মৌ মাছি মৌ মাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাড়াও না একবার ভাই, ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে দাঁড়াবার সময় তো নাই। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি দেখে সত্যিই কবি নব কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত ছড়াটির কথা মনে পড়ে যায়। আর ছোটবেলার সেই অতি পরিচিত ছড়াটি যেন বাস্তবে রূপ নিয়েছে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে।

দিগন্তজোড়া সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখর চারপাশ। তবে এই মৌমাছিরা শুধু মধু আহরণই করছে না, পাল্টে দিচ্ছে শিক্ষিত এক যুবকের ভাগ্য। উচ্চশিক্ষার পাঠ চুকিয়ে করপোরেট চাকরির পেছনে না ছুটে মৌচাষে স্বাবলম্বী হয়ে দৃষ্টান্ত গড়েছেন মুয়াজ্জিন হোসেন।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে ভোরের মিষ্টি রোদ। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জামির্তা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন হলুদের সমারোহ। চারদিকে ফুটেছে সরিষার ফুল। আর সেই ফুলের মধু আহরণে মহাব্যস্ত মৌমাছির দল। গুঞ্জনে মুখরিত চারপাশ যেন জানান দিচ্ছে এক প্রাকৃতিক উৎসবের।
মাঠের এক কোণে তাঁবু খাটিয়ে বসানো হয়েছে সারি সারি মৌমাছির বাক্স। এখানেই নিজের স্বপ্ন বুনছেন এক উদ্যমী তরুণ। নাম মুয়াজ্জিন হোসেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং এমবিএ সম্পন্ন করা এই যুবক যখন চাকরির বাজারে না গিয়ে মৌচাষের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন পাশে পাননি পরিবারকে। জেদ চেপে বসল মনে; ঘর ছাড়লেন, পেটেভাতে কাজ শিখলেন বাগেরহাটে এক গুরুর কাছে।
মুয়াজ্জিন হোসেন বলেন, এমবিএ পড়ার সময় থেকেই মৌচাষের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। বাসায় জানালে বাবা খুব রেগে যান। উচ্চশিক্ষা নিয়ে কেন মৌচাষ করব—এটাই ছিল সবার প্রশ্ন। শেষমেশ ঘর ছাড়লাম। কাজ শিখলাম। আজ গুরুর দেওয়া সেই উপহারের ৪টি বাক্স থেকে আমার এখন ১০০টির বেশি বাক্স হয়েছে। বছরে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করছি।
দীর্ঘ ১২ বছরের অভিজ্ঞতা মুয়াজ্জিনকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। তিনি জানালেন, মৌমাছি কখনো নষ্ট ফুল স্পর্শ করে না। বিশুদ্ধ মধু আহরণের এই নেশা এখন তার পেশা। মুয়াজ্জিনের এই সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন সহকারীরাও।
সহকারি চাষি পার্থ বলেন, মুক্ত পেশা হিসেবে এটা আমার খুব ভালো লাগে। আড়াই বছর ধরে এখানে কাজ করছি। আমারও স্বপ্ন আছে ভবিষ্যতে এমন একটি খামার করার। আজ আমি মুয়াজ্জিন ভাইয়ের খামারে আছি, একদিন আমার খামারেও আমার মত আরেকজন সহকারী থাকবেন।
সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌচাষ হওয়ায় দ্বিমুখী লাভ হচ্ছে এলাকায়। একদিকে যেমন খাটি মধু মিলছে, অন্যদিকে বেড়েছে সরিষার ফলন। ভেজালের ভিড়ে চোখের সামনে চাক ভাঙা মধু সংগ্রহ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় করছেন ক্রেতারা। অনেকে দেশের বাইরে পাঠাতেও এই মধু সংগ্রহ করছেন।
কয়েকজন ক্রেতা বলেন, মধু কিনতে গেলে এখন ভেজাল কিনছি না ভালো কিনছি—এই ভয় থাকে। কিন্তু এখানে চোখের সামনে মৌমাছি থেকে সংগ্রহ করলে বিশ্বাসটা থাকে পুরোপুরি। আমরা নিজের জন্য তো নেই-ই, অনেকে আবার বিদেশে থাকা ছেলে-মেয়েদের কাছেও পাঠাই। একদম খাঁটি, গন্ধ আর স্বাদেই বোঝা যায়।
আরেক ক্রেতা বলেন, অনলাইনে অনেকেই খাঁটি বলে বিক্রি করে কিন্তু ভরসা পাই না। এখানে এসে কিনলে আর চিন্তা নেই। দামও ন্যায্য, মাত্র ৮০০ টাকা কেজি। প্রতিবছর মৌসুম এলেই তাদের কাছে মধু সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় থাকি।
কয়েকজন কৃষক বলেন,আগে এতো ফলন হতো না। মৌচাষিরা আসার পর দেখি ফুলে ফুলে মৌমাছি ভিড় করে। এতে পরাগায়ন অনেক বেশি হয়। গত দুই বছরে ফসলের উৎপাদন বেড়ে গেছে চোখে পড়ার মতো। সরিষার দানা বড় হয়, তেলও বেশি পাওয়া যায়। তাই আমরা চাই প্রতিবছরই তারা আসুক। এতে আমাদেরও লাভ, দেশেরও লাভ।
কৃষি বিভাগ বলছে, মৌমাছির কারণে সরিষা ফুলে পরাগায়ন বৃদ্ধি পায়, যা সরাসরি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এ কারণে চাষিদের উৎসাহ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, মৌমাছির ক্যাম্প হওয়ায় ফুলের পরাগায়ন সংখ্যা অনেক বেড়েছে, যা সরিষার বাম্পার ফলনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আমরা নিয়মিত চাষিদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
চাকরির পেছনে না ছুটে মুয়াজ্জিনের মতো শিক্ষিত যুবকরা যদি কৃষিনির্ভর এমন উদ্যোগে এগিয়ে আসেন, তবে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



