আ স ম ফেরদৌস রহমান : ২৫ আগস্ট একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এ দেশের অধিকাংশ মানুষ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া একটি ভাষণ শুনেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৫ মিনিট দীর্ঘ সে ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা হচ্ছে।
বক্তার নাম ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কী ছিল এই ভাষণে যে দেশের মানুষ শুধু শোনেননি, মুগ্ধও হয়েছেন? এমন তো না যে, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ নতুন কিছু। গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তিনবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে ৪ জানুয়ারি সর্বশেষ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ ভাষণ দিয়েছেন, ক্ষমতায় আসার পর ২৫ মার্চ দিয়েছেন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ভাষণ এবং ১৭ জুলাই আরেকবার জাতির সামনে এসেছেন- যদিও তখনো তিনি জানতেন না এই মেয়াদে এটাই হবে তাঁর শেষ ভাষণ।
এই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার তিনটি ভাষণ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব পেয়ে ড. ইউনূসের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাষণ একটু খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে, দুজন কোন ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন, যে কারণে মানুষের প্রতিক্রিয়া এত ভিন্ন। কোন ধরনের শব্দ তাঁরা বেশি ব্যবহার করেছেন, কেন করেছেন সেটাও দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
দুজনের বক্তৃতায় শুরুতেই একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেটা হলো, করা শব্দটির ব্যবহার। বাংলা ভাষায় ‘করা’ শব্দটি ইংরেজির ‘Do’ এর মতো। এই শব্দের বিভিন্ন রূপের বহুল ব্যবহার না করে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেওয়া খুব কঠিন।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ তিনটি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণেই ‘করা’র বিভিন্ন রূপ (করে/ করা/ করছি/ করেছি/করতে) বহুবার দেখা গেছে। ৪ জানুয়ারি তিনি করার বিভিন্ন রূপ ব্যবহার করেছেন ১২৭ বার (৫ শতাংশের বেশি)। ২৫ মার্চ ব্যবহার করেছেন ৭০ বার (প্রায় ৪ শতাংশ)। আর ১৭ জুলাই বলেছেন ৫০ বার (৬.৬৬ শতাংশ)। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে ড. ইউনূসের কণ্ঠেও ১৫৩ বার উচ্চারিত হয়েছে ‘করা’শব্দটি। প্রায় ৫.৫ শতাংশ।
ফলে সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দ থেকে ‘করা’র বিভিন্ন রূপকে সচেতনভাবেই বাদ দিতে হচ্ছে। বাংলা ভাষা বলে প্রচুর অব্যয়ও ছিল বক্তৃতাগুলোয়। এ কারণে ‘এবং’, ‘ও’, ‘জন্য’-র মতো অব্যয়গুলোও বাদ দেওয়া হয়েছে।
চলুন একে একে দেখে নেওয়া যাক, কোন বক্তৃতায় কোন শব্দের প্রাধান্য ছিল।
৪ জানুয়ারি, শেখ হাসিনা
মোট শব্দ: ২৪৫৯টি
দ্বাদশ নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ শব্দটিই বেশিবার ব্যবহার করেছিলেন। দেশ বা বাংলাদেশ শব্দের বিভিন্ন রূপ মোট ৫১ বার ব্যবহার হয়েছে। এরপরই ছিল আমি, আমার বা আমরা শব্দগুলো। এই শব্দগুলো ৩০ বার ব্যবহৃত হয়েছে। তিনে যৌথভাবে ছিল ‘বৃদ্ধি’ ও ‘হয়েছে’। নির্বাচন, আওয়ামী লীগ, সরকার- শব্দগুলোও গুরুত্ব পেয়েছে।
‘উন্নতি’ ব্যবহার হয়েছে ১৮বার, ‘আমরা’ শব্দটিও তাই। মানুষের কথা বলেছে ১৫ বার, জনগণের কথা বলেছেন ১১ বার। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ‘জাতির পিতা’ শব্দটিও বলেছিলেন ৯ বার। এবং বিরোধী দলের কথা বলতে গিয়ে বিএনপি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন ৭ বার, জামাত বলেছিলেন ৬ বার। আমাদের শব্দটি ব্যবহার হয়েছিল ৬ বার।
২৫ মার্চ, শেখ হাসিনা
মোট শব্দ: ১৭৯২টি
নির্বাচনে জয়ের পর দুই মাসেরও বেশি সময় পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সে ভাষণে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘আমি’র আধিক্য ছিল। ‘দেশ’ এর বিভিন্ন রূপ উচ্চারিত হয়েছে ৪৯ বার, আমি বা আমার ২৯ বার। এরপরই ছিল ‘হয়’ বা ‘হয়ে’। চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানুষ। পাঁচেই জায়গা পেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
১১ বার উচ্চারিত হয়েছে শেখ শব্দটি। ‘আমাদের’ বলা হয়েছে ১০বার। ‘জাতির পিতা’র কথা বলা হয়েছে ৮ বার। ‘দেশবাসী’ শব্দটি বলা হয়েছে তার চেয়ে একবার বেশি। নির্বাচনের পর বিরোধী দলগুলো যে গুরুত্ব হারিয়েছে তা এই বক্তৃতায় স্পষ্ট। বিএনপির নাম উঠেছে মাত্র ২ বার। জামাত শব্দটি বলেছেন ১ বার।
১৭ জুলাই, শেখ হাসিনা
মোট শব্দ: ৭৫১টি
জাতির উদ্দেশ্যে বিবেচনায় ভাষণটি খুব ছোট ছিল। এবং দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা এই ভাষণে খুব স্পষ্ট ছিল। এই ভাষণে তিনি নিজের পিতার উল্লেখ করেছেন মাত্র একবার। এবং এই ভাষণে ‘দেশ’ শব্দটি গুরুত্ব হারিয়েছিল।
এই ভাষণে ‘হয়/হবে’ অর্থাৎ আন্দোলন সংক্রান্ত ঘটনা ও সে ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল (২৫ বার)। এরপরই ‘আমি’র আধিক্য। মোট ১৬বার এই শব্দের বিভিন্ন রূপ ব্যবহার করেছেন। এরপর ‘এই’, ‘তাদের’ ও ‘সুযোগ’ এর মতো শব্দগুলো স্থান পেয়েছে।
এ ভাষণের সময় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বোঝা যায় আরেকটি তথ্য। পুরো বক্তব্যে তিনি ‘বিএনপি’ ও ‘জামাত’ শব্দগুলো একবারও উচ্চারণ করেননি। নিজের দলের নাম অর্থাৎ ‘আওয়ামী’ শব্দটিও উল্লেখ করেননি।
২৫ আগস্ট, ড. মুহাম্মদ ইউনূস
মোট শব্দ: ২৭৮৭টি
বাংলাদেশের মানুষকে ব্যতিক্রমী কিছু উপহার দিয়েছে এই বক্তব্য। এই বক্তব্যে কোনো রাজনৈতিক দলের নাম কখনোই নেওয়া হয়নি। এবং দীর্ঘ বক্তৃতায় বারবার এক হয়ে কাজ করবার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেটা শব্দচয়নেও স্পষ্ট।
‘আমরা’ শব্দটি ৬১ বার ব্যবহার করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। আমাদের শব্দটি বলেছেন ৪৯ বার। হবে, হয় বা হয়েছে-র মতো শব্দ বলেছেন ৬৮ বার। দেশের কথা উঠেছে ৪৮বার। ‘আপনারা’ বলেছেন ২৪ বার। সে তুলনায় ‘আমি’ বা ‘আমার’ শোনা গেছে মাত্র ২০ বার।
তাদের, সকল, নিশ্চিত-এর মতো শব্দগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল তাঁর কাছে গুরুত্ব না পেলেও ছাত্রদের কথা বলেছেন ১৫ বার। জনতা স্থান পেয়েছে ১৪ বার। কাজ, ব্যবস্থা, দায়িত্বও কমপক্ষে ১০ বার উচ্চারণ করেছে। বিগত সরকারের কথা মনে করাতে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিও ব্যবহার করেছেন ৮ বার।
‘আমি’ ও ‘আমাদের’
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যত দিন গড়িয়েছে তাঁর বক্তৃতায় ‘আমি/আমার’ এর হার বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে যা ১.২২ শতাংশ ছিল, তা মার্চে গিয়ে ১.৬২ শতাংশ হয়েছিল। এবং সর্বশেষ গত ১৭ জুলাইয়ের ভাষণে যা ২.১৩ শতাংশ-তে দাঁড়ায়। অর্থাৎ প্রতি ৫০ শব্দে একবার আমি চলে আসছিল সে বক্তব্যে।
ড. ইউনূসের প্রথম জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে যে ‘আমি’র হারটা ছিল ০.৭২ শতাংশ। সেখানে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের’ প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর ভাষণের ৩.৯৪ শতাংশ শব্দই ছিল সমষ্টিবাচক এই দুই শব্দ। সৈূত্র : ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।