আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গেল শতাব্দীতে চীনে চড়ুই পাখির উৎপাত শুরু হয়েছিল। চড়ুই পাখির দল কৃষকের জমির পাকা ধান খেয়ে নিত। এই পাখির অত্যাচারে চীনে ধানের উৎপাদন বেশ কমে গিয়েছিল বলে জানতে পারে তখনকার সরকার। তখন চড়ুই পাখি নিধনের নির্দেশ দেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
পাখি নিধনের পর যখন হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তখনই প্রতিশোধ নেয় প্রকৃতি। যার মূল্য দিতে প্রাণ যায় কয়েক কোটি মানুষের। সাড়ে ছয় দশক পরও যার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে চীন।
ঘটনাটি ১৯৫৮ সালের।
তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মাও সেতুং। চীনের সর্বময় ক্ষমতার এই অধিকারী চড়ুই পাখির অত্যাচারের কথা শুনে ধানের উৎপাদন বাড়াতে চীনকে চড়ুই পাখিমুক্ত করার নির্দেশ দেন।
চীনকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মাও সেতুং। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন তিনি।
চড়ুই নিধন ছিল তারই অংশ। বেইজিং তখন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। ওই সময় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খামার বন্ধ করার নির্দেশ দেন মাও। পাশাপাশি, জোর দেওয়া হয় যৌথ এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিকাজের দিকে।
কৃষির উন্নতি করতে গিয়ে হঠাৎই এক দিন চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট হাতে পান মাও সেতুং।
তাতে লেখা ছিল- মাছি, মশা, ইঁদুর আর চড়ুই জনগণের স্বাস্থ্য এবং ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। মূলত, চড়ুই এবং ইঁদুরের জন্য প্রত্যেক বছর নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য।
রিপোর্ট দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন মাও। এই প্রাণীগুলো নির্মূল করার নির্দেশ দেন তিনি। সরকারি এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রচার করা হয়।
মাও ভেবেছিলেন মশা, মাছি এবং ইঁদুর মারলে রোগ কমবে। নির্মূল হবে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, প্লেগের মতো রোগ। আর চড়ুই নিধনে রক্ষা করা যাবে বিপুল পরিমাণ শস্য। যা বিদেশের বাজারে বিক্রি করে মোটা টাকা ঘরে তুলবে চীন। কারণ, আর্থিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলার স্বপ্নে তখন বিভোর ছিলেন এই কমিউনিস্ট নেতা।
মাওকে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একটা চড়ুই বছরে চার থেকে পাঁচ কেজি শস্য খেয়ে ফেলে। তিনি হিসাব করে দেখলেন, দেশে চড়ুইয়ের সংখ্যা ১০ লাখ হলে তারা প্রতি বছর ৬০ হাজার চীনা নাগরিকের খাবার খেয়ে নিচ্ছে। যাকে অপরাধ বলেই মনে করছিলেন তিনি।
কৃষি বিপ্লব এবং আর্থিক সমৃদ্ধির নেশায় ১৯৫৮ সালে চীনজুড়ে ‘চড়ুই হত্যা’ অভিযান শুরু করেন মাও। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা এর নামকরণ করেন, ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’। সরকারি তরফে চড়ুই নিধনে তখন বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।
মাওয়ের নির্দেশে সমগ্র দেশবাসী চড়ুই হত্যায় মেতে উঠেছিলেন। ওই সময় চীনারা চড়ুইয়ের বাসা দেখলেই তা ভেঙে দিতেন। নষ্ট করতেন ডিম। এছাড়া চড়ুই নিধনের জন্য প্রচণ্ড জোরে হাঁড়ি বা ড্রাম বাজানো হতো। বিকট শব্দে ভয় পেয়ে একটা সময় ছোট্ট পাখিগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। গুলি করে এবং বিষ দিয়েও বহু পাখি হত্যা করা হয়েছিল।
চড়ুই নিধনযজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন চীনের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মীরাও। নিধনযজ্ঞে কারখানার শ্রমিকদেরও দেখা গিয়েছিল। দ্রুত চড়ুইয়ের বংশ কীভাবে লোপ করা যায়, তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালিয়েছিল সরকার।
মাওয়ের এই চড়ুই নিধন নিয়ে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘মাও’স গ্রেট ফেমিম’। যার লেখক ছিলেন ফ্রাঙ্ক ডিকোটার। তার দাবি, এক বছরের মধ্যে ১০০ কোটি চড়ুইয়ের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল চীন। যদিও সংখ্যাটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে বইতে উল্লেখ করেন তিনি।
এই চড়ুই নিধনের পরই প্রকৃতির রোষানলে পড়ে চীন। কারণ, ছোট্ট এই পাখিটা শুধু যে শস্য খেয়ে নিত, তা নয়। ফসলের ওপরে থাকা নানা ধরনের পোকামাকড় ছিল এদের খাদ্য। চড়ুই না থাকায় শুরু হয় পোকামাকড়ের উপদ্রব।
ডিকোটার জানিয়েছেন, ১৯৬০ সালে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। কাকতালীয়ভাবে সে বছর খরার কবলে পড়েছিল চীন। তার ওপর ছিল পঙ্গপালের আক্রমণ। যারা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মাঠের পর মাঠ ফসল নষ্ট করে দিয়েছিল। বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেও সেগুলোকে মারা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ওই সময় চীনের কৃষি জমি বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফসলের উৎপাদন হঠাৎ করে অনেকটা কমে যায়। যা ওই দুর্ভিক্ষকে ডেকে এনেছিল।
চীনের এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে একাধিক বই রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল ড্রাগন ভূমির সাংবাদিক ইয়াং জিশেংয়ের লেখা ‘টম্বস্টোন: দ্য গ্রেট চায়না ফেমিন’। সেখানে তিনি বলেছেন, পেটের জ্বালায় মাটি খেয়ে দিন কাটিয়েছে বহু চীনা পরিবার।
ওই দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। বেইজিংয়ের দাবি, দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন দেড় কোটি মানুষ। তাদের প্রত্যেকে না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন, এমনটা নয়। বরং খাবারের জন্য অনেকেই একে অপরকে খুন করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে চীনের সরকারি তথ্যে।
প্রথম দিকে অবশ্য চড়ুই নিধনের ফলেই দুর্ভিক্ষ নেমেছে, তা মানতে রাজি ছিলেন না কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুং। পরবর্তীতে বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। তখন অবশ্য অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২ সালে শেষ হয় চীনের ওই দুর্ভিক্ষ।
গত বছর গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইনের ওপর দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের স্বাস্থ্যের ওপরেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল।
ওই দুই গবেষণাপত্র অনুযায়ী, চীনে উচ্চ রক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, ফুসফুস-লিভার-কিডনির রোগ, হৃদরোগ, স্মৃতি-সম্পর্কিত রোগ, আর্থ্রাইটিস এবং হাঁপানির সমস্যা বাড়ছে। এর নেপথ্যে চড়ুই নিধন এবং দুর্ভিক্ষ মূল কারণ বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।