ডনেস্ক অঞ্চলের কৌশলগত উঁচু ভূমি চাসিভ ইয়ার দখলের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছুঁয়েছে। একই সঙ্গে তারা খারকিভ অঞ্চলের কুপিয়ানস্ক শহরের উপকণ্ঠে ঢুকে পড়ার দাবি করেছে। এসব অগ্রগতি ইউক্রেনের প্রতিরোধ ভেঙে পূর্বাঞ্চলে রুশ দখল জোরদার করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
চাসিভ ইয়ার শহরটি রাশিয়ার প্যারাট্রুপাররা ৩১ জুলাই সম্পূর্ণ দখলে নেয় বলে জানিয়েছে মস্কোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মার্চ থেকে ঘিরে রাখা শহরটি কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এটি একটি খালের পাশে অবস্থিত যা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার কাজ করে। শহরটি দখলের ফলে রাশিয়া ডনেস্ক অঞ্চলের বাকি মুক্ত এলাকাগুলোর ওপর নজরদারি চালাতে পারবে।
রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষক ভিতালি কিসেলিয়ভ বলেন, চাসিভ ইয়ার একটি উঁচু স্থান। যেখান থেকে পর্যবেক্ষণ এবং সামরিক অভিযানের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করেছে। আমরা এখন দক্ষিণ ও উত্তর দিক থেকে ঘিরে শত্রুকে চেপে ধরছি। কারণ আমরা ভৌগোলিক দিক থেকে সুবিধাজনক উচ্চতায় অবস্থান করছি।
চাসিভ ইয়ারের পতনের মাধ্যমে রাশিয়া এখন ডনেস্কের ‘ফর্ট্রেস বেল্ট’, অর্থাৎ শক্তিশালী প্রতিরক্ষা থাকা অঞ্চল কুরামাটর্স্ক, দ্রুজকিভকা ও কস্তানতিনিভকা শহরগুলোর দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। রুশ বাহিনী এরই মধ্যে কস্তানতিনিভকার দক্ষিণে আলেক্সান্দ্রো-কালিনোভো গ্রামও দখলে নেওয়ার দাবি করেছে।
তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলছে, চাসিভ ইয়ারে রুশ অগ্রগতি কৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তাদের মতে, রুশ বাহিনী জানুয়ারি থেকেই শহরের উত্তরের বড় একটি অংশ ধরে রেখেছে এবং জুনের মাঝামাঝি দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হচ্ছে।
অন্যদিকে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় পোক্রভস্ক শহরে ইউক্রেনের যোগাযোগ লাইনে চাপ সৃষ্টি করছে রাশিয়া। স্বঘোষিত ডনেস্ক পিপলস রিপাবলিকের প্রধান ডেনিস পুশিলিন বলেন, শত্রু গোলাবারুদ ও সেনা সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ওলেক্সান্ডার সিরস্কি টেলিগ্রামে লিখেছেন, সবচেয়ে কঠিন অবস্থা এখন পোক্রভস্ক, ডব্রোপিলিয়া ও নভোপাভলিভকার দিকে। শত্রু আমাদের ঘাঁটিগুলো দখলের চেষ্টা করছে এবং প্রতিরক্ষায় দুর্বলতা খুঁজে বের করে একাধিক ফ্রন্টে তীব্র লড়াই চালাচ্ছে।
তিনি জানান, ইউক্রেনের পশ্চাদভূমিতে রুশ ‘ডাইভারশন গ্রুপ’ ঢুকে পড়ছে এবং তা প্রতিহত করতে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
খারকিভ অঞ্চলের কুপিয়ানস্ক শহরের রাস্তায় এখন চলছে সংঘর্ষ। রুশ সামরিক বিশ্লেষক আন্দ্রে মারোচকো জানান, ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ ইউনিট ব্যবহার করে রুশ সেনারা সুনির্দিষ্ট হামলা চালাচ্ছে।
এই অঞ্চলসহ দিনিপ্রোপেত্রোভস্ক নামের একটি গ্রাম দখলে নিয়েছে রাশিয়া।
রাশিয়ার দাবি, এসব অঞ্চলের সুরক্ষায় তারা একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করছে। যদিও ইউক্রেন বলছে, এটি আসলে আরও দখলের অজুহাত।
৩১ জুলাই রাতে কিয়েভে রুশ ড্রোন হামলায় ৩১ জন নিহত হন। ইউক্রেন জানায়, রাশিয়া এই হামলায় জেটচালিত শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করেছে। এগুলোর গতি অনেক বেশি ও শনাক্ত করা কঠিন।
ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনী জানায়, রাশিয়া কুরস্ক অঞ্চল থেকে আটটি ইস্কান্দার-কে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ৩০৯টি শাহেদ ও ডিকয় ড্রোন ছুড়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার একে নৃশংস ও নিন্দনীয় হামলা বলে অভিহিত করেছেন।
ইউক্রেন পাল্টা অভিযানে রাশিয়ার রেল ও জ্বালানি অবকাঠামোয় সরাসরি আঘাত হেনেছে। ৩১ জুলাই রাশিয়া দাবি করে, তারা ৩২টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তবে ভলগোগ্রাদ অঞ্চলে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
পেনজা অঞ্চলে একটি রেডিও কারখানা ও ইলেকট্রোপ্রিবর নামের সামরিক যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে আঘাত হানে ইউক্রেন। পাশাপাশি, ক্রাসনোদারে শাহেদ ড্রোন সংরক্ষণ ও উৎক্ষেপণ স্থাপনাও ধ্বংস করা হয়।
ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল তেল শোধনাগারে হামলা। রিয়াজানের শোধনাগারে আগুন লাগে। এটি রাশিয়ার মোট শোধনার উৎপাদনের ৬ শতাংশ সরবরাহ করে। এছাড়া, সামারা অঞ্চলের নভোকুইবিশেভস্ক শোধনাগার ও ভোরোনেজ অঞ্চলের তেল ডিপোতেও হামলা চালায় ইউক্রেন। এমনকি সোচিতে কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলে তেল ডিপোতে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে।
ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তুর্কমেনিস্তান থেকে রাশিয়ায় গ্যাস সরবরাহকারী একটি মূল পাইপলাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। এটি রুশ সামরিক শিল্প, বিশেষ করে ডেমিখভ, মিগ ও ম্যাগনাম-ক প্লান্টে সরবরাহ করে থাকে।
এই সামরিক অভিযানের মধ্যেও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তবে তিনি বলেছেন, ইউক্রেন এখনও আলোচনার জন্য প্রস্তুত নয়।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি পুতিনকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি ইউক্রেনকে এএমআরএএএম ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছেন। ৯ আগস্টের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির সময়সীমা না মানায় তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের হুমকি দেন।
সেই সঙ্গে, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনায় ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প বলেন, তারা যুদ্ধযন্ত্রে জ্বালানি দিচ্ছে। আমি এটা সহ্য করবো না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।