জুমবাংলা ডেস্ক: বিদেশি জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে চাষ উপযোগী ‘বারি পাতা পেঁয়াজ-১’ নামক একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, বগুড়া কর্তৃক কৃষকপর্যায়ে চাষাবাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই পেঁয়াজ হেক্টরে পাতার ফলন ৭৫০০-৮৫০০ কেজি ফলন হয়ে থাকে। এগ্রিকেয়ার২৪.কম-এর প্রতিবেদক মো. আলাউদ্দিন খান ও মো. মোস্তাক আহমেদ-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
এ দেশে বাল্ব পেঁয়াজের যথেষ্ট ঘাটতি থাকার কারণে পেঁয়াজের সারাবছর চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে বসতভিটাসহ মাঠপর্যায়ে সারা বছর (Year-round) চাষ করা সম্ভব। আশা করা হচ্ছে এ জাতের পাতা পেঁয়াজ চাষের মাধ্যমে একদিকে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের পরিবর্তেও এটি ব্যবহার করা যাবে এবং অন্যদিকে সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের সঙ্গে সংকরায়নের মাধ্যমেও রোগমুক্ত উন্নত হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। নিচে এ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন কলাকৌশল বর্ণনা করা হলো।
মাটি ও আবহাওয়া
পাতা পেঁয়াজ সব ধরনের মাটিতে জন্মে থাকে তবে বেলে-দো-আঁশ ও পলি-দো-আঁশ মাটিতে ভালো ফলন দিয়ে থাকে। তবে উচ্চ এসিড ও ক্ষার মাটিতে ভালো জন্মে না। গাছ সুন্দরভাবে বৃদ্ধির জন্য মাটির pH ৫.৮-৬.৫ থাকা ভালো। প্রচুর পরিমাণে জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ মাটিই উত্তম। জমিতে জলাবদ্ধতা থাকলে এর মূল মারা যায়। তাই পাতা পেঁয়াজের জমিতে সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। ইহা ঠাণ্ডা ও গরম উভয় তাপমাত্রায় জন্মাতে পারে।
এর বীজ অংকুররোদগম এবং গাছের বৃদ্ধির জন্য ১৫-২৫ক্ক সে. তাপমাত্রা উত্তম। অন্যান্য Allium spp. প্রজাতির তুলনায় এ প্রজাতির পেঁয়াজের গাছ ভারি বৃষ্টির প্রতি অনেক সহিঞ্চু। জমিতে প্রতিষ্ঠিত পাতা পেঁয়াজের গাছ খরার প্রতিও সহিঞ্চু। দিবা দৈর্ঘ্য বেশি হলেও এ পেঁয়াজের গাছের বৃদ্ধি হতে থাকে অর্থাৎ আমাদের দেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও এ পেঁয়াজের চাষ করা যায়। এ প্রজাতির পেঁয়াজে নিম্ন তাপমাত্রা ও ছোট দিনে ফুল আসে।
জাত
বারি পাতা পেঁয়াজ-১ জাতের বৈশিষ্ট্য হলো : প্রথম বছর গাছের উচ্চতা ৪০-৫০ সেমি. প্রতি গোছায় গড়ে কুশির সংখ্যা ৪-৫টি, প্রতি কৃশির গাছে পাতার সংখ্যা ৬-৮টি, বাল্বের মতবৃদ্ধি অংশের উচ্চতা ১.৫০-২.০০ সেমি. ও ব্যাস ১.০০-১.৫০ সেমি., সাদা সিউডোস্টেমের (Blancbed pseudastem) দৈর্ঘ্য ৬-৭ সেমি., ফুলদণ্ডের উচ্চতা ৫০-৫৫ সেমি., আম্বেলের ব্যাস ৩.৫০-৫.০০ সেমি. পাতার শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ ৯.৫০-১১.০০%, পাতার ফলন ৭৫০০-৮৫০০ কেজি/হেক্টর, বীজরে ফলন ৭০০-৯০০ কেজি/হেক্টর, প্রতি ১০০০টি বীজের ওজন গড়ে ২.২৫-২.৭৫ গ্রাম এবং বীজের অংকুরোদম ক্ষমতা গড়ে শতকরা ৮০-৯০ ভাগ। বহুবর্ষজীবী হিসেবে চাষ করলে প্রতি গোছায় কুশির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
বীজ বপন ও চারা উত্তোলন
মে-জুন বা অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা হয়। সারি পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮-১০ কেজি বীজের দরকার হয়। বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে পরে ১২ ঘণ্টা শুকনা পাতলা কাপড়ে বেঁধে রেখে দিলে বীজের অংকুর বাইরে হয়। বীজতলায় পচা গোবর সার দিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করা হয়।
বিভিন্ন ধরনের পোকা ও ক্রিমি দমনের জন্য বীজতলায় ফুরাডান ব্যবহার করাই ভালো। পরে বীজতলায় বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিয়ে আর ওপর ০.৪-০.৫ সেমি. ঝুরঝুরে মাটি প্রয়োগ করে কলাগাছ/হাত দিয়ে বীজতলা চাপ দিতে হয়। বীজতলায় আগাছা নিড়ানোসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা হয়। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে লাগোনো উপযোগী হয়। চারা উত্তোলনের পর চারার ওপর থেকে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছেঁটে ফেলে দিয়ে চারা লাগাতে হয়। এর ফলে লাগানোর পরে চারা থেকে কম পরিমাণে পানি বের হয়ে (Transpiration) চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে উঠে।
জমি তৈরি ও চারা রোপণ
মূল জমিতে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। চাষের আগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পচা গোবর সার দিতে হয়। এ প্রজাতির পেঁয়াজে কুঁশি উৎপাদনের প্রবনতা বেশি থাকায় সাধারণ বাল্ব পেঁয়াজের তুলনায় রোপণ দূরত্ব বেশি দিতে হয়। এর চারা বা কুশি ২০ সেমি.x১৫ সেমি. অথবা ২০ সেমি.x২০ সেমি. দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করা হয়। চারা একটু গভীরে লাগানো ভালো।
সার প্রয়োগ
পাতা সংগ্রহের কারণে পাতা পেঁয়াজে বেশি সারের প্রয়োজন হয়। জমির উর্বরতার ওপর ভিত্তি করে সারের পরিমাণ নিরূপণ করতে হয়। এ জাতের পেঁয়াজ চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিম্নরূপ-
সারের নাম পরিমাণ (কেজি/হেক্টর)
পচা গোবর ৫০০০-১০০০০
ইউরিয়া ২৫০-৩০০
টিএসপি ২৫০-৩০০
এমওপি ২০০-২৫০
জিপসাম ১০০-১২০
জমি চাষের আগে সম্পূর্ণ পচা গোবর সার এবং শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার সমান দুইভাগ করে চারা রোপণের ৩০ ও ৬০ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর প্রয়োজন হলে পানি সেচ দিতে হবে। তবে প্রতিবার পাতা সংগ্রহের পর ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা ভালো।
আগাছা নিড়ানো ও পানি সেচ
আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং মাঝে মাঝে গাছের গোড়ার মাটি তুলে দিতে হবে। আগাছা নিড়ানো ও গোড়ায় মাটি দেয়া ৪-৫ বার প্রয়োজন হতে পারে। সার প্রয়োগের পরপর বা অন্য কোনো সময় পানি দরকার হলে জমিতে সেচ দিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচ বেশি দিতে হয়। জমিতে অতিরিক্ত পানি জমতে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই দমন
পাতা পেঁয়াজ পার্পল বচ ও অন্যান্য ব্লাইট রোগের প্রতি সহিষ্ণু/প্রতিরোধী। তাই রোগ হয় না বললেই চলে। তবে কোনো রোগ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড/ডায়থেন এম-৪৫/রোভরাল এর যে কোনো একটি বা একাধিক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা যেতে পারে। থ্রিপস ও কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। এসব পোকা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে। থ্রিপস দমনের জন্য এডমায়ার বা টিডো (১ মিলি/লিটার) ১৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তাছাড়া রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের জন্য আগাছা পরিষ্কার, আবর্জনা আগুনে পোড়া, শস্যাবর্তন ইত্যাদি সমন্বিত ব্যবস্থ্যা করা উত্তম।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহকালীন সময় এর মাটির ওপরের সম্পূর্ণ অংশ সবুজ ও সতেজ থাকতে হবে। চারা রোপণের দুই মাস পরেই প্রথমে পাতা সংগ্রহ করা যায়। মে-জুন মাসে বীজ বপন করলে নভেম্বর পর্যন্ত গাছ থেকে গড়ে ২-৩ বার পাতা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করলে সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
কারণ ডিসেম্বর থেকে ফুল আসা শুরু হয়। প্রথম সংগ্রহের ২০-২৫ দিন পরপর পাতা সংগ্রহ করা যায়। সাদা সিউডোস্টেমসহ গাছের সব অংশ খাওয়ার জন্য হাত দিয়ে সম্পূর্ণ গাছটি টেনে তুলতে হয়। গাছটি তুলে মূল এবং হলুদ পাতা কেটে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পাতা পেঁয়াজ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই বাজারজাত করা উচিত। ছোট ছোট আঁটি বেধে বাজারে বিক্রয় করা যায়। হেক্টরপ্রতি পাতার ফলন ৭.৫০-৮.৫০ টন কিন্তু সবুজ পাতা ও সাদা সিউডোস্টেমের একত্রে ফলন হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ টন।
বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
মে থেকে নভেম্বর মাসের যখনই বীজ বপন করা হউক না কেন মূল জমিতে রোপণের পর ডিসেম্বর মাসে পাতা পেঁয়াজের ফুল আসা শুরু হয়। তবে বীজতলায় ঘন আকারে চারা থাকলে সিউডোস্টেম ও পাতার উপযুক্ত বৃদ্ধির অভাবে সহজে গাছে ফুল আসে না। ফুল আসার সময় হেক্টরপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি করে ইউরিয়া এবং পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। ইহা পরপরাগায়িত ফসল। তাই জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য একটি জাতের মাঠ থেকে অন্য জাতের মাঠের দূরত্ব কমপক্ষে ১০০০ মিটার বজায় রাখতে হবে। সকল আম্বেলের বীজ একসঙ্গে পরিপক্ব হয় না।
তাই কয়েক দিন পরপর পরিপক্ক আম্বেল সংগ্রহ করা হয়। একটি আম্বেলের মধ্যে শতকরা ১০-১৫টি ফল ফেটে কালো বীজ দেখা গেলে আম্বেলটি কেটে বা ভেঙ্গে সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে মাঠে ঘুরে ঘুরে আম্বেল সংগ্রহ করতে হবে। মাঠের সব আম্বেল সংগ্রহ করতে ৪-৫ দিন সময় লাগতে পারে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সামান্য দেরিতে বীজ সংগ্রহ করলে আম্বেল থেকে সব বীজ ঝরে মাটিতে পড়ে যায়।
পাতা পেঁয়াজের বীজ সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল মাসে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। তবে এর পরেও কিছু বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে। বীজ আম্বেল সংগ্রহ করার পর রোদে শুকিয়ে হালকা লাঠি দ্বারা পিটিয়ে বীজ বের করা হয়। পরে বীজ রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে ছিদ্রবিহীন পলিথিন বা টিনের পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম। হেক্টরপ্রতি ৭০০-৯০০ কেজি বীজ উৎপাদন হয়ে থাকে।
মো. আলাউদ্দিন খান উধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, লালমনিরহাট। মো. মোস্তাক আহমেদ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মসলা গবেষণা উপকেন্দ্র, বিএআরআই, লালমনিরহাট।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।