লাইফস্টাইল ডেস্ক : ফিলিস্তিনের ভূমি একটি অত্যন্ত বরকতময় এবং পুণ্যময় স্থান। এই ভূমি ঐশী বাণী ও নবুয়তের উৎসস্থল ও ফোয়ারা। এই ভূমিতে অনেক নবী-রাসুল এসেছেন। এই সেই ভূমি, যেখান থেকে মেরাজের শুরু এবং শেষ হয়েছে, এটি আসমানের প্রবেশদ্বার।
আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনের ভূমিকে পুণ্য ও বরকতময় ভূমিতে পরিণত করেছেন। (সুরা : আল ইসরা, আয়াত : ১)
ইমাম ইবনে জারির আত তাবারি (রহ.) বলেন : এখানে অনন্ত ও অসীম কল্যাণ ও বরকত থাকবে। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৪৪৮)
আবার কেউ কেউ বলেছেন : বরকতের অর্থ হলো এখানকার নদ-নদী, ফল-ফলাদি, নবী-রাসুল ও ওলিকুল। (ইরাবুল কোরআন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৭)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যে ভূমি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আমি তার চারপাশকে বরকতময় করেছি’ (আল ইসরা, আয়াত-১) তা দ্বারা ফিলিস্তিন ও জর্দান উদ্দেশ্য। (ফাজায়িলু বাইতিল মাকদাস, পৃষ্ঠা ৪৪১)
উল্লেখ্য, হাদিসে ‘সিরিয়া বা শাম’ বলে যে ভূখণ্ডের কথা বলা হয়েছে তার ভৌগোলিক সীমানা সাম্প্রতিক বিভাজনের প্রেক্ষাপটে সিরিয়া বলতে ফিলিস্তিন, বর্তমান সিরিয়া, জর্দান ও লেবানন অঞ্চল উদ্দেশ্য।
কোরআনে পাঁচ স্থানে ফিলিস্তিনের ভূমিকে পুণ্য ও বরকতময় ভূমি বলা হয়েছে। তার মধ্যে এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যাদের দুর্বল মনে করা হতো, আমি তাদের সেই দেশের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী বানালাম, যেথায় আমি বরকত নাজিল করেছিলাম এবং বনি ইসরাঈলের ব্যাপারে তোমার প্রতিপালকের শুভ বাণী পূর্ণ হলো, যেহেতু তারা সবর করেছিল; আর ফিরাউন ও তার সম্প্রদায় যা কিছু বানাত ও যা কিছু চরাত, তা সব আমি ধ্বংস করে দিলাম।’ (সুরা : আল-আরাফ, আয়াত : ১৩৭)
পবিত্র ভূমি
‘আরদে মুকাদ্দাস’ মানে হলো পবিত্র ভূমি। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানি (রহ.) বলেন : বায়তুল মাকদিস হলো শিরক ও কুফর থেকে পবিত্র স্থানের নাম। (তাফসিরে রাগিব ইস্পাহানি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৩৬)
আল্লামা যুজাজ (রহ.) বলেন : পবিত্র ভূমি বলতে দামেস্ক, ফিলিস্তিন এবং জর্দানের কিছু অংশকে বোঝানো হয়েছে। (মাআনিল কোরআন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৬২)
আল্লামা তাকি উসমানি (দা.বা.) বলেন : ‘পবিত্র ভূমি’ দ্বারা শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসুল পাঠানোর জন্য এ ভূমিকে বেছে নিয়েছিলেন। তাই একে ‘পবিত্র ভূমি’ বলা হয়েছে। (তাফসিরে তাওযীহুল কোরআন, পৃষ্ঠা ৩৩৪)
হাশরের ভূমি
আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিনের ভূমিকে ‘হাশরের ভূমি’ বলেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : ‘তিনিই কিতাবের অধিকারীদের মধ্যে যারা কাফির তাদের প্রথম সমাবেশেই তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন।’ (সুরা : আল হাশর, আয়াত : ২)
এখানে ‘প্রথম সমাবেশ’ বলতে শাম দেশে এই ইহুদিদের সমবেত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে, যখন নবী কারীম (সা.) মদিনা থেকে বনু নাজিরকে নির্বাসিত করেছিলেন। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা ২৬২)
আল্লামা জুহরি (রহ.) থেকে বর্ণিত যে প্রথম সমবেতভাবে পৃথিবীতে তাদের নির্বাসন হয়েছিল শামের ভূমিতে। (প্রাগুক্ত)
কোনো বিশেষণ ছাড়াই ফিলিস্তিনের আলোচনা
কোরআনের অনেক জায়গায় ফিলিস্তিনের ভূমির কথা কোনোরূপ বিশেষণ ছাড়াই বলা হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে, ‘আমি (আল্লাহ) কিতাবে মীমাংসা দান করে বনি ইসরাঈলকে অবহিত করেছিলাম, তোমরা পৃথিবীতে দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ঘোর অহংকার প্রদর্শন করবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৪)
আল্লামা শাওকানী (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেছেন যে এখানে ‘পৃথিবী’ বলতে শাম ও বায়তুল মাকদিসকে বোঝানো হয়েছে। (ফাতহুল কাদীর, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৪৯)
অন্য আয়াতে এসেছে, শপথ ‘তীন’ (ডুমুর) ও ‘জায়তুন’ (জলপাই) বৃক্ষের এবং সিনাই প্রান্তরস্থ তুর পর্বতের। (সুরা : আত ত্বিন, আয়াত : ১, ২)
অধিকাংশ তাফসিরবিশারদ বলেন : এখানে ‘তীন’ ও ‘জায়তুন’ দ্বারা সে স্থান বোঝানো হয়েছে, যেখানে এ বৃক্ষ প্রচুর পরিমাণ উৎপন্ন হয়। আর সে স্থান হচ্ছে শাম দেশ ও ফিলিস্তিন, যা নবীদের আবাসভূমি। (আদ দুররুল মানসুর, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৫৫৪)
ফিলিস্তিনের কতিপয় অঞ্চলের বিবৃতি
কোরআনে ফিলিস্তিনের কতিপয় এলাকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, উদাহরণস্বরূপ—
১. এবং আমি মরিয়মের পুত্র ও তার মাকে (অর্থাৎ ঈসা ও মরিয়ম আলাইহিমাস সালামকে) বানিয়েছিলাম এক নিদর্শন এবং তাদের এমন এক উচ্চভূমিতে আশ্রয় দিয়েছিলাম, যা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং যেখানে প্রবাহিত ছিল স্বচ্ছ পানি। (সুরা : আল মুমিনুন, আয়াত : ৫০)
এখানে ‘উচ্চভূমি’ দ্বারা ‘রামলাহ’ উদ্দেশ্য, যা ফিলিস্তিনের একটি অঞ্চলের নাম। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা ৫৩)
২. অতঃপর এই ঘটল যে মরিয়ম সেই শিশুকে গর্ভে ধারণ করল (এবং যখন জন্মের সময় কাছে এসে গেল) তখন সে তাকে নিয়ে দূরে এক নিভৃত স্থানে চলে গেল। (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ২২)
মুফাসসিররা এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন যে মরিয়ম (আ.) গর্ভবতী হলে দূরবর্তী স্থানে চলে যান। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন : তিনি আল আকসা উপত্যকায় গিয়েছিলেন আর এটিই হলো ‘বেথলেহেম’। ‘বেথলেহেম’ এবং ‘ইলিয়া’ এর মধ্যে চার মাইল দূরত্ব রয়েছে। আর ‘ইলিয়া’-এর অপর নাম হলো বায়তুল মাকদিস। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ১৫, পৃষ্ঠা ৪৯২)
৩. এবং (সেই কথাও স্মরণ করো) যখন আমি বলেছিলাম, এই জনপদে প্রবেশ করো এবং তার যেখান থেকে ইচ্ছা প্রাণভরে খাও। আর (জনপদের) প্রবেশদ্বার দিয়ে নতশিরে প্রবেশ করবে আর বলতে থাকবে, (হে আল্লাহ!) আমরা আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। (এভাবে) আমি তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করব এবং পুণ্যবানদের আরো বেশি (সওয়াব) দেব। (সুরা : আল বাকারা, আয়াত : ৫৮)
এই জনপদের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে, এখানে ‘জনপদ’ মানে বায়তুল মাকদিস। (আদ দুররুল মানসুর, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭২)
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত : এখানে ‘দরজা’ বলতে বায়তুল মাকদিসের ‘বাবে হুত্তা’ উদ্দেশ্য। (তাফসিরে তাবারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১০৩)
৪. অতঃপর তালুত যখন সৈন্যদের সঙ্গে রওনা হলো, তখন সে (সৈন্যদের) বলল, আল্লাহ একটি নদীর দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। (সুরা : আল বাকারা, আয়াত : ২৪৯)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন যে এখানে নদী বলতে জর্দান ও ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী নদীকে বোঝানো হয়েছে।
(আদ দুররুল মানসুর, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭৫৯)
৫. একদিন যখন তারা পিঁপড়ার উপত্যকায় পৌঁছাল, তখন এক পিঁপড়া বলল, ওহে পিঁপড়ারা! নিজ ঘরে ঢুকে পড়ো, পাছে সুলাইমান ও তার সৈন্যরা তাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদের যাতে পিষে না ফেলে। (সুরা : আন নামল, আয়াত : ১৮)
ইমাম রাজি (রহ.) বলেন : এখানে ‘পিঁপড়ার উপত্যকা’ দ্বারা ‘শামের উপত্যকা’কে বোঝানো, যেখানে পিঁপড়ার আধিক্য বেশি আর এটি ‘আসকেলন (Ashkelon)’ উপত্যকার আশপাশে অবস্থিত। (মাফাতিহুল গায়েব, খণ্ড ২৪, পৃষ্ঠা ৫৪৮)
ইসকনদের পেছনে দেশ ও দেশের বাইরের ইন্ধন রয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এই পবিত্র ভূমি, যার পবিত্রতা ও বরকত পবিত্র কোরআনে বারবার বলা হয়েছে, মুসলমান হিসেবে যার উত্তরাধিকার পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভূমি মুসলমানদের দ্বারা অত্যন্ত বরকতময় ও পবিত্রতার আবরণে শাসিত হয়েছে; কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ভুলে গেছি, যার কারণে ইসরায়েলের অপবিত্র ইহুদিরা এই পবিত্র ও পুণ্য ভূমি জবরদখল করে এখানকার মুসলিমদের ওপর বর্বর ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং হামলা চালাচ্ছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের উচিত এর পবিত্রতা বুঝে এই পবিত্র স্থানটি পুনরুদ্ধারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা ফিলিস্তিন মুসলিমদের হেফাজত করুন ও বিজয় দান করুন। আমিন।
আসআদ শাহীন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।