বিনোদন ডেস্ক : ‘পাকিজা’ খ্যাত মীনা কুমারীকে বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ বলা হয়। তার প্রকৃত নাম মেহজাবিন বানু। নানী হেমসুন্দরী ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইয়ের মেয়ে। হেমসুন্দরীর দুই কন্যার মধ্যে একজনের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি মীনার বাবা আলি বক্সকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হন ইকবাল বানু নামে।
মীনা বিয়ে করেছিলেন তার চাইতে ১৫ বছরের বড় প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক কামাল আমরোহীকে। ‘পাকিজা’ নির্মাণের শুরুর দিকে কাজ বন্ধ হয়ে যায় কামাল-মীনার দাম্পত্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে। বিয়ের পর কামাল আমরোহী মীনার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন। যেমন, মীনা কোনো ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে সেই ছবির স্ক্রিপ্ট আগে কামাল আমরোহীকে দেখাতে হবে।
ছবির চরিত্রটি মীনার জন্য যথার্থ হবে কি না, চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন কামাল আমরোহী। মীনা কুমারীর মেকআপ রুমে কারও ঢুকার নিয়ম ছিল না। কামাল বলতেন, ওই মেকআপ রুমের কারণেই ইন্ডাস্ট্রির যত ঘর ভাঙ্গে। শুটিং ও তার বাইরে মীনা সবসময়ই নজরবন্দি থাকতেন। নিজের ব্যাংক ব্যালেন্সের উপরও তার কোনো অধিকার ছিল না।
অ্যাকাউন্ট থেকে কত টাকা উইথড্র করবেন সেটাও কামালের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করত। তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন কত টাকা উইথড্র করতে পারবেন মীনা। এমনকি মীনার সব স্বর্ণালংকার থাকতো ব্যাংকের লকারে। বাড়িতে কিছুই রাখতে দিতেন না কামাল।
মীনার ছোটবোন মালিকা একবার বলেছিলেন, মীনার খুব শখ হয়েছিল একজোড়া ঝুমকা কিনতে। কিন্তু কামাল মীনাকে সেই ঝুমকা কিনতে দেননি। ঝুমকা কিনতে না পেরে মীনা সারারাত জেগে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছিলেন। কামাল আমরোহীর বিরুদ্ধে এমন আরও গুরুতর অভিযোগ আছে মীনা কুমারীর পরিবারের।
তবে কামালের দাবি ছিল, মীনা ও তার দাম্পত্য জীবনে চিড় ধরায় মীনার আত্নীয় পরিজন। তারা মীনার ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছিল। মীনাকে তারা কামালের কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। যার ফলে তার চিকিৎসাও ঠিক মত হয়নি।
এর মধ্যেই ১২ বছর কেটে যায়। এই একযুগ পর আবার শুরু হয় অসমাপ্ত ছবি ‘পাকিজা’র কাজ। ততক্ষণে মীনা কুমারীর শরীরে কঠিন রোগ বাসা বেঁধেছে। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। চেহারা লাবণ্য হারিয়ে ফেলেছিল। শরীর ভেঙ্গে গেছে। মীনা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই অবস্থায় কিভাবে তিনি তার শেষ স্বপ্ন পূরণ করবেন।
কিন্তু কামাল আমরোহী তার হাত ধরে বলেন, ‘তোমাকে পর্দায় কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে তা আমার চাইতে কেউই ভালো জানবে না। তুমি চিন্তাটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমিই তোমাকে ‘পাকিজা’য় মনমোহিনী রূপে উপস্থাপন করব।’ ঠিক হলোও তাই। পাকিজা দেখে মনে হয়নি মীনার রূপ-লাবণ্যে ঘাটছি পড়েছে। মনেই হয়নি তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
১৯৭২ সালে ‘পাকিজা’ মুক্তির তিন সপ্তাহ পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মীনা কুমারীর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোমায় ছিলেন। অভিনেত্রী নার্গিস মীনার প্রস্থানে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলেন। মীনার মৃত্যুর পর নার্গিস ক্ষোভের সাথে লিখেছিলেন, ‘মৃত্যু তোমাকে অভিবাদন।’
মীনা কুমারীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন নার্গিস। মীনার ঘোরতর দুর্দিনে নার্গিসই ছিলেন তার মাথার উপর নির্ভরতার ছায়া। নার্গিসকে অনেক সময় নিজের বড়বোন বলে পরিচয় দিতেন মীনা। নার্গিসকে তিনি বাজি (Baaji) বলে সম্বোধন করতেন। উর্দুতে বাজি অর্থ বুবু। অনেক ফিল্মি পার্টি, ঘরোয়া পার্টিতে সবার সামনে এই সম্বোধন করতেন মীনা।
কিন্তু নার্গিসকে বড়বোন মানতেন বলে মীনার স্বামী কামাল আমরোহী বেশ নারাজ ছিলেন এই বিষয়ে। নার্গিস-সুনীল দত্তের ছেলে অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত ও তার স্ত্রী নম্রতাকে মায়ের মত আদর করতেন মীনা। এটাও ভালো চোখে দেখতেন না কামাল। এমনকি কামালের বিশ্বস্ত সেক্রেটারি বাকার মীনা কুমারীর পেছনে গুপ্তচরবৃত্তি করে বেড়াতো।
কামাল আমরোহীর অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে মীনা কুমারীর গায়ে হাত তুলেছিল বাকার। এই ব্যাপারটা মীনার প্রিয় বাজি নার্গিসকে ভীষণ বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মীনার গায়ে হাত তোলা নিয়ে কামাল এবং বাকারের সাথে নার্গিসের তুমুল বাকবিতন্ডা হয়েছিল। মীনা কুমারী শুটিং স্পটে প্রায়ই বলতেন, ‘সে (বাকার) কিভাবে আমার গায়ে হাত তুলতে পারলো?’ এই অপমান মীনাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছিল।
নার্গিসের সন্তানদের আদর করতেন বলে কামাল ঝগড়াঝাটি করতেন মীনা কুমারীর সাথে। মীনার মৃত্যুর কিছুদিন পর নার্গিস একটি উর্দু পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে নার্গিস বলেন, ‘আমি জানতাম কামাল আমরোহী একটা পশু। মীনাকে শেষ করে দিয়েছে পশুটা। তার উপর পাশবিকতা চালাতো কামাল।’
নার্গিস বলেন, ‘একদিন মীনা আমাকে ফোন করে জানালো ওর জ্বর। আমার স্বামী (সুনীল দত্ত) আমাকে বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি মীনাজির কাছে যাও। মীনাজির এখন তোমার ভালোবাসা ও সান্নিধ্য খুব দরকার। সুনীল নিজে ড্রাইভ করে আমাকে মীনার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল। আমাকে দেখে কামালের পালিত চাকর বাকারের মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। কামালও হাবভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন।’
কিন্তু আমি নার্গিস সেসব গায়ে মাখিনি। আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল কিভাবে মীনাকে সুস্থ করে তুলব। আমি মীনার বেডরুমে গিয়ে যা দেখলাম আমার আর্তনাদ করে কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল। আমি দেখলাম অসাড় অনাথের মত বিছানায় পড়ে আছে আমার ছোটবোন মীনা। ওর গা পুড়ে যাচ্ছিল জ্বরে। বিড়বিড় করে কত কী যে বলে যাচ্ছিল।’
‘আমি ওর মাথা আমার কোলে তুলে নিতেই চোখ মেলে তাকালো। দেখলাম, ওর চোখের নিচে খামচির দাগ। গালেও নখের আঁচড় ছিল। মীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাজি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যেতে পারবে? তোমার বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখতে পারবে? ওরা যেন আমাকে খুঁজলেও না পায়। সেদিন রাতে পাশের রুম থেকে আমি মীনার ডুকরে ডুকরে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। ও কখনো জোরে কাঁদছিল, কখনো আস্তে।’
‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম কামাল আমরোহী তার পাশবিকতা নিয়ে চড়াও হয়েছে মীনার উপর। মীনার সৌন্দর্যকে সে রাক্ষসের মত খেয়েছে। মীনার খুব শখ ছিল সোনার অলংকার পরার। কিন্তু কামাল ওর সব গয়না কব্জা করে ফেলেছিল। তার অনুমতি ছাড়া মীনার কোনো গহনা পরার অধিকার ছিল না।’
বলিউড সুপারস্টার সঞ্জয় দত্তের মা নার্গিস দত্ত আরও জানান, ‘মীনার শখ ছিল সোনার ঝুমকার প্রতি। আমি ওকে দুই জোড়া সোনার ঝুমকা উপহার দিয়েছিলাম। সেই ঝুমকা হাতে নিয়ে মীনা অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। ওর এমনই দুর্ভাগ্য ছিল, আমার উপহার দেওয়া ঝুমকা আমারই কাছে গচ্ছিত রাখতে হয়েছিল কামালের ভয়ে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।