বাংলাদেশ-নেপালের পর এবার জেন জি ঝড় বইতে শুরু করেছে ভারতেও। চীন সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চল লাদাখে ফুঁসে ওঠা এ বিক্ষোভ ভয়াবহ রক্তপাতের জন্ম দিয়েছে ইতোমধ্যে।

সাংবিধানিক সুরক্ষা ও রাজ্য মর্যাদার দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত চারজনের প্রাণ গেছে। এরই মধ্যে সহিংস হয়ে ওঠা এই আন্দোলনে
অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপির কার্যালয়েও।
বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে আল জাজিরা।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি বলছে, হিমালয়ের উচ্চভূমির শীতল মরুভূমি অঞ্চল লাদাখে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বারবারই দেখা দিয়েছে ভারত-চীন উত্তেজনা। আর সেখানেই জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে ভয়াবহ বিক্ষোভ শুরু হয় বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির আঞ্চলিক কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ তরুণরা।
লাদাখের আঞ্চলিক রাজধানী লেহ শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। এতে এখন পর্যন্ত চারজনের প্রাণহানি ঘটেছে; সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীরও বহু সদস্য আহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, রাজ্য মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবিতে বিগত ছয় বছর ধরে স্থানীয় সিভিল সংগঠনের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা, অনশন কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন লাদাখের মানুষ। কিন্তু, বুধবার শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলন ভেঙে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে বিক্ষুব্ধ তরুণরা।
অতীতে বহু অনশন কর্মসূচির নেতৃত্ব দিয়েছেন শিক্ষক সোনাম ওয়াংচুক। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, এটা তরুণদের এক ধরনের বিস্ফোরণ— একটা জেন-জি বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আর কাজে আসছে না বলে বিশ্বাস জন্মেছে তাদের মধ্যে।
লাদাখে শুরু এই আন্দোলনকে বাংলাদেশ-নেপালসহ সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলোর সঙ্গে তুলনা করছেন তিনি।
যেভাবে রক্তক্ষয়ী রূপ নিল লাদাখের ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন
বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সকালে লাদাখ এপেক্স বডির নেতৃত্বে ১৫তম দিনে প্রবেশ করে স্থানীয় আন্দোলনকারীদের অনশন। আগের রাতে দুই প্রবীণ অনশনকারীকে হাসপাতালে নিতে হয়। এরপরই সংগঠকেরা লকডাউনের ডাক দেন। একইসঙ্গে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনায় বিলম্ব হওয়ার কারণে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কেন্দ্র মার্টিয়ার্স মেমোরিয়াল পার্ক থেকে বেরিয়ে স্থানীয় সরকারি ভবন ও বিজেপি কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হন তরুণরা এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এতে চারজন নিহত, আরও অনেকে আহত হন। আহতদের মধ্যে একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
লাদাখ এপেক্স বডির সমন্বয়ক জিগমাত পালজোর বলেন, এটা লাদাখের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন। যারা রাস্তায় দাবি আদায়ে নেমেছিলেন, তাদের হত্যা করা হলো।
অন্যদিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, অশান্ত তরুণদের সঙ্গে সংঘর্ষে ৩০ জনেরও বেশি পুলিশ আহত হয়েছে। আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ।
মোদি সরকারের অভিযোগ, ওয়াংচুক বিক্ষোভকারীদের উসকে দিয়েছেন। তিনি আরব বসন্তধর্মী আন্দোলন ও নেপালের জেন-জি বিক্ষোভের উল্লেখ করে তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
তবে, ওয়াংচুক জোর দিয়ে বলছেন, তিনি কখনোই সহিংসতার আহ্বান জানাননি; বরং সতর্ক করেছিলেন যে দাবিগুলো উপেক্ষা করলে তরুণদের ক্ষোভ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা ও রাজ্য পদমর্যাদা বাতিল করে। তখন ওই রাজ্যের তিনটি অঞ্চল ছিল— মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির উপত্যকা, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু এবং মুসলিম-বৌদ্ধ সমান জনসংখ্যার লাদাখ।
পরে জম্মু-কাশ্মিরকে একটি আইনসভাসহ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং লাদাখকে আইনসভাহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানানো হয়। এতে জম্মু-কাশ্মিরের জনগণ অন্তত স্থানীয় নেতাদের নির্বাচিত করার অধিকার পেলেও লাদাখ পুরোপুরি চলে যায় আমলাতান্ত্রিক শাসনের অধীনে।
লাদাখের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘তফসিলি জনজাতি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তাই তারা ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বায়ত্তশাসন ও সাংবিধানিক সুরক্ষা চাইছেন, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলে বিদ্যমান।
কিন্তু, লাদাখকে এ পর্যন্ত রাজ্য মর্যাদা কিংবা ষষ্ঠ তফসিলের সুরক্ষা কোনোটাই দিতে রাজি হয়নি মোদি সরকার।
এর ফলে কর্মসংস্থানও কঠিন হয়ে পড়েছে লাদাখের তরুণদের জন্য। আগে জম্মু-কাশ্মির একত্রে থাকায় লাদাখের লোকজনও সেখানকার চাকরিতে আবেদন করতে পারতেন। এখন সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না।
ওয়াংচুক বলেন, আমাদের তরুণরা পাঁচ বছর ধরে বেকার। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটাই অশান্তির মূল কারণ।
লাদাখ ভারতের হিমালয় সীমান্তে অবস্থিত। চীনের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে অঞ্চলটির। এই অঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি গিরিপথ, বিমানঘাঁটি ও সরবরাহপথ রয়েছে, যা ভারত-চীন যুদ্ধে সামরিক দিক থেকে অপরিহার্য।
২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত ও চীনের সেনারা। তাতে অন্তত ২০ ভারতীয় ও ৪ চীনা সেনা নিহত হয়। এরপর থেকে দুই দেশই সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ২০১৯ সালে মোদি সরকারের পদক্ষেপ এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। আগে কাশ্মির ছিল অশান্তির কেন্দ্র, এখন লাদাখও তাতে যোগ হলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।