আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এশিয়ার সিংহভাগ দেশের প্রধান খাদ্য ভাত। সারা বিশ্বের ৯০ শতাংশ চাল উৎপাদন হয় এশিয়ায়। তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দশকে মানুষ বাড়লেও কমবে চালের উৎপাদন।
সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাচার ফুড জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ার জনসংখ্যা বেড়ে হবে ৫.৩ বিলিয়ন। এছাড়া আফ্রিকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে আড়াই বিলিয়নে। এতে করে চালের চাহিদা বাড়বে ৩০ শতাংশ।
কিন্তু যেভাবে জলবায়ু সংকট বিশ্বকে বিপর্যস্ত করছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে চালের উৎপাদন আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থার (এফএও) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত দশকে চালের উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ০.৯ শতাংশ, যা এর আগের দশকের তুলনায় কম। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ধানের উৎপাদন ১ শতাংশ হারে কমে এসেছে।
ন্যাচার ফুড স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুসারে, যেখানে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোকে আগে চাল আমদানি করতে হতো না, সেখানে দিনকে দিন তারা চালে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ অঞ্চলের ৪শ মিলিয়ন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়।
১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সংস্থা (আইআরআরআই) নিজেদের ধানের জাত আইআর-৮ আবিষ্কার করে। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এ জাতের ধান উৎপাদনকে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব বলা যায়। চীন যখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে, ভারতেরও যখন একই অবস্থা, তখন ফিলিপাইনে অবস্থিত এ নতুন জাতের ধান হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল। বর্তমান সময়ে এসে জলবায়ু সংকটের বিরূপ প্রভাব প্রতিহত করতে আইআরআরআই নতুন জাতের ধান উৎপাদনে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভূমি সংকট। অন্যতম চাল উৎপাদনকারী দেশ ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে দেশটির মাথাপিছু আবাদি জমি ছিল ২.৩ হেক্টর, যা ২০১৬ সালে কমে হয়েছে ১.১ হেক্টর। এমন অবস্থায় প্রশ্ন ওঠেছে, যদি জমিই না থাকে তাহলে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করে কদ্দূর পিঠ রক্ষা করা যাবে।
আবাদি জমি কমার পশাপাশি এশিয়ায় ক্ষেতে কাজ করার কৃষকের পরিমাণ দিনকে দিন কমে আসছে। কৃষিকাজ লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা নিজেদের পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া প্রায় প্রতি বছরের খরা, ভূমিক্ষয়, অত্যধিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে চাল উৎপাদন।
আইআরআরআইয়ের গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে চালের আবাদ। সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে চালের আবাদ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে আবাদি জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়বে। এতে করে চালের আবাদ বড় রকমের হুমকির মুখে পড়বে। এসবের বাইরেও যে হারে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ হচ্ছে, তাতে করেও চালের আবাদ বড় রকমের নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে পড়বে বলে গবেষণাপত্রটিতে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। গত বছরেই চাল রফতানিতে চতুর্থ বৃহত্তর দেশ পাকিস্তানে বন্যায় ১৫ শতাংশ চালের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে ধান চাষের জমিতে তৈরি হচ্ছে মিথেন গ্যাস। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া এ গ্যাস গ্রিন হাউস গ্যাসের মধ্যে বিপজ্জনক একটি। অর্থাৎ যে গ্রিন হাউসের জন্য ধান চাষ হুমকির মুখে সেই ধানক্ষেতই প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করছে বিষাক্ত এ গ্যাস। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১২ শতাংশ মিথেন নিঃসরিত হয় ধানক্ষেত থেকে। এছাড়া বৈশ্বিক দেড় শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাসের জন্য দায়ী ধানক্ষেত নিজেই। ভিয়েতনামের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশটিতে যানবাহন থেকে যতটা না মিথেন গ্যাস নিঃসৃত হয়, তার থেকেও বেশি নিঃসৃত হয় ধানক্ষেত থেকে।
বাংলাদেশে উল্টো চিত্র
সম্প্রতি বার্তাসংস্থা ইকনোমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংকটের পূর্বাভাস পেলেও এশিয়ার দেশগুলো এখন পর্যন্ত বিকল্প কোনো পথে হাঁটতে পারছে না। তবে এর মধ্যে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশে আবিষ্কৃত সাব-১ জাতের ধান বন্যা সহনশীল। এ জাতের ধান উৎপাদনে ফলন ৬ শতাংশ ও মুনাফা ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ধানের উৎপাদন ৪০.৭ মিলিয়ন টন, ২০৪০ সালের মধ্যে ৪৩.৯ মিলিয়ন টন ও ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৬.৭ মিলিয়ন টন হবে বলে জানায় বিআরআরআই।
অন্যদিকে উৎপাদন বাড়লেও মাথাপিছু চালের চাহিদা কমছে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৪৮ কেজি, যা ২০৪০ সালের মধ্যে কমে হবে ১৩৩ কেজি। একদিকে চাহিদার কমতি, অন্যদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির সুবিধা হিসেবে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে চাল রফতানি করতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট গবেষক ও ব্যবসা বিশ্লেষকরা।
তবে এশিয়ার অনেক দেশের কৃষক শিক্ষিত ও সচেতন না হওয়ায় ধানের ভালো জাত সম্পর্কে ধারণা নেই তাদের। এখনও অনেক কৃষক মান্ধাতার আমলের রীতিতে ধান চাষ করেন, যা অনেক সময়ই প্রত্যাশিত ফলাফল দেয় না। এক্ষেত্রে চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সরকার ও কর্তাব্যক্তিদের ভালো উৎপাদনের দিকে নজর দিতে কৃষক ও আবাদি জমির ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এশিয়ার মাথাপিছু চাল ব্যবহারের পরিমাণ ৭৭ কেজি। অর্থাৎ একজন এশিয়ান বছরের ৭৭ কেজি চালের ভাত খেয়ে থাকেন, যা সম্মিলিতভাবে ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার থেকেও অনেক বেশি। চালের ওপর এত বেশি নির্ভরশীলতা কমাতে জাতিসংঘ অনেকটা এশিয়ার পরিস্থিতি মাথায় রেখে ২০২৩ সালকে ভুট্টার ফলনের সাল হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বের ধান উৎপাদনকারী দেশ ভারত তাদের কৃষকদের চালের বদলে ভুট্টা উৎপাদনে বেশি অনুপ্রাণিত করছে।
এশিয়ার উৎপাদিত অরিজিয়া সাটিভা জাতের ধানকে অনেক দেশেই পূজনীয় খাবার হিসেবে ধরা হয়। ভারতে দেবী অন্নপূর্ণা, ইন্দোনেশিয়ায় দেবী শ্রী ও জাপানের ইনারি দেবীকে বলা হয় ভাতের দেবী অর্থাৎ অন্নদাত্রী। বাংলা ভাষার পিতামাতার প্রচলিত আশীর্বাদ, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ এর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে প্রধান খাদ্যের নাম।
ভাতের সঙ্গে এশিয়ার সম্পর্ক যে শুধু পাকস্থলীর নয়, বরং আত্মিক – এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে যে হারে চালের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে, এতে আগামী শতাব্দীতে আদৌ ভাত বলে কিছু থাকবে কি-না এমন সন্দেহও অমূলক নয় বলে মনে করেন বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থাগুলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।