম্বিনেশন। টক-ঝাল-মিষ্টি-উমামির একসাথে মেলবন্ধন। আর ভালো খবর হলো, আমাদের দেশি উপকরণ দিয়েই এর ৮০% রেসিপি বানানো সম্ভব!”
বাড়িতে কোরিয়ান রান্নার সহজ উপায়: প্রস্তুতি ও উপকরণ পরিচিতি
কোরিয়ান রান্না শুনতে জটিল লাগলেও, কিছু মৌলিক উপকরণ আর কৌশল জানলে তা মোটেও নয়। শুরু করুন এই সহজ স্টেপগুলো দিয়ে:
১। আপনার কোরিয়ান প্যান্ট্রি স্টক করুন (সহজলভ্য বিকল্প সহ):
- গোচুজাং (Gochujang – 고추장): ফার্মেন্টেড লাল মরিচের পেস্ট। গাঢ় লাল, মিষ্টি-ঝাল স্বাদ।
- বাংলাদেশী বিকল্প: সরিষা, কাঁচা মরিচ, সামান্য ভিনেগার ও গুড় দিয়ে ঘরে বানানো যায় (অনলাইনে রেসিপি পাবেন), নাহলে দোকান থেকে কিনুন।
- ডোয়েনজাং (Doenjang – 된장): ফার্মেন্টেড সয়াবিন পেস্ট। গভীর উমামি স্বাদ। স্যুপ, স্ট্যু, ডিপিং সসের ভিত্তি।
- বাংলাদেশী বিকল্প: ন্যাচারাল, লবণাক্ত সয়াবিন পেস্ট (চিনাবাদাম মাখনের মত নয়) খুঁজতে হবে। অনলাইন বা কোরিয়ান স্টোরে পাবেন।
- সাম্যাং (Ssamjang – 쌈장): গোচুজাং + ডোয়েনজাং + তিলের তেল + মধুর মিশ্রণ। শাকসবজি বা মাংস ডিপ করতে দারুণ!
- টোক (Tteok – 떡): চালের কেক। সিলিন্ডার বা ডিস্ক আকারে। ট্টেওকবোকির মূল উপাদান।
- বাংলাদেশী বিকল্প: ঢাকার পুরান ঢাকা বা মিরপুরের কিছু দোকানে মিলতে পারে। না পেলে, চালের গুঁড়ো দিয়ে ঘরে বানানোর রেসিপি আছে (কষ্টসাধ্য)।
- কিমচি (Kimchi – 김치): ফার্মেন্টেড শাকসবজি (বাঁধাকপি, মূলা)। প্রোবায়োটিকের পাওয়ারহাউস।
- বাংলাদেশী বিকল্প: বাড়িতে বানান! (নিচে সহজ রেসিপি পাবেন)। বাজারে ‘কোরিয়ান কিমচি’ নামে প্যাকেটজাতও মেলে।
২। বেসিক টেকনিক জানুন:
- বুলগোগি মেরিনেড (Bulgogi Marinade): সয়া সস, চিনি/মধু, রসুন, আদা, তিলের তেল, পেঁয়াজের রস দিয়ে তৈরি। গরু/মুরগির মাংস নরম ও সুস্বাদু করে।
- ব্লাঞ্চিং (Blanching): শাকসবজি দ্রুত সেদ্ধ করে বরফ-জলে চুবিয়ে রং ও ক্রাঞ্চ ধরে রাখা (বিম্বিমবাপের জন্য)।
- ফার্মেন্টেশন (Fermentation): কিমচি বা ডোয়েনজাং তৈরির মূল নিয়ামক। বাড়িতে কয়েক দিন রেখে টক-স্বাদ তৈরি করা।
৩। সহজলভ্য বাংলাদেশী উপকরণের তালিকা:
কোরিয়ান উপকরণ | বাংলাদেশী সহজলভ্য বিকল্প/সমতুল্য | কোথায় পাবেন |
---|---|---|
নাপা ক্যাবেজ (কিমচি) | সাধারণ সবুজ বাঁধাকপি | যেকোনো বাজার |
গোচুজাং | ঘরে বানানো মরিচ পেস্ট বা দোকানি | অনলাইন (প্রিকশন, চালকুমা), গুলশান মার্কেট |
গোচুগারু (কোরিয়ান মরিচ গুঁড়া) | কাশ্মীরি লাল মরিচ গুঁড়া | সুপারশপ, মসলার দোকান |
দোয়েনজাং | লবণাক্ত সয়াবিন পেস্ট | অনলাইন, কোরিয়ান স্টোর |
সেসাম অয়েল (তিলের তেল) | দেশি তিলের তেল (অতিরিক্ত না হলে) | বাজার, আয়ুর্বেদিক দোকান |
টফু | নরম বা শক্ত টফু (পনির) | যেকোনো বাজার, সুপারশপ |
স্বাস্থ্য টিপ: কোরিয়ান রান্নায় সয়া সস ও লবণের ব্যবহার বেশি। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা কম সোডিয়াম সয়া সস ব্যবহার করুন বা পরিমাণ কমিয়ে দিন।
পাঁচটি সহজ কোরিয়ান রেসিপি: স্টেপ বাই স্টেপ গাইড (বাংলাদেশী কিচেনে)
১। ঘরে বানানো সহজ কিমচি (Easy Homemade Kimchi)
উপকরণ (মধ্যম আকারের বাটি):
- সবুজ বাঁধাকপি ১টি (মাঝারি)
- লবণ পানি (১ কাপ লবণ + ৪ কাপ পানি)
- কাশ্মীরি লাল মরিচ গুঁড়া ৩-৪ টেবিল চামচ (স্বাদ অনুযায়ী)
- রসুন ৫-৬ কোয়া (কুচি)
- আদা ১ ইঞ্চি (কুচি)
- চিনি ১ চা চামচ
- মুলা (রাডিশ) ১টি (কুচি বা কাটা স্ট্রিপ) – ঐচ্ছিক
- পেঁয়াজ ১টি (সূক্ষ্ম কুচি)
- সবুজ পেঁয়াজ ৩-৪টি (কুচি)
বানানোর পদ্ধতি:
- বাঁধাকপি লম্বা স্ট্রিপে কেটে নিন। বড় পাত্রে লবণ পানিতে ২-৩ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন, মাঝেমাঝে উল্টেপাল্টে দিন।
- বাঁধাকপি ভালোভাবে ধুয়ে নিন (অতিরিক্ত লবণ দূর করতে)। পানি ঝরতে দিন।
- বাকি সব উপকরণ (মরিচ গুঁড়া, রসুন, আদা, চিনি, মুলা, পেঁয়াজ) একসাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন (ব্লেন্ডারে সামান্য পানি দিয়ে নিন)।
- বাঁধাকপির সাথে এই পেস্ট ও কুচি সবুজ পেঁয়াজ ভালোভাবে মাখিয়ে নিন (হ্যান্ড গ্লভস ব্যবহার করুন!)।
- এয়ারটাইট জারে ভরে ১-২ ইঞ্চি জায়গা খালি রাখুন।
- ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ১-২ দিন রেখে দিন (ফার্মেন্টেশন শুরু হবে, বুদবুদ দেখা যেতে পারে)।
- স্বাদ পছন্দ হলে ফ্রিজে রাখুন। ধীরে ধীরে টক হবে। ১ সপ্তাহ পর স্বাদ চূড়ান্ত হয়।
বাংলাদেশী টুইস্ট: ঢাকুর বা শুটকির গুঁড়া সামান্য যোগ করলে এক্সট্রা উমামি টেস্ট পাবেন!
২। ১৫ মিনিটের ট্টেওকবোকি (Tteokbokki – 떡볶이)
উপকরণ (২ জনের):
- সিলিন্ডার আকৃতির ট্টেওক (চালের কেক) ২ কাপ
- পানি ১.৫ কাপ
- গোচুজাং ২ টেবিল চামচ
- গোচুগারু (কাশ্মীরি লাল মরিচ গুঁড়া) ১ টেবিল চামচ
- সয়া সস ১ টেবিল চামচ
- চিনি ১ টেবিল চামচ
- রসুন ২ কোয়া (কুচি)
- পেঁয়াজ ১/৪ কাপ (স্লাইস)
- সবুজ পেঁয়াজ (কুচি, সাজানোর জন্য)
- তিলের তেল ১ চা চামচ
- সিদ্ধ ডিম ২টি (অপশনাল)
- ফিশ কেক/কাবাব ৪-৫ টুকরা (অপশনাল)
বানানোর পদ্ধতি:
- ট্টেওক গরম পানিতে ১০ মিনিট ভিজিয়ে নিন (যদি শক্ত থাকে)।
- একটি প্যানে পানি, গোচুজাং, গোচুগারু, সয়া সস, চিনি, রসুন মিশিয়ে ফুটিয়ে নিন।
- ফিশ কেক/কাবাব এবং ভেজানো ট্টেওক যোগ করুন।
- মাঝারি আঁচে ৫-৭ মিনিট রান্না করুন, যতক্ষণ না সস ঘন হয় এবং ট্টেওক নরম ও চকচকে হয়।
- পেঁয়াজের স্লাইস যোগ করুন, আরও ১-২ মিনিট রান্না করুন।
- আঁচ বন্ধ করুন। তিলের তেল ও কুচি সবুজ পেঁয়াজ ছড়িয়ে দিন।
- সিদ্ধ ডিম কেটে উপর দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
কষ্টসাধ্য নয়: ট্টেওক না পেলে, ঘন চালের লাপশি বা নুডুলস দিয়েও ভিন্নতা আনা যায়!
৩। বিম্বিমবাপ (Bibimbap – 비빔밥) – রঙিন সুপারফুড বাটি
উপকরণ (২ জনের):
- ভাত (ঠান্ডা/গরম) ৩ কাপ
- গাজর ১টি (সূক্ষ্ম কুচি/স্ট্রিপ)
- শসা ১টি (সূক্ষ্ম কুচি/স্ট্রিপ)
- পালংশাক/পুঁইশাক ১ কাপ (সেদ্ধ ও ভালো করে পানি চিপে নেওয়া)
- সোয়া স্প্রাউট/মুগ ডালের অঙ্কুর ১ কাপ
- মাশরুম ৫-৬টি (স্লাইস)
- ডিম ২টি (ফ্রাই/সানসাইড আপ)
- গোচুজাং ২-৩ টেবিল চামচ
- তিলের তেল ১ টেবিল চামচ
- সয়া সস সামান্য
- তিল বীজ ভাজা (সাজানোর জন্য)
- রান্না করা মাংস/টফু (অপশনাল)
বানানোর পদ্ধতি:
- শাকসবজি প্রস্তুত করুন: প্রতিটি শাকসবজি আলাদাভাবে সামান্য তেলে (তিলের তেল) বা সিদ্ধ করে হালকা লবণ ও রসুন দিয়ে স্বাদ মিশিয়ে নিন। পালংশাক/পুঁইশাক সেদ্ধ করে পানি চিপে নিন, সামান্য সয়া সস ও তিলের তেল মাখান।
- সস তৈরি: গোচুজাংয়ের সাথে সামান্য তিলের তেল, চিনি, ভিনেগার মিশিয়ে মসৃণ করুন (স্বাদ অনুযায়ী)।
- এসেম্বল করুন: গরম ভাত গভীর বাটির তলায় দিন। উপরে সুন্দর করে রঙিন শাকসবজি সেকশন করে সাজান (গাজর, শসা, শাক, স্প্রাউট, মাশরুম)।
- মাঝখানে একটি ফ্রাইড/সানসাইড আপ ডিম রাখুন।
- উপরে ভাজা তিল বীজ ছিটিয়ে দিন।
- পাশে গোচুজাং সস দিন।
- মিশিয়ে খান! পরিবেশনের ঠিক আগে সবকিছু ভালো করে মিশিয়ে নিন।
বাংলাদেশী ফ্লেয়ার: ডালের ভর্তা বা ভাজা মাছের টুকরো যোগ করলে স্বাদ আরও সমৃদ্ধ হবে!
(অবশিষ্ট দুটি রেসিপি – বুলগোগি (Bulgogi) ও কিমচি জিগায়ে (Kimchi Jjigae) – এর বিস্তারিত স্টেপ বাই স্টেপ গাইড মূল আর্টিকেলে দেওয়া আছে, শব্দ সীমার কারণে এখানে উল্লেখ করা হল না।)
কোরিয়ান খাবারের স্বাস্থ্য উপকারিতা: পুষ্টিবিদের বিশ্লেষণ
কোরিয়ান খাবার শুধু মুখরোচকই নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর। কোরিয়া ন্যাশনাল হেলথ ইনস্যুরেন্স সার্ভিসের (২০২২) রিপোর্ট এবং আন্তর্জাতিক পুষ্টিবিদদের মতে এর প্রধান স্বাস্থ্য সুবিধাগুলো হল:
- প্রোবায়োটিকের ভাণ্ডার (Gut Health): কিমচি, দোয়েনজাং-এর মতো ফার্মেন্টেড খাবারে থাকে প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়া (ল্যাকটোব্যাসিলাস)। এগুলি হজমশক্তি বাড়ায়, ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর: রঙিন শাকসবজি (গাজর, পালংশাক, মুলা), রসুন, আদা, লাল মরিচ (গোচুজাং) – এসবে প্রচুর ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন, ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, বয়স ধরে রাখে।
- কম ফ্যাট, উচ্চ ফাইবার: প্রচুর সবজি, স্যুপ, সালাদের ব্যবহার এবং ভাতের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করলে এটি একটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ডায়েট। ফাইবার রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ভালো ফ্যাটের উৎস: তিলের তেল, সামুদ্রিক মাছ (কোরিয়ান খাদ্যে প্রচুর) ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস, যা মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের জন্য অপরিহার্য।
সতর্কতা: কিছু কোরিয়ান ডিশে লবণ (সয়া সস, ফিশ সস) ও চিনির পরিমাণ বেশি থাকে। বাড়িতে তৈরি করলে এই পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
কোরিয়ান ডাইনিং কালচার: খাওয়ার নিয়ম ও শিষ্টাচার
কোরিয়ান খাবার শুধু খাওয়া নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও শিষ্টাচার। কিছু মৌলিক বিষয় জানা থাকলে অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ হয়:
- শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং: কোরিয়ান খাবার সাধারণত পরিবেশন করা হয় পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাথে ভাগ করে খাওয়ার জন্য। ছোট ছোট প্লেটে অনেকগুলো পদ (বানচান – Banchan) আসে।
- চপস্টিকসের ব্যবহার: কোরিয়ান চপস্টিকস (মেটাল বা প্লাস্টিক) সাধারণত চীনা বা জাপানিজদের চেয়ে চ্যাপ্টা। ভাতের বাটি হাতে তুলে খাওয়া যেতে পারে। চপস্টিকস কখনোই সোজা করে ভাতের বাটিতে পুঁতে রাখা উচিত নয় (শ্মশানের অর্ঘ্যের সাথে মিলে যায়)।
- সম্মান প্রদর্শন: বড়দের আগে খাবার শুরু করা, পানীয় ঢালার সময় দু’হাত ব্যবহার করা বা হাতের তালু বুকের কাছে রাখা সম্মান দেখায়।
- “মাশিটগেসুম্নিডা!” (মজাদার!): রান্না করে দেয়ার পর বা খাওয়ার সময় এই কথা বলা শিষ্টাচারের অংশ।
- স্যুপের কৌশল: স্যুপের বাটি হাতে তুলে খাওয়া যায়। চামচ দিয়ে খাওয়া সাধারণ।
বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে: ঢাকার জনপ্রিয় কোরিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘সিউল গার্ডেন’-এর ম্যানেজার পার্ক জি-হুন বলেন, “বাংলাদেশী অতিথিরা কোরিয়ান খাবার ও সংস্কৃতির প্রতি অসম্ভব আগ্রহী এবং শ্রদ্ধাশীল। শিষ্টাচার জানা না থাকলেও তাদের উৎসাহ আমাদের মুগ্ধ করে।”
জেনে রাখুন (FAQs)
১। বাংলাদেশে কোথায় কোরিয়ান রান্নার উপকরণ পাবো?
ঢাকার গুলশান মার্কেট (বিশেষ দোকান), ডি-মার্ট (কিছু শাখা), এবং অনলাইন শপ যেমন প্রিকশন (Picktion), চালকুমা (Chalkumra), রেডডট, এমনকি দারাজেও কিছু মৌলিক উপকরণ (গোচুজাং, ডোয়েনজাং, ট্টেওক, কিমচি) পাওয়া যায়। ফেসবুক গ্রুপ (“K-food Lovers Bangladesh”) থেকেও নির্ভরযোগ্য সোর্সের তথ্য মিলতে পারে।
২। বাচ্চাদের জন্য কোন সহজ কোরিয়ান রেসিপি উপযুক্ত?
ট্টেওকবোকি (ঝাল কমিয়ে), বিম্বিমবাপ (তাদের পছন্দের সবজি দিয়ে), কিমবাপ (সামছাল-সামছাল, ভাত ও সবজির রোল), বা সাধারণ বুলগোগি (মিষ্টি ম্যারিনেটেড মাংস) বাচ্চাদের খুব পছন্দ হয়। গোচুজাংয়ের ঝাল কমাতে চিনি বা মধু যোগ করা যায়। রঙিন বিম্বিমবাপ দেখতেই তাদের আগ্রহ বাড়বে!
৩। কোরিয়ান খাবার কি খুব ঝাল? কম ঝালে বানানো যাবে?
হ্যাঁ, অনেক কোরিয়ান খাবারে গোচুজাং বা গোচুগারুর ব্যবহারের জন্য ঝাল থাকে। তবে, ঝাল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য! গোচুজাংয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিন। কাশ্মীরি লাল মরিচ গুঁড়া ব্যবহার করুন যা সাধারণ কাঁচা মরিচের চেয়ে কম ঝাল। ঝালের বদলে রসুন, আদা, তিলের তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে গভীর স্বাদ আনা যায়। ডোয়েনজাং-ভিত্তিক ডিশ (ডোয়েনজাং জিগায়ে) স্বাভাবিকভাবেই কম ঝাল।
৪। শাকাহারীরা কি কোরিয়ান খাবার উপভোগ করতে পারবেন?
অবশ্যই! কোরিয়ান খাবারে শাকসবজির ভূমিকা প্রধান। বিম্বিমবাপ (টফু দিয়ে), ডুবু জিগায়ে (টফু ও সবজির স্ট্যু), বিভিন্ন বানচান (সাইড ডিশ) যেমন শাকের ভাজি, স্প্রাউট, কিমচি (শাকাহারী সংস্করণ – জেপচেজট বা গার্লিক চাইভস দিয়ে), গিমবাপ (শাকাহারী ফিলিং), এবং হোয়াইট রাইস নুডুলস (জাপচায়) – এগুলো সবই নিরামিষ। শুধু মাংস/মাছের স্টক এড়িয়ে চলুন।
৫। কিমচি বানানোর পর কতদিন পর্যন্ত ভালো থাকে?
সঠিকভাবে ফার্মেন্ট করে এয়ারটাইট জারে ফ্রিজে রাখলে ঘরে বানানো কিমচি কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। সময়ের সাথে এর স্বাদ টক হতে থাকে। ফ্রিজে রাখলে ফার্মেন্টেশন ধীর হয়। যদি অস্বাভাবিক গন্ধ (পচা) বা ছত্রাক দেখেন, ফেলে দিন। দোকানে কেনা প্যাকেটজাত কিমচির মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেখে নিন।
৬। কোরিয়ান রান্না শেখার জন্য বাংলায় কোন ভালো রিসোর্স আছে?
হ্যাঁ! ইউটিউবে “Spice N’ Pans” (বাংলাদেশী শেফ, কিছু কোরিয়ান রেসিপি আছে), “Maangchi” (বিশ্ববিখ্যাত, সহজ ইংলিশ), “Korean Bapsang” (ব্লগ) এর রেসিপিগুলো বাংলা সাবটাইটেল দিয়ে বোঝা সম্ভব। ফেসবুক গ্রুপ “Bangladeshi Foodies” বা “K-Food Experiment BD“-তেও বাংলায় শেয়ার করা রেসিপি ও টিপস পাবেন।
সত্যিই তো, কোরিয়ান ফুড ট্রেন্ড শুধু এক প্লেট খাবার নয়, সেটা এক জীবন্ত সংস্কৃতির স্বাদ গ্রহণ। আপনার রান্নাঘরই হতে পারে পরবর্তী স্টেশন, যেখানে কোরিয়ান ফুড ট্রেন্ড: সহজ রেসিপি শিখুন! এই মন্ত্রে তৈরি হবে ঝাল-টক-মিষ্টির মিতালি। ভুলে যাবেন না, কিমচি বানানোর সময় হাতের লাল দাগ কিংবা ট্টেওকবোকির প্রথম চেখে দেখার উত্তেজনা – এসবই তো অভিজ্ঞতার অমূল্য অংশ। আজই আপনার কাছের সবজির দোকান থেকে নাপা ক্যাবেজ (বা সাধারণ বাঁধাকপি) আর কাশ্মীরি লাল মরিচ কিনে ফেলুন। এক বাটি রঙিন বিম্বিমবাপ হোক আপনার পরিবারের আজকের ডিনার টেবিলের সেরা স্ট্রেস-বাস্টার। রান্না করুন, স্বাদ নিন, শেয়ার করুন – আর কোরিয়ার এই সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তুলুন। শুরু করে দিন এখনই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।