সকাল সাতটা। ঢাকার ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে দশ বছর বয়সী আরাফাত জামা পরতে গড়িমসি করছে। “আমি স্কুলে যাব না মা,” বলতে বলতে তার চোখে জল। তার মায়ের বুকে হাহাকার—এই দৃশ্য বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ পরিবারের নিত্যদিনের সংগ্রাম। একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা ফারহানা আক্তার ক্লাসে প্রবেশ করতেই শিশুরা হাততালি দিয়ে ওঠে। তাদের চোখে জ্বলজ্বলে উৎসুকতা। এই দুই চিত্রের পার্থক্য? স্কুলে বাচ্চাদের প্রেরণা দেওয়ার সহজ কৌশল জানা থাকলে কীভাবে একজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলে যায়, তা আজকের এই প্রতিবেদনের মূল বিষয়।
Table of Contents
স্কুলে বাচ্চাদের প্রেরণা দেওয়ার সহজ কৌশল: কেন এত জরুরি?
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার ৯৭.৯৪% (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২৩)। কিন্তু এখানেই থেমে যাওয়া উচিত নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে আগ্রহ হারায় (UNICEF Bangladesh রিপোর্ট)। কারণ? প্রেরণার অভাব। প্রেরণা শুধু পড়াশোনার গতি বাড়ায় না—এটি শিশুর আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার দক্ষতা গড়ে তোলে।
প্রথমত, ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। রাজশাহীর একটি স্কুলে শিক্ষক রফিকুল ইসলাম প্রতিদিন সকালে দরজায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর নাম ধরে শুভেচ্ছা জানান। এই ছোট্ট অভ্যাসটি শিশুদের মনে নিরাপত্তা ও মূল্যবোধের বীজ বপন করে। মনোবিজ্ঞানী ড. তানিয়া হকের মতে, “শিশুরা যখন শিক্ষককে বন্ধুর মতো পায়, তখন তারা ভুল করতে ভয় পায় না—বরং শিখতে উৎসাহিত হয়।”
দ্বিতীয়ত, শেখাকে খেলায় রূপান্তর করুন। চট্টগ্রামের সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ এডুকেশনের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, গণিতের সূত্র শেখাতে গেম-ভিত্তিক অ্যাপ ব্যবহার করলে ৭০% শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স বেড়েছে। যেমন:
- দলগত চ্যালেঞ্জ: ইতিহাসের অধ্যায় পড়ার পর কুইজ প্রতিযোগিতা।
- বাস্তব জীবনের উদাহরণ: বিজ্ঞানের সূত্র বোঝাতে রান্নাঘরের পরীক্ষা।
- শিল্পের মিশেল: কবিতা শেখাতে ছবি আঁকা বা নাচের ব্যবহার।
তৃতীয়ত, ক্ষুদ্র সাফল্যে উদযাপন। খুলনার গ্রামীণ স্কুলে শিক্ষিকা জেসমিন আক্তার প্রতিটি শিশুর জন্য “সাফল্যের ডায়েরি” বানিয়েছেন। সেখানে প্রতিদিনের ছোট্ট অর্জন—যেমন একটি ইংরেজি বাক্য সঠিক বলা বা সহপাঠীর সাহায্য করা—লিপিবদ্ধ হয়। সপ্তাহ শেষে এসব অর্জনের জন্য সম্মাননা স্টিকার দেওয়া হয়। “প্রেরণা জ্বালানোর জন্য বড় পুরস্কারের চেয়ে নিয়মিত স্বীকৃতি অনেক শক্তিশালী,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. ফারজানা রহমান।
গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান:
- প্রেরণাপূর্ণ পরিবেশে পড়া শিশুদের শিক্ষার ফলাফল ৩৪% বেশি (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড)।
- ৮৫% শিক্ষার্থীর মতে, শিক্ষকের উৎসাহ তাদের কঠিন বিষয়েও আগ্রহ জাগায় (BRAC ইনস্টিটিউট রিপোর্ট)।
অভিভাবক-শিক্ষক সহযোগিতা: প্রেরণার দ্বৈত ইঞ্জিন
শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝা: সিলেটের উদ্যোগী মা সুমাইয়া আক্তার মেয়ের স্কুল ডায়েরিতে শুধু নম্বর না দেখে তার মুড চার্ট রাখেন। কখন সে উচ্ছ্বসিত, কখন ক্লান্ত—তা বুঝলে প্রেরণা দেওয়া সহজ হয়। শিশু মনোবিদ ড. রোকনুজ্জামান বলেন, “প্রতিটি শিশুর প্রেরণার উৎস আলাদা। কারও জন্য স্বীকৃতি, কারও জন্য স্বাধীনতা—এটি চিহ্নিত করুন।”
ঘর-স্কুলের সংযোগ:
- সাপ্তাহিক ডিজিটাল আপডেট: বরিশালের স্কুলগুলো অভিভাবকদের সাথে WhatsApp গ্রুপে শিশুর দিনলিপি শেয়ার করে।
- যৌথ লক্ষ্য নির্ধারণ: শিশুর দুর্বলতা ও শক্তি মিলিয়ে মাসিক টার্গেট সেট করা।
- ঘরোয়া শেখার পরিবেশ: পড়ার টেবিলে শিশুর আঁকা ছবি বা পুরস্কার রাখা।
ডিজিটাল টুলসের ব্যবহার:
- Khan Academy বাংলা: মজাদার ভিডিও লেকচার।
- Duolingo: ভাষা শেখার গেমিফিকেশন।
- Google Classroom: অ্যাসাইনমেন্ট ট্র্যাকিং।
সতর্কবাণী: প্রেরণা দিতে গিয়ে ভুলেও “তোমার চেয়ে রহিম ভালো”—এ ধরনের তুলনা করবেন না। এতে শিশুর আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। বরং বলুন, “গত মাসের চেয়ে তুমি অনেক উন্নতি করেছ!”
বাস্তব উদাহরণ: বাংলাদেশের মাটিতে প্রেরণার ফসল
ময়মনসিংহের অদম্য রিয়া: রিয়ার বাবা দিনমজুর। আর্থিক সংকটে সে স্কুল ছাড়তে চাইলে শিক্ষক মঞ্জুরুল আলম তার জন্য “পড়াশোনা বৃত্তি” চালু করেন। এখন রিয়া জেলার সেরা দশে। তার সাফল্যের চাবিকাঠি? “শিক্ষক স্যার প্রতিদিন আমাকে বলতেন, ‘তুমি পারবে’—এই তিন শব্দ আমার শক্তি ছিল,” বলে রিয়া।
কুমিল্লার বিজ্ঞান মেলা: ল্যাবের অভাবে হতাশ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষিকা নুসরাত জাহান বাসাবাড়ির জিনিস দিয়ে বিজ্ঞান প্রজেক্ট বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু করেন। প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে সোলার সিস্টেম, লেবু দিয়ে ব্যাটারি—এসব প্রজেক্ট জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে।
সাফল্যের ফর্মুলা:
- শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দেওয়া: ক্লাস মনিটর, গাছের যত্ন নেওয়া।
- সমাজসেবা: বৃদ্ধাশ্রমে গল্প বলা, রাস্তা পরিষ্কার করা।
- রোল মডেলের উপস্থিতি: স্থানীয় সফল ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ।
প্রেরণা ধরে রাখার কৌশল: দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
ব্যক্তিগতকৃত শেখার পথ:
- গতি অনুযায়ী গ্রুপিং: দ্রুত শিখতে পারা ও ধীরগতির শিক্ষার্থীদের আলাদা টাস্ক।
- পছন্দের সুযোগ: রচনা বা প্রজেক্টে নিজের বিষয় বেছে নেওয়া।
ভুলকে শেখার সুযোগে পরিণত করা:
“এই ভুলটি তোমাকে নতুন কিছু শেখালো!”—এমন বাক্য শিশুর মনে সাহস জোগায়।
দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য:
- ভবিষ্যৎ কল্পনা: পেশা সম্পর্কে আলোচনা (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী)।
- উদাহরণ: গ্রামের শিশুদের নিয়ে শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভিজিট।
জেনে রাখুন
স্কুলে বাচ্চাদের প্রেরণা দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কী?
ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার ও ছোট সাফল্যে স্বীকৃতি প্রধান উপায়। প্রতিদিন শিশুর ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করুন, যেমন “তোমার লেখাটি খুব সুন্দর হয়েছে!” এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। শিক্ষক-অভিভাবক যৌথ উদ্যোগ এবং শেখাকে খেলার মতো আনন্দদায়ক করাও অত্যন্ত কার্যকর।
শিশুর প্রেরণা বাড়াতে কী ধরনের পুরস্কার দেওয়া উচিত?
বাহ্যিক পুরস্কারের (খেলনা, চকলেট) চেয়ে অভ্যন্তরীণ পুরস্কার (স্বীকৃতি, দায়িত্ব) বেশি কার্যকর। যেমন: ক্লাসে সাহায্য করার দায়িত্ব দেওয়া বা সেরা অগ্রগতির সার্টিফিকেট। গবেষণায় দেখা গেছে, অভ্যন্তরীণ পুরস্কার শিশুর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহ তৈরি করে।
অভিভাবকরা বাসায় কীভাবে শিশুর প্রেরণা বাড়াতে পারেন?
প্রথমত, নিয়মিত স্কুলের কাজে আগ্রহ দেখান। দ্বিতীয়ত, শিশুর শখ ও পড়ার মধ্যে সংযোগ খুঁজুন, যেমন গান শেখার মাধ্যমে ইংরেজি শব্দভাণ্ডার বাড়ানো। তৃতীয়ত, ব্যর্থতায় সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় চেষ্টা করতে উৎসাহিত করুন। মনে রাখবেন, শিশুর সামনে নিজে বই পড়ার অভ্যাসও একটি শক্তিশালী প্রেরণা।
প্রেরণা দেওয়ার সময় কোন ভুলগুলো এড়িয়ে চলা উচিত?
শিশুর সাথে তুলনা করা, অতিরিক্ত প্রত্যাশা চাপানো বা শাস্তির ভয় দেখানো এড়িয়ে চলুন। এগুলো হতাশা ও বিদ্রোহ তৈরি করে। বরং তার প্রচেষ্টাকে মূল্য দিন, এমনকি ফলাফল সন্তোষজনক না হলেও। ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে উপস্থাপন করুন।
শিশুর আগ্রহ কমে গেলে দ্রুত কী পদক্ষেপ নেবেন?
কারণ খুঁজে বের করুন: হয়তো বিষয়টি কঠিন লাগছে, শিক্ষকের সাথে সমস্যা বা সহপাঠীদের দ্বারা হয়রানি। স্কুলের কাউন্সেলরের সাথে কথা বলুন এবং শিশুর সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন। প্রয়োজনে শেখার পদ্ধতি পরিবর্তন করুন, যেমন ভিজ্যুয়াল এইড বা প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট।
স্কুলে বাচ্চাদের প্রেরণা দেওয়ার সহজ কৌশল শুধু পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান দেয় না—এটি ভবিষ্যতের নেতা, উদ্ভাবক ও মানবিক মানুষ গড়ার হাতিয়ার। প্রতিটি শিশুর মনে লুকিয়ে থাকা আলোকে জ্বালাতে আপনার একটি উৎসাহই যথেষ্ট। আজই শুরু করুন: আপনার সন্তান বা ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করুন, “তোমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় কী?” এবং সেটিকেই তার সাফল্যের সিঁড়ি বানান। কারণ, প্রেরণার বীজ আজ বপন করলে, তার ফসল আমরা সবাই পাবো আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।