বাংলাদেশের মাটি আর মানুষের সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্পর্ক পুরোনো, অম্লমধুর। মনে পড়ে সেই ভয়াল রাতের কথা? যখন ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রচণ্ড গর্জনে কেঁপে উঠেছিল উপকূল, বা বন্যায় ভেসে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের গ্রামের পর গ্রাম? হঠাৎ আসা সেই দুর্যোগের মুখে অসহায়ত্বের গ্লানি এখনো বাজে অনেকের বুকে। কিন্তু জানেন কি, সঠিক প্রস্তুতি আর সচেতনতাই পারে সেই অসহায়ত্বকে জয় করতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল রপ্ত করাটা এদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য শুধু প্রয়োজনীয়তাই নয়, বরং এক বেঁচে থাকার অপরিহার্য দক্ষতা। এটি শুধু নিজের জন্য নয়, প্রিয়জনের জীবন বাঁচানোর হাতিয়ারও বটে।
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিএমডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন (২০২৪) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে দুর্যোগের তীব্রতা ও পুনরাবৃত্তি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত দশকে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগে গড়ে বছরে প্রায় ১ হাজার প্রাণহানি ঘটেছে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক লাখ পরিবার। কিন্তু আশার কথা, সঠিক প্রস্তুতি ও দ্রুত সাড়াদান প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল ৯০% পর্যন্ত প্রাণহানি ও সম্পদ ক্ষতি কমানো সম্ভব করে তোলে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ফণীতে প্রাথমিক সতর্কতা ও দ্রুত সরানোর ফলে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল: একটি জীবনরক্ষাকারী গাইড
বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বহুমুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয় – ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, খরা, এমনকি হিমবাহ গলে যাওয়ার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিও ক্রমাগত বাড়ছে। এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনে প্রয়োগের বিষয়। এটি শুরু হয় দুর্যোগের ধরন বুঝে তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার মাধ্যমে। প্রতিটি দুর্যোগের নিজস্ব চরিত্র ও বিপদ আছে, তাই কৌশলও কিছুটা ভিন্ন হয়। তবে কিছু মৌলিক প্রস্তুতি সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় ভিত্তি তৈরি করে।
দুর্যোগের ধরনভেদে প্রস্তুতি: ঝড়, বন্যা, ভূমিকম্পে কী করবেন?
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস:
- সতর্কতা সংকেত জানুন: ১ থেকে ১১ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের অর্থ ভালো করে আত্মস্থ করুন। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (ডিএমডি) এর ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ও সর্বশেষ সংকেত পাওয়া যায়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এর নিয়মিত আপডেট অনুসরণ করুন।
- নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র চিহ্নিত করুন: আপনার সবচেয়ে কাছের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র (সাইক্লোন শেল্টার) কোথায়, কীভাবে সেখানে যাবেন, রাস্তা চিনে রাখুন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে এই তথ্য নিন। শেল্টারে যাওয়ার রাস্তায় উঁচু, মজবুত স্থানগুলোও চিনে রাখুন।
- সময়মতো সরান: ‘রেড অ্যালার্ট’ বা ‘গ্রেট ডেঞ্জার’ সিগন্যাল দিলে দেরি না করে অবিলম্বে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। মনে রাখবেন, জলোচ্ছ্বাস সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের চোখ অতিক্রম করার পর আসে। “এবারের ঝড়টা হয়তো সামলাতে পারব” – এমন ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
- আশ্রয়কেন্দ্রে যা নেবেন: শুধু অত্যাবশ্যকীয় জিনিস (জরুরি কিট, কিছু শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র) নিন। ভারী আসবাব বা মূল্যবান জিনিস ফেলে যান – জীবন সবচেয়ে মূল্যবান।
- বাড়িতে থাকলে: সবচেয়ে মজবুত কক্ষে (সাধারণত গোসলখানা বা সিঁড়ির নিচে) আশ্রয় নিন। জানালা-দরজা শক্ত করে বন্ধ করুন, শিক এঁটে দিন। বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ অফ করুন। উঁচু টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিন।
বন্যা:
- পূর্বাভাস মনোযোগ দিয়ে শুনুন: বিএমডি এবং ফ্লাড ফোরকাস্টিং ওয়ার্নিং সেন্টার (FFWC) এর বন্যা পূর্বাভাস নিয়মিত অনুসরণ করুন। ফ্লাড ফোরকাস্টিং ওয়ার্নিং সেন্টার এর ওয়েবসাইটে বর্তমান পরিস্থিতি জানতে পারেন।
- উঁচু স্থানে সরান: বন্যার পানি বাড়ার পূর্বাভাস পেলে বা আশঙ্কা করলে দ্রুত নিকটস্থ উঁচু ও নিরাপদ স্থানে (স্কুল ভবন, কমিউনিটি সেন্টার, উঁচু সড়কের পাশের বিল্ডিং) চলে যান।
- জরুরি কিট ও মূল্যবান জিনিস উঁচুতে রাখুন: খাদ্য, পানি, ওষুধ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, কিছু নগদ টাকা প্লাস্টিকে মুড়ে বা ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে ভরে বাড়ির সবচেয়ে উঁচু স্থানে (যেমন আটচালা বা টিনের চাল) রাখুন।
- সাঁতারের প্রাথমিক কৌশল রপ্ত করুন: বিশেষ করে শিশুদের। বন্যাকবলিত এলাকায় সাঁতার জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- বন্যার পানি এড়িয়ে চলুন: দূষিত পানি থেকে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, লেপ্টোস্পাইরোসিসের মতো রোগ ছড়ায়। বিশুদ্ধ পানি পান করুন। পানি ফুটিয়ে পান করাই সবচেয়ে নিরাপদ। হাঁটু বা তার বেশি গভীর পানিতে হাঁটাচলা এড়িয়ে চলুন – নিচে খালি পায়ে হারানো খুঁটি বা ময়লা-আবর্জনার আঘাত লাগতে পারে।
ভূমিকম্প (সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত, তাই প্রস্তুতি জরুরি):
- ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন: ভূমিকম্পের সময় প্রথম কাজই হলো মাথা ও ঘাড় রক্ষা করা।
- ড্রপ (ঝুঁকে পড়ুন): সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ুন যাতে কম্পনে আছড়ে না পড়েন।
- কাভার (আড়াল নিন): শক্ত টেবিল, ডেস্ক বা খাটের নিচে ঢুকে পড়ুন। আশেপাশে শক্ত কোনও আসবাব না থাকলে দেয়ালের পাশে বসে হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে নিন (অভ্যন্তরীণ দেয়ালগুলো সাধারণত একটু বেশি শক্ত হয়)। জানালা, আলমারি, ভারী ফ্রেম, ফ্যান থেকে দূরে থাকুন।
- হোল্ড অন (আঁকড়ে ধরে থাকুন): যে আশ্রয়স্থল বেছে নিলেন, তা যাতে কম্পনে সরে না যায়, তা ধরে রাখুন কম্পন থামা পর্যন্ত।
- বিল্ডিং থেকে বের হবেন না: কম্পন চলাকালীন সিঁড়ি বা লিফট ব্যবহার করে নামার চেষ্টা করবেন না। ভূমিকম্পের পরপরই আফটারশক আসতে পারে। শুধুমাত্র বের হওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও নিরাপদ মনে হলে এবং বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত কিন্তু সতর্কতার সাথে বের হোন।
- আগুন নেভানোর উপায় জানুন: ভূমিকম্পের পর বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা গ্যাস লাইনে ফুটো থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থাকে। মেইন গ্যাস লাইন ও বিদ্যুৎ বন্ধ করার উপায় আগে থেকেই জেনে রাখুন।
অপরিহার্য প্রস্তুতি: দুর্যোগ আসার আগেই যা করতে হবে
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল এর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি দুর্যোগ আসার আগেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
জরুরি যোগাযোগ পরিকল্পনা তৈরি করুন:
- পরিবারের সব সদস্যের জন্য জরুরি যোগাযোগের নম্বরগুলোর (বাড়ি, মোবাইল, অফিস) একটি লিস্ট তৈরি করুন, প্রত্যেকের কাছে রাখুন (ওয়ালেটে, স্কুল ব্যাগে)।
- নির্ধারণ করুন দুর্যোগের সময় কোথায় মিলিত হবেন (বাড়ির কাছের নির্দিষ্ট স্থান যেমন স্কুল মাঠ বা মসজিদ) যদি বাড়িতে যোগাযোগ করা না যায়।
- স্থানীয় জরুরি সেবার নম্বর (ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স) এবং জাতীয় হেল্পলাইন নম্বর (৯৯৯) সবাইকে জানান।
- স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখুন, তাদের নির্দেশনা জানুন।
জরুরি প্রস্তুতি কিট (ইমার্জেন্সি কিট) তৈরি করুন ও হাতের কাছে রাখুন: এই কিটটি এমন জায়গায় রাখুন যেখানে সহজেই পাওয়া যাবে এবং তাড়াতাড়ি নিয়ে বের হওয়া সম্ভব (যেমন বেডরুমের দরজার পাশে)। কিটে যা থাকা আবশ্যক:
আইটেমের ধরন অন্তর্ভুক্ত আইটেম মন্তব্য জল ও খাদ্য প্রতি জনের জন্য ৩ দিনের খাবার (অপচয়হীন, সহজে খাওয়া যায় যেমন বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, শুকনো খাবার, টিনজাত খাবার)
প্রতি জনের জন্য ৩ দিনের পানি (প্রতিদিন ৪ লিটার হিসাবে, মোট ১২ লিটার)। ওয়াটার পিউরিফাইয়িং ট্যাবলেট বা ফিল্টার।খাবার নিয়মিত চেক করে এক্সপায়ারি ডেট দেখুন। পানি প্রতি ৬ মাসে পরিবর্তন করুন। চিকিৎসা সরঞ্জাম ফার্স্ট এইড বক্স (ব্যান্ড-এইড, গজ, তুলা, ডেটল/স্যাভলন, ক্রেপ ব্যান্ডেজ, কাঁচি, পিন)
নিয়মিত সেবন করা ওষুধ (অন্তত ৭ দিনের মজুদ)
* পেইন কিলার, পেটের ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন।ওষুধের নাম ও মাত্রা লিখে রাখুন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের কপি রাখুন। নথিপত্র জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ, শিক্ষা সনদ, জমির দলিলের ফটোকপি (ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে)
জরুরি যোগাযোগ নম্বরের তালিকা।মূল কাগজপত্র আগে থেকেই নিরাপদ স্থানে (ব্যাংক লকার) রাখুন। টুলস ও জরুরি সামগ্রী টর্চলাইট (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ)
ম্যানুয়াল রেডিও (ব্যাটারিচালিত)
সুইচ ব্লেড/মাল্টি-টুল
ম্যাচ/লাইটার, মোমবাতি
হুইসেল (সাহায্যের জন্য সংকেত দিতে)
স্থানীয় মানচিত্র
* কাপড়ের দড়ি।ব্যাটারিচালিত রেডিও দুর্যোগের সময় তথ্যের প্রধান উৎস। হুইসেল তিনবার বাজানো সাহায্যের আন্তর্জাতিক সংকেত। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সাবান, স্যানিটাইজার, টুথব্রাশ-পেস্ট
মশারি, মশা তাড়ানোর ক্রিম
মহিলাদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন
শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস (ডায়াপার, দুধ, ওষুধ)।স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা রোগ প্রতিরোধের চাবিকাঠি। বাড়ি ও আশপাশ নিরাপদ করুন:
- ছাদে, বারান্দায় বা উঠানে ভাঙাচোরা, উড়ে যেতে পারে এমন জিনিস (ফুলের টব, ভাঙা ইট, ডাবের খোল) রাখবেন না।
- বাড়ির গাছের ডালপালা ছাঁটাই করুন যাতে ঝড়ে ভেঙে বাড়ির ক্ষতি না করে।
- বাড়ির মজবুত কাঠামো কোথায় তা জেনে রাখুন (ভূমিকম্পের জন্য)। ভারী আসবাবপত্র (আলমারি, ফ্রিজ) দেয়ালে বোল্ট দিয়ে শক্ত করে আটকান যাতে ভূমিকম্পে উল্টে না পড়ে।
- বিদ্যুৎ, গ্যাসের লাইন ও মিটার সঠিক জায়গায় আছে কিনা পরীক্ষা করুন। মেইন সুইচ ও গ্যাস ভালভ বন্ধ করার জায়গা সবাইকে শিখিয়ে দিন।
- আগুন নেভানোর জন্য বাড়িতে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখুন এবং ব্যবহার শিখুন।
- জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করুন:
- স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিআরসিএস) বা এনজিওদের আয়োজিত দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া প্রশিক্ষণে অংশ নিন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রায়ই কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেয়।
- ফার্স্ট এইড (প্রাথমিক চিকিৎসা) এবং সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) শিখুন। একটি মাত্র প্রশিক্ষণ কারও জীবন বাঁচাতে পারে।
- স্থানীয় দুর্যোগের ইতিহাস জানুন – কোন এলাকা বন্যা প্রবণ, কোন দিকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আশপাশের ভবনগুলোর অবস্থা কেমন।
দুর্যোগের সময়ে করণীয়: শান্ত থাকুন, দ্রুত সাড়া দিন
দুর্যোগ আঘাত হানার মুহূর্তে আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকা এবং পূর্ব-পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়াই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল এর সফল বাস্তবায়ন। ধৈর্য ধারণ করুন এবং সতর্কতার সাথে কাজ করুন:
- স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসরণ করুন: রেডিও (বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতার), টিভি, বা স্থানীয় প্রশাসনের মাইকের ঘোষণা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাদের দেওয়া নির্দেশনা (যেমন: কোন শেল্টারে যেতে হবে, কোন রাস্তা ব্যবহার করতে হবে) অবশ্যই পালন করুন।
- জরুরি কিট সাথে নিন: বাড়ি ছাড়ার সময় আপনার প্রস্তুতকৃত জরুরি কিটটি অবশ্যই সাথে নেবেন।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধ করুন: বের হওয়ার আগে মেইন বিদ্যুৎ সুইচ এবং গ্যাসের প্রধান ভালভ বন্ধ করে দিন। এতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমে।
- পানির উৎসের দিকে সতর্কতা: বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের সময় নদী, খাল বা প্রবাহিত পানির দিকে ভিড় করবেন না। পানির স্রোত অনেক শক্তিশালী হতে পারে।
- গুজব এড়িয়ে চলুন: দুর্যোগের সময় নানা রকম গুজব ছড়ায়। শুধুমাত্র সরকারি বা স্বীকৃত সংস্থার (বিবিসি, বাংলাদেশ বেতার, প্রধান পত্রিকা/নিউজ পোর্টাল) তথ্য বিশ্বাস করুন। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল খবর যাচাই না করে শেয়ার করবেন না।
- অন্যদের সাহায্য করুন: যদি আপনি নিরাপদে থাকেন, তাহলে প্রতিবেশী, বিশেষ করে বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী মহিলা বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপদ স্থানে যেতে সাহায্য করুন। একসাথে থাকলে সাহায্য পাওয়া ও দেওয়া সহজ হয়।
দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয়: পুনরুদ্ধার ও সতর্কতা
দুর্যোগ কেটে গেলেও বিপদ শেষ হয় না। ভাঙা বাড়ি, দূষিত পানি, বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়া, পচনশীল আবর্জনা – এসব নতুন বিপদ ডেকে আনে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল দুর্যোগ পরবর্তী সময়টিকেও কভার করে:
- নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন ফিরে: বাড়িতে ফেরার আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেতের (নিরাপদ ঘোষণা) অপেক্ষা করুন। ভবন প্রবেশের আগে ভালো করে দেখুন কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিনা (দরজা-জানালা বেঁকে গেছে কিনা, দেয়ালে ফাটল, ছাদ ঝুলছে কিনা)। সন্দেহ হলে প্রবেশ করবেন না।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন চেক করুন: বাড়িতে প্রবেশের পর বিদ্যুতের তার বা গ্যাসের লাইনে কোন ক্ষতি বা ফুটো আছে কিনা পরীক্ষা করুন। গ্যাসের গন্ধ পেলে মেইন সুইচ বন্ধ করুন, জানালা খুলে দিন, দ্রুত বের হয়ে যান এবং কর্তৃপক্ষকে জানান। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ভেজা অবস্থায় স্পর্শ করবেন না।
- পানি ফুটিয়ে পান করুন: বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী সময়ে পানি সরবরাহ লাইন দূষিত হয়। পানি অবশ্যই ফুটিয়ে অথবা ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট/ফিল্টার ব্যবহার করে পান করবেন। বোতলজাত পানি সবচেয়ে নিরাপদ।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: আবর্জনা দ্রুত অপসারণ করুন, বিশেষ করে পচনশীল আবর্জনা যাতে মশা-মাছির উপদ্রব না বাড়ে। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা দেখুন। হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখুন।
- মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন: দুর্যোগ মানসিক আঘাত দেয়। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মানসিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখুন। ভয়, দুঃখ, রাগ স্বাভাবিক। কথা বলুন, একে অপরকে সাহায্য করুন। প্রয়োজনে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইনের সাহায্য নিন।
- ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন ও সাহায্য প্রাপ্তি: সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য প্রাপ্তির জন্য ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করুন (ফটো সহ)। স্থানীয় প্রশাসন বা ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করে সাহায্য প্রাপ্তির প্রক্রিয়া জানুন।
শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ প্রয়োজন
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বিশেষভাবে বিবেচনা করে:
শিশুরা:
- তাদেরকে দুর্যোগ সম্পর্কে বয়সোপযোগীভাবে বুঝিয়ে বলুন, ভয় দেখাবেন না।
- জরুরি কিটে তাদের প্রিয় খেলনা, বই, খাবার রাখুন (প্রয়োজনীয় ওষুধ, দুধ, ডায়াপার তো থাকবেই)।
- দুর্যোগের সময় তাদের কাছাকাছি থাকুন, আশ্বস্ত করুন।
- আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দিন।
- দুর্যোগ পরবর্তীতে তাদের আচরণে পরিবর্তন (বিষণ্ণতা, দুঃস্বপ্ন, ভয়) দেখলে মনোযোগ দিন।
- বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি:
- তাদের সরানোর জন্য আগে থেকেই পরিকল্পনা করুন – কে সাহায্য করবে, কীভাবে নেবেন (চেয়ার, স্ট্রেচার প্রয়োজন হতে পারে)?
- জরুরি কিটে তাদের বিশেষ ওষুধ, চশমা, হিয়ারিং এইড, হাঁটার ছড়ি, হুইলচেয়ারের অতিরিক্ত ব্যাটারি ইত্যাদি রাখুন।
- যোগাযোগের তালিকায় তাদের ডাক্তার ও কেয়ারগিভারের নম্বর রাখুন।
- আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা বা সহায়তা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করুন।
সম্প্রদায়ের ভূমিকা: একতাই শক্তি
দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যক্তি পর্যায়ের প্রস্তুতির পাশাপাশি সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সংগঠন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। এটিও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল এর অংশ।
- স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি (ইউডিসিসি/ইউপিডিসিসি): আপনার ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে এই কমিটি থাকে। তাদের সাথে যুক্ত হোন, সভায় অংশ নিন। দুর্যোগ ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, প্রস্তুতি পরিকল্পনা তৈরি, সতর্কতা বার্তা প্রচার এবং উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
- প্রতিবেশীদের সাথে পরিকল্পনা: প্রতিবেশীদের সাথে আলোচনা করুন – দুর্যোগে কে কার সাহায্য করবে (বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী প্রতিবেশী), কীভাবে যোগাযোগ রাখবেন, কোথায় মিলিত হবেন। একটি সহায়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করুন।
- মোবাইল ভিত্তিক তথ্য আদান-প্রদান: স্থানীয় গ্রুপ মেসেজিং অ্যাপ (মেসেঞ্জার গ্রুপ) তৈরি করুন দুর্যোগের সময় দ্রুত তথ্য ও সাহায্যের আবেদন শেয়ার করার জন্য।
- স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হোন: বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিআরসিএস), সিএমপি, ব্র্যাক, কারিতাসের মতো সংগঠন স্থানীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণ নিন, সাহায্য করার সক্ষমতা বাড়ান।
- সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: দুর্যোগ প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করুন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, স্কুল, সামাজিক অনুষ্ঠানে। সচেতনতা ছড়িয়ে দিন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের নিয়তি নয়, বরং এক কঠিন বাস্তবতা যার মোকাবেলায় প্রস্তুতি ও জ্ঞানই আমাদের প্রধান সম্বল। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস শুনে সময়মতো আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানো, বন্যার পানি আসার আগে মূল্যবান জিনিসপত্র উঁচুতে তুলে রাখা, ভূমিকম্পের সময় ‘ড্রপ, কভার, হোল্ড অন’ পদ্ধতি অনুসরণ করা – এসবই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁচার কৌশল এর অপরিহার্য অধ্যায়। এই কৌশলগুলো কোনো একক ব্যক্তির জন্য নয়, পুরো পরিবার ও সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য। আপনার আজকের গৃহীত পদক্ষেপ – জরুরি কিট তৈরি করা, যোগাযোগের পরিকল্পনা করা, স্থানীয় কমিটির সাথে যুক্ত হওয়া – আগামীকাল আপনার এবং আপনার প্রিয়জনের জীবন বাঁচাতে পারে। দুর্যোগ আসবেই, কিন্তু প্রস্তুত মানুষ হিসেবে আমরা তা মোকাবেলা করে টিকে থাকব। আজই শুরু করুন, নিরাপদ থাকুন, এবং অন্যদেরও নিরাপদ থাকতে সাহায্য করুন। দুর্যোগে প্রস্তুতিই প্রাণ বাঁচায়।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাড়িতে থাকা কি নিরাপদ?
না, সাধারণত নিরাপদ নয়, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ড বাতাস, ভারী বৃষ্টি এবং বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাস কাঁচা বা দুর্বল পাকা বাড়ি ধ্বংস করে দিতে পারে। সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে সরকারি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়া। যদি কোনো কারণে শেল্টারে যেতে না পারেন, তবে নিজ বাড়ির সবচেয়ে মজবুত কক্ষে (সাধারণত সিঁড়ির নিচের অংশ বা গোসলখানা) আশ্রয় নিন এবং জানালা-দরজা শক্ত করে বন্ধ করুন।
২. বন্যার সময় পানি ফুটানোর পরও কি তা পান করা নিরাপদ?
হ্যাঁ, ফুটানো পানি সাধারণত নিরাপদ পান করার জন্য। পানি কমপক্ষে ১ মিনিট জোরালো ফোটাতে হবে (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচুতে হলে আরও কিছুক্ষণ বেশি)। এতে বেশিরভাগ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু মারা যায়। তবে পানি দৃশ্যত খুব ঘোলা বা দূষিত মনে হলে, ফুটানোর পরও তা পান না করাই ভালো। বোতলজাত পানি বা সরকারি/বেসরকারি সংস্থা সরবরাহকৃত শুদ্ধ পানি সবচেয়ে ভালো বিকল্প।
৩. ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা যাবে কি?
কখনোই না! ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে, লিফট আটকে যেতে পারে বা পড়ে যেতে পারে। ভূমিকম্পের সময় বা পরপরই আফটারশক আসতে পারে। সবসময় সিঁড়ি ব্যবহার করুন, তবে শুধুমাত্র তখনই যখন সিঁড়ি পরিষ্কার ও নিরাপদ আছে বলে নিশ্চিত হতে পারবেন এবং বিল্ডিং ছেড়ে বের হওয়া জরুরি।
৪. জরুরি কিটে নগদ টাকা রাখা কেন জরুরি?
দুর্যোগের পরপরই এটিএম বা ব্যাংক কার্ড সিস্টেম কাজ নাও করতে পারে। দোকানপাট খোলা থাকলে নগদ টাকায় জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিস (ঔষধ, খাবার, ব্যাটারি) কেনা সম্ভব হতে পারে। তাই কিছু নগদ টাকা (ছোট নোটে) জরুরি কিটে ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে ভরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. দুর্যোগের সময় পোষা প্রাণীর যত্ন কীভাবে নেব?
পোষা প্রাণীর জন্যও প্রস্তুতি নিন। আশ্রয়কেন্দ্রে সাধারণত পোষা প্রাণী নেওয়ার অনুমতি থাকে না। তাই আগে থেকেই নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি (যে নিরাপদ এলাকায় থাকবে) ঠিক করুন যেখানে দুর্যোগের সময় আপনার পোষা প্রাণীকে রেখে আসতে পারবেন। তাদের জন্য আলাদা জরুরি কিট (কয়েক দিনের খাবার, পানি, ওষুধ, পরিচয় ট্যাগ) প্রস্তুত রাখুন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে তাদের নিরাপদ স্থানে রেখে আসুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।