রাকিবের (১৬) চোখে ঘুমের ছাপ, আঙুলগুলো অবিরাম টাচস্ক্রিনে ঘষে চলেছে। স্কুলের পড়া বাকি, পরীক্ষা সামনে, কিন্তু তার পুরো জগৎটা এখন শুধুই ‘ফ্রি ফায়ার’ আর ‘ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান্স’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাত তিনটে বাজে, মোবাইলের ব্যাটারি লো-বাটারি মোডে। রাকিবের মা, ফারজানা আপা, জানালার পর্দা টেনে দিচ্ছেন – তার চোখে অশ্রু আর অসহায়ত্ব। রাকিবের মতো লক্ষ কিশোর-তরুণ আজ মোবাইল গেমের আসক্তি নামক অদৃশ্য শিকলে বন্দী। এই আসক্তি শুধু সময়ই কেড়ে নেয় না, কেড়ে নেয় স্বাস্থ্য, পড়াশোনা, সামাজিক সম্পর্ক, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তবে হতাশ হবেন না। এই আসক্তি দূর করা অসম্ভব নয়। মোবাইল গেমের আসক্তি দূর করার উপায় জানুন এখনই, এই গাইডে পাবেন বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য কার্যকরী কৌশল।
মোবাইল গেমের আসক্তি: কী, কেন এবং কীভাবে চিনবেন?
মোবাইল গেমের আসক্তি শব্দটি শুনলেই অনেকে ভাবেন, “আরে, খেলতে ভালোবাসা আর আসক্তি এক জিনিস না!” কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান একে এখন গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৮ সালে “গেমিং ডিসঅর্ডার” (Gaming Disorder)-কে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা কোনও সাধারণ শখ বা বিনোদন নয়, বরং এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে:
- নিয়ন্ত্রণ হারানো: গেম খেলার সময়কাল, ফ্রিকোয়েন্সি, তীব্রতা ও প্রেক্ষাপট নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
- অগ্রাধিকার দেওয়া: গেমিংকে জীবনের অন্যান্য আগ্রহ, দায়িত্ব ও দৈনন্দিন কাজকর্মের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া।
- নেতিবাচক পরিণতি: গেমিং চালিয়ে যাওয়া বা চালিয়ে যাওয়ার মাত্রা বাড়ানো, তা সত্ত্বেও এর নেতিবাচক ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষাগত বা পেশাগত পরিণতি স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও।
বাংলাদেশে চিত্রটা কতটা ভয়াবহ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহানা ইসলামের মতে, “বাংলাদেশে বিশেষ করে শহুরে কিশোর-তরুণদের মধ্যে মোবাইল গেমিং আসক্তির হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় স্কুল বন্ধ থাকা, সামাজিক দূরত্ব ও একাকিত্ব এই প্রবণতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।” বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-র একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় (২০২৩) দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের ১৩-১৯ বছর বয়সী প্রায় ৩৫% কিশোর-কিশোরী প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘন্টার বেশি মোবাইল গেম খেলে, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসক্তির লক্ষণ দেখায়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ যোগ করেন, “আমরা সপ্তাহে গড়ে ৮-১০টি নতুন কেস পাচ্ছি যেখানে অভিভাবকরা সন্তানের অতিরিক্ত গেমিং, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে অভিযোগ নিয়ে আসছেন।”
আপনার সন্তান বা আপনি আসক্ত কি না বুঝবেন যেভাবে
আসক্তির লক্ষণগুলো চিনতে পারলেই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি অধিকাংশই ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে:
- সময় নিয়ে মিথ্যা বলা? গেমে কত সময় ব্যয় করা হচ্ছে তা লুকানো বা কম করে বলা।
- অন্য কাজে অমনোযোগ? পড়াশোনা, অফিসের কাজ বা গৃহস্থালি দায়িত্বে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া।
- মন খারাপ ও উদ্বেগ? গেম না খেলতে পারলে বিরক্তি, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা দেখা দেওয়া।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা? বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে সময় কাটানো কমিয়ে দেওয়া, একাকী থাকতে পছন্দ করা।
- শারীরিক সমস্যা? ঘাড়/পিঠে ব্যথা, চোখে জ্বালাপোড়া, অনিয়মিত ঘুম, খাওয়ায় অনিয়ম।
- বাস্তবতা থেকে পালানো? জীবনের সমস্যা বা কষ্ট ভুলে থাকার জন্য গেমে ডুবে থাকা।
- ব্যর্থতার পরও চালিয়ে যাওয়া? গেমে হেরে গেলে বা বন্ধ করতে বললে প্রচণ্ড রাগ করা, তবুও আবার খেলা শুরু করা।
- অন্যান্য শখ হারিয়ে ফেলা? আগে যা উপভোগ করত (খেলাধুলা, আঁকা, গান) সেগুলোতে আর আগ্রহ না থাকা।
বিশ্বাসযোগ্য উৎস:
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ICD-11 তে Gaming Disorder এর সংজ্ঞা: https://icd.who.int/browse11/l-m/en#/http://id.who.int/icd/entity/1448597234
- আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (APA) এর ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল (DSM-5) ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডারকে গবেষণার জন্য শর্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
- বাংলাদেশে শিশু-কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ, ঢাকা
মোবাইল গেমের আসক্তি দূর করার ১০টি বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারিক উপায়
শুধু মোবাইল কেড়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয় না, বরং তা আরও জটিল করতে পারে। প্রয়োজন কৌশলগত, ধারাবাহিক ও সহানুভূতিশীল পদক্ষেপ। আসক্তি দূর করার উপায় জানুন এখনই এই কার্যকরী পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে:
১. সচেতনতা ও স্বীকারোক্তি: প্রথম পদক্ষেপ
- কী ক্ষতি হচ্ছে তা বুঝুন: নিজের জন্য বা সন্তানের জন্য গেমিং আসক্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলো (শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, শিক্ষাগত) একটি কাগজে লিখে ফেলুন। দৃশ্যমান করা মনকে জাগ্রত করে।
- আসক্তি স্বীকার করুন: সমস্যাটি আছে – এটা মেনে নেওয়াই হলো পরিবর্তনের প্রথম সোপান। নিজের কাছে বা বিশ্বস্ত কারও কাছে স্বীকার করুন।
২. পরিষ্কার সীমা নির্ধারণ ও ‘ডিজিটাল ডিটক্স’
- সময়সীমা বাঁধুন: গেম খেলার জন্য দিনে কতটুকু সময় দেওয়া যাবে, তা ঠিক করুন। শুরুতে হয়তো ২-৩ ঘন্টা থেকে কমিয়ে ১ ঘন্টায় আনা যেতে পারে। অ্যাপের স্ক্রিন টাইম ফিচার (Android Digital Wellbeing / iOS Screen Time) ব্যবহার করুন। এখানে ডেইলি লিমিট সেট করলে নির্দিষ্ট সময় শেষে গেমস অটোমেটিক লক হয়ে যাবে।
- ‘নো-গেমিং জোন’ ও ‘নো-গেমিং টাইম’ তৈরি করুন: খাওয়ার টেবিল, শোবার ঘর, পড়ার টেবিল হবে গেম-ফ্রি জোন। স্কুল/কলেজ/অফিস থেকে ফেরার পর প্রথম ১ ঘন্টা, রাতের খাবারের সময়, ঘুমানোর আগের ১ ঘন্টা হবে গেম-ফ্রি টাইম।
- ছোট ছোট ডিটক্স চেষ্টা করুন: প্রথমে শুধু সপ্তাহান্তে একদিন (যেমন শুক্রবার) গেম একদম না খেলা। তারপর ধীরে ধীরে দিন বাড়ানো।
৩. বিকল্প ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা
আসক্তি শূন্যতা পূরণ করে। তাই গেমিংয়ের সময়টাকে অন্য কিছুর দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে হবে:
- শারীরিক কার্যকলাপ: ফুটবল, ক্রিকেট, সাইক্লিং, দৌড়ানো, সাঁতার, মার্শাল আর্ট, এমনকি নিয়মিত হাঁটাও। শরীরচর্চা এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ করে, যা মুড ভালো করে এবং গেমিংয়ের তীব্র ইচ্ছা কমায়। পারিবারিকভাবে সন্ধ্যায় হাঁটার রুটিন করুন।
- সৃজনশীল শখ: আঁকা, গান শেখা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, গল্প/কবিতা লেখা, ফটোগ্রাফি, কারুশিল্প, গার্ডেনিং। এই কাজগুলো সন্তুষ্টি দেয় এবং মস্তিষ্ককে অন্যরকমভাবে সক্রিয় রাখে।
- সামাজিক মিথস্ক্রিয়া: বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া (ফোনে নয়, সরাসরি), পারিবারিক গেমস খেলা (ক্যারম, লুডু, দাবা, বোর্ড গেমস), আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশিদের সাথে সময় কাটানো।
- পড়াশোনা ও দক্ষতা উন্নয়ন: নতুন ভাষা শেখা, অনলাইন কোর্স করা, প্রোগ্রামিং শেখা, ব্লগ লেখা, স্বেচ্ছাসেবী কাজে যুক্ত হওয়া।
৪. পরিবেশগত পরিবর্তন আনুন
- মোবাইল দূরে রাখুন: পড়ার সময়, ঘুমানোর সময়, পারিবারিক আড্ডার সময় মোবাইল অন্য রুমে বা ড্রয়ারে রাখুন। চার্জিং পয়েন্ট শোবার ঘরের বাইরে রাখুন।
- গেমিং ট্রিগার এড়িয়ে চলুন: নির্দিষ্ট কিছু গেমিং গ্রুপ, চ্যানেল বা ফ্রেন্ডস যাদের সাথে শুধু গেম নিয়ে কথা হয়, তাদের সাথে যোগাযোগ সাময়িকভাবে কমিয়ে দিন বা আনফলো করুন।
- বেডরুমকে গেম-ফ্রি জোন করুন: শোবার ঘরে মোবাইল/ট্যাবলেট নেওয়া নিষেধ করুন। এতে ঘুমের মানও ভালো হবে।
৫. লক্ষ্য নির্ধারণ ও পুরস্কার ব্যবস্থা
- ছোট ছোট লক্ষ্য: “আজ আমি মাত্র ১ ঘন্টা গেম খেলব”, “এই সপ্তাহে আমি ৩ দিন গেম খেলব না” – এমন অর্জনযোগ্য লক্ষ্য রাখুন।
- নন-ডিজিটাল পুরস্কার: লক্ষ্য পূরণ হলে নিজেকে বা সন্তানকে পুরস্কৃত করুন – পছন্দের খাবার, সিনেমা দেখতে যাওয়া, নতুন বই কেনা, বেড়াতে যাওয়া। গেমিং-সম্পর্কিত পুরস্কার (যেমন: নতুন গেম কেনা, এক্সট্রা টাইম) একদম নয়।
৬. অভিভাবকদের ভূমিকা: সংলাপ ও সমর্থন
- শাস্তি নয়, সংলাপ: রাগ করে ফোন কেড়ে নেওয়া বা বকাঝকা করা সমস্যা বাড়ায়। বরং শান্তভাবে কথা বলুন। কেন গেমিং তার জন্য এত আকর্ষণীয়, তা বুঝতে চেষ্টা করুন। আপনার উদ্বেগের কথা বলুন। “তুমি সারাদিন গেম খেলো, এটা বন্ধ করো!” না বলে বলুন, “আমি লক্ষ্য করছি তুমি গেমে অনেক সময় দিচ্ছ, আমাদের একসাথে অন্য কিছু করার সময় কমে যাচ্ছে, এটা নিয়ে আমি চিন্তিত।”
- সহযোগী হোন: একসাথে গেম খেলার সময় বেঁধে দিন। দেখুন সে কোন গেম খেলছে, কেন পছন্দ করে। তারপর ধীরে ধীরে সীমা নির্ধারণে সহমত হোন।
- রোল মডেল হোন: আপনি নিজেই যদি সারাক্ষণ ফোনে ডুবে থাকেন, সন্তানকে শেখানো কঠিন হবে। নিজের স্ক্রিন টাইমও নিয়ন্ত্রণ করুন, পরিবারের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটান।
৭. প্রযুক্তিকেই সহায়ক করুন
- স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকিং ও লিমিট: Android-এর Digital Wellbeing এবং iOS-এর Screen Time ফিচার ব্যবহার করে প্রতিদিনের গেমিং সময় দেখুন এবং কঠোর লিমিট সেট করুন। পারলে পরিবারের অন্য সদস্যদের দিয়ে পাসকোড সেট করুন।
- অ্যাপ ব্লকার: অতিরিক্ত সমস্যা হলে AppBlock, Freedom, StayFocusd (Chrome Extension) এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করে নির্দিষ্ট সময়ে গেমস ব্লক করে রাখুন।
- বিজ্ঞপ্তি বন্ধ করুন: গেমসের পুশ নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন। এগুলো বারবার টেনশন তৈরি করে গেমে ফিরে যেতে।
৮. ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তোলা
গেমিং আসক্তি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, আবার ঘুমের অভাবও গেমিংয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়। এই চক্র ভাঙতে:
- ঘুমানোর ১-২ ঘন্টা আগে স্ক্রিন এড়িয়ে চলুন: মোবাইলের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়, যা ঘুম আসতে সাহায্য করে।
- ঘুমের নির্দিষ্ট রুটিন: প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠা।
- শোবার ঘর শান্ত, অন্ধকার ও ঠান্ডা রাখুন।
৯. চাপ ও একাকিত্ব মোকাবেলা শেখা
অনেকেই মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতে গেমে ডুবে যায়। তাই:
- ভালো বন্ধুত্ব: প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে তোলার জন্য উৎসাহিত করুন, যাদের সাথে জীবনের নানা বিষয়ে শেয়ার করা যায়।
- মানসিক চাপ কমানোর কৌশল: শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (Deep Breathing), মেডিটেশন, ইয়োগা, হালকা গান শোনা, প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো শেখান।
- কাউন্সেলিং: নিজে থেকে বা সন্তানের মানসিক কষ্ট, একাকিত্ব বা চাপ মোকাবেলায় সমস্যা হলে পেশাদার কাউন্সেলর বা মনোবিদের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
১০. ধৈর্য ধরা ও পেশাদার সাহায্য নেওয়া
- ধৈর্য্য রাখুন: আসক্তি কাটিয়ে ওঠা রাতারাতি হয় না। উত্থান-পতন হবেই। ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে আবার চেষ্টা করুন।
- পারিবারিক সমর্থন: পুরো পরিবারকে একসাথে কাজ করতে হবে। সবার মধ্যে ধারাবাহিকতা রাখা জরুরি।
- কখন পেশাদার সাহায্য নেবেন? যদি নিজের প্রচেষ্টায় উন্নতি না হয়, মেজাজ খিটখিটে বা আগ্রাসী হয়ে ওঠে, স্কুল/কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়, খাওয়া-ঘুম একদম বিগড়ে যায়, বা বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা দেয়, অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন। বাংলাদেশে ভালো মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন:
- ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ (NIMH), ঢাকা: https://nimh.gov.bd/
- ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, সাইকিয়াট্রি বিভাগ
- পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাইকিয়াট্রি বিভাগ
- প্রাইভেট প্র্যাকটিসে থাকা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টগণ।
অভিভাবকদের জন্য বিশেষ গাইডলাইন: সন্তানকে গেমিং আসক্তি থেকে বাঁচান
আপনার সন্তান যদি মোবাইল গেমের আসক্তিতে ভুগছে, আপনার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, এটা শুধু তার ‘ইচ্ছাশক্তি’র অভাব নয়, এটি একটি জটিল আচরণগত সমস্যা। এখানে কিছু অতিরিক্ত টিপস:
- শুরুতেই বোঝাপড়া: ছোটবেলা থেকেই স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ করুন। গ্যাজেট হাতে দেওয়ার সময়ই নিয়ম ক্লিয়ার করে দিন।
- কোয়ালিটি টাইম: প্রতিদিন কিছু সময় শুধু সন্তানের জন্য রাখুন – কথা বলুন, তার পছন্দের বিষয় শুনুন, একসাথে কিছু করুন (গেম নয়!)। আপনার মনোযোগ পেলে তার অন্য মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণের প্রয়োজন কমবে।
- বাস্তবিক বিকল্প উপস্থাপন: শুধু “গেম বন্ধ করো” বলবেন না, বরং “চলো বাইরে যাই, ফুটবল খেলি?” বা “চলো একসাথে তোমার পছন্দের রান্না করি?” – এমন প্রস্তাব দিন।
- সহানুভূতি ও উৎসাহ: ছোট ছোট সাফল্যে তাকে উৎসাহিত করুন। লড়াই করার জন্য তার সাহসের প্রশংসা করুন। ব্যর্থ হলে সমর্থন দিন, তিরস্কার নয়।
- স্কুলের সাথে যোগাযোগ: শিক্ষকদের জানান। তারা ক্লাসে সন্তানের আচরণ ও মনোযোগের উপর নজর দিতে পারবেন এবং সহযোগিতা করতে পারবেন।
- নিজে উদাহরণ হোন: আপনি যদি নিজে সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইন সিরিজে আসক্ত থাকেন, সন্তানকে শেখানো কঠিন হবে।
সফলতার গল্প (বাংলাদেশ থেকে):
রাজশাহীর ১৫ বছর বয়সী আরাফাত। একসময় ‘PUBG Mobile’-এ ডুবে থাকত দিনে ৮-১০ ঘন্টা। পড়াশোনা ভেস্তে যাচ্ছিল, মা-বাবার সাথে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। মনোবিদের পরামর্শে, অভিভাবকরা প্রথমে তাকে বকাঝকা বন্ধ করে সংলাপ শুরু করেন। একসাথে সময় কাটানো বাড়ান। তার ফুটবল খেলার পুরনো শখে আবার উৎসাহিত করেন। স্ক্রিন টাইম লিমিট সেট করা হয়। প্রথমে কঠিন হলেও ধীরে ধীরে আরাফাতের গেমিং সময় কমে আসে। সে এখন ফুটবল টিমে নিয়মিত, পড়াশোনায় মন দিয়েছে। তার মা বলেন, “আসক্তি দূর করার উপায় জানতে পারাটাই আমাদের প্রথম জয় ছিল। ধৈর্য্য আর ভালোবাসাই মূল হাতিয়ার।”
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: মোবাইল গেমের আসক্তি কি সত্যিই একটা রোগ?
উত্তর: হ্যাঁ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আনুষ্ঠানিকভাবে “গেমিং ডিসঅর্ডার”-কে একটি মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে (ICD-11 তে)। এটি শুধু খারাপ অভ্যাস নয়; এটা মস্তিষ্কের পুরস্কারপ্রাপ্তির পথকে (Reward Pathway) প্রভাবিত করে, অন্যান্য আসক্তির মতোই। এর নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক ক্রাইটেরিয়া আছে।
প্রশ্ন: আমার সন্তান শুধু বলেই চলেছে ‘আর ৫ মিনিট!’। কী করব?
উত্তর: প্রথমে, শান্ত থাকুন। আগে থেকে সময়সীমা ও পরিণতি (যেমন: সময় পার হলে পরের দিন গেমিং টাইম কমে যাবে) সম্পর্কে পরিষ্কার করে বলুন। সময় শেষ হওয়ার ৫ মিনিট আগে সতর্ক করুন। সময় পার হলে দৃঢ়ভাবে গেম বন্ধ করতে বলুন। অ্যাপ ব্লকার ব্যবহার করলে এটি স্বয়ংক্রিয় হবে। ধারাবাহিকতা রাখা সবচেয়ে জরুরি।
প্রশ্ন: গেমিং ছাড়া আমার কি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ থাকবে না?
উত্তর: গেমিং অনেকের জন্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু একমাত্র মাধ্যম নয়। গেম ছাড়াও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার অনেক উপায় আছে – ফোনে কথা বলা, মেসেজ করা, স্কুল/কলেজে দেখা করা, পার্কে বা মাঠে খেলতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়া। আসল বন্ধুত্ব গেমের বাইরেও টিকে থাকে। নতুন সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিলে নতুন বন্ধুও তৈরি হবে।
প্রশ্ন: আমি নিজে চেষ্টা করছি, কিন্তু বারবার ফিরে যাচ্ছি গেমে। হাল ছেড়ে দেব?
উত্তর: একদমই না। আসক্তি কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়, উত্থান-পতন স্বাভাবিক। নিজেকে দোষারোপ করবেন না। ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করুন (যেমন: একাকিত্ব, বিরক্তি, নির্দিষ্ট ট্রিগার) এবং সেগুলো মোকাবেলার নতুন কৌশল ভাবুন। ছোট লক্ষ্য নিয়ে আবার শুরু করুন। সাপোর্ট সিস্টেম (পরিবার, বন্ধু, গ্রুপ থেরাপি) গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, প্রতিটি চেষ্টা আপনাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কোথায় পেশাদার সাহায্য পাব? খরচ কেমন?
উত্তর: বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ ক্রমেই বাড়ছে।
- সরকারি হাসপাতাল: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ (NIMH), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অন্যান্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগে অপেক্ষাকৃত কম খরচে (বা অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে) পরামর্শ ও চিকিৎসা পাওয়া যায়।
- বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক: ল্যাবএইড, স্কয়ার, ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বেশিরভাগ বড় হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। খরচ ক্লিনিক/ডাক্তারভেদে ভিন্ন (সাধারণত ৮০০-২০০০ টাকা কনসালটেশন ফি)।
- ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট: অনেকেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। তাদের খুঁজে পেতে অনলাইন সার্চ বা রেফারেন্স নিতে পারেন।
- হেল্পলাইন: কিছু সংস্থা মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইন চালায় (যেমন: কেয়ার বাংলাদেশের কিছু প্রকল্প)। খরচের বিষয়ে সরাসরি প্রতিষ্ঠান বা চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নিন।
মোবাইল গেমের আসক্তি কোনো ব্যক্তির দুর্বলতা নয়, বরং আধুনিক যুগের একটি জটিল চ্যালেঞ্জ। তবে সচেতনতা, দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, বিজ্ঞানসম্মত কৌশল এবং প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নিলে এই শৃঙ্খল ভাখা একেবারেই অসম্ভব নয়। মনে রাখবেন, রাকিব বা আপনার সন্তান, আপনার ভাইবোন, এমনকি আপনি নিজেই যে শুধু গেমারের চেয়ে অনেক বেশি – একজন ভালো ছাত্র, একজন ক্যারিশমাটিক বন্ধু, একজন আদর্শ সন্তান, একজন সম্ভাবনাময় মানুষ। মোবাইল স্ক্রিনের পিক্সেলের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সেই বাস্তব, উজ্জ্বল মানুষটিকেই ফিরে পাওয়ার লড়াই এটি। মোবাইল গেমের আসক্তি দূর করার উপায় জানার পর এখনই শুরু করুন ছোট্ট একটি পদক্ষেপ – হয়তো আজই গেমিংয়ের সময় ৩০ মিনিট কমিয়ে দিয়ে, কিংবা পরিবারের সাথে একসাথে চা পান করার অঙ্গীকার করে। সময় লাগবে, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্ত স্বাধীনতার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। সেই যাত্রায় আপনার জন্য রইল শুভকামনা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।