স্পোর্টস ডেস্ক : “যাক সাকিব আমাদের জানালো, আইসিসির ‘টাইমড আউট’ সংক্রান্ত একটা আইন আছে।”- অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজের আউটের পর একজনের ফেসবুক স্ট্যাস্টাস।
মন্দ বলেননি। এই স্ট্যাটাস দেওয়া ভদ্রলোকের মতো বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটভক্তই প্রথমবার শুনেছে ‘টাইমড আউট’ নামের আউটের কথা। সাকিব আল হাসান সেজন্য অবশ্যই ‘ধন্যবাদ’ পাওয়ার দাবিদার। সাকিব আবেদন করেছিল বলেই না আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রথমবার দেখলো এমন আউট। না হলে হয়তো জ্ঞান-সীমানার বাইরেই থাকতো ক্রিকেটীয় নিয়মটি।
তারপরও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন সাকিব। ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট-গৌরব মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন’- এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ। সাকিব ও বাংলাদেশ দল নিয়মের মধ্যে থেকেই তো আউটের আবেদন করেছেন। আম্পায়ারও আউট দিয়েছেন। তাহলে কেন ক্রিকেট-বিশ্বে সমালোচনার ঝড় উঠেছে? ওয়াকার ইউনুস-ডেল স্টেইনের মতো সাবেকেরা কেন ধুয়ে দিচ্ছেন সাকিবকে?
কারণ ক্রিকেটীয় চেতনা। ক্রিকেটকে ‘ভদ্রলোকের খেলা’ বলে ডাকা হয় বলে। ম্যাথুজকে ‘টাইমড আউট’ করায় ক্রিকেটীয় চেতনায় কালি লাগানো হয়েছে, ভদ্রলোকের খেলায় চরম হীনমন্যতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে- এমনটা বলা হচ্ছে। এখানে সবার আগে প্রশ্ন হলো, সাকিব ও বাংলাদেশ কি ভুল করেছে নাকি ঠিকই করেছে?
নিয়মের দিক থেকে দেখলে সাকিব সঠিক কাজই করেছেন। ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা সংস্থা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) আইনে বলা আছে, একজন ব্যাটার আউট কিংবা রিটায়ার্ড হওয়ার পর নতুন ব্যাটার ৩ মিনিটের মধ্যে পরবর্তী বলের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত হবেন। এই শর্ত পূরণ করতে না পারলে নতুন ব্যাটার আউট হবেন। যার নাম ‘টাইমড আউট’।
এই নিয়মটাই ভারতের বিশ্বকাপে একটু বদলে গেছে। সময় ৩ মিনিট থেকে কমিয়ে ২ মিনিট রাখা হয়েছে ২০২৩ বিশ্বকাপের প্লেয়িং কন্ডিশনে। সাদিরা সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর ম্যাথুজ নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে দাঁড়াতে পারেননি ক্রিজে। নিয়ম মেনে সাকিব আউটের আবেদন জানালে ম্যাথুজ হন ‘টাইমড আউট’। অর্থাৎ, সঠিক নিয়ম-কানুন মেনেই সাকিব ও বাংলাদেশ আউট করেছে ম্যাথুজকে।
কিন্তু ওই যে, ভদ্রলোকের খেলায় স্পিরিট ঠিক থাকলো না! ম্যাথুজ বারবার তার হেলমেটের স্ট্র্যাপ ভেঙে যাওয়ার কথা সাকিব ও আম্পায়ারকে জানানোর পরও কাজ হয়নি। আম্পায়ার যেতে বলেছেন সাকিবের কাছে, সাকিব বলেছেন আম্পায়ারের সঙ্গে কথা বলতে। একজন ব্যাটারের হেলমেট ব্যবহারের উপযোগী নয়, সেটি মাঠে এসে দেখানোর পরও সাকিব আউটের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণেই তাকে নিয়ে হচ্ছে ব্যাপক সমালোচনা।
এই বিতর্ক সাকিব আরও উস্কে দিয়েছেন ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে। বাংলাদেশ অধিনায়ক এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, আউটের আবেদনের পর আম্পায়ার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কি সত্যি আউট চাও? নাকি পরে ফিরিয়ে আনবে? পরে যদি ফিরিয়েই আনো, তাহলে এই পরিস্থিতি করার দরকার নেই।’ সাকিব তখন বলেছিলেন, ‘আমি ফেরাবো না।’ অর্থাৎ, ম্যাথুজের আউটের বিষয়টি সাকিবের হাতেই ছিল। নিয়ম অনুযায়ী, আম্পায়ারের আর কিছু করার ছিল না।
ফলে কোনও বল না খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত ‘টাইমড আউট’ হয়ে ফিরে যান ম্যাথুজ। সংবাদ সম্মেলনে এই সাবেক লঙ্কান অধিনায়ক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে গেছেন, ‘আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনও দল এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আউট করতো না। আমার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে এটা দেখিনি। আমার বিশ্বাস, ক্রিকেটের আর কোনও দল এমন কাজ করতো না।’
দিল্লির ম্যাচের আগে যেহেতু এই আউট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখেনি, তাই ম্যাথুজের কথায় যুক্তি খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে সেই ১৮৭৭ সাল থেকে। ওয়ানডে ক্রিকেটের বয়সও ৫২ পেরিয়ে গেছে। এতদিনেও দেখা যায়নি ‘টাইমড আউট’-এর ঘটনা। বাংলাদেশই প্রথম দল হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করলো ‘টাইমড আউট’।
তবে এই আউটের সুযোগ যে আসেনি, তা নয়। বিখ্যাত হয়ে আছে ২০০৬-০৭ মৌসুমে ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ম্যাচটি। কেপ টাউনের নিউল্যান্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তৃতীয় টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল দল দুটি। দক্ষিণ আফ্রিকা অলআউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত ২ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে ওয়াসিম জাফর আউট হলে চার নম্বরে নামার কথা শচীন টেন্ডুলকারের। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের শেষ ১৮ মিনিট ফিল্ডিংয়ে ছিলেন না তিনি। তাই ভারতের ব্যাটিংয়ের ১৮ মিনিট না পেরোলো টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ নেই। দ্রুত ২ উইকেট পতনে ওই সময়টা তখনও পেরোয়নি।
টেন্ডুলকার নামতে পারছেন না। তাহলে পাঁচে খেলা ভিভিএস লক্ষ্মণ ব্যাটিংয়ে নামবেন। কিন্তু লক্ষ্মণ তখন গোসলে! তাহলে উপায়? ব্যাট হাতে নেমে গেলেন সৌরভ গাঙ্গুলী। কিন্তু ওয়াসিম জাফর আউট ও সৌরভের মাঠে যাওয়ার মাঝে পেরিয়ে গেছে ৬ মিনিট!
‘টাইমড আউট’-এর নিয়মটা নিশ্চয় মনে আছে। আগের ব্যাটারের আউটের পর ৩ মিনিটের মধ্যে নতুন ব্যাটারকে বলের মুখোমুখি হতে হবে। সৌরভ মাঠে এসেছিলেন ৬ মিনিট পর। তারপরও ‘টাইমড আউট’-এর আবেদন করেননি দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ছয়বার এই আউটের উদাহরণ আছে। তাছাড়া ক্রিকেটবিদ্যায় সবসময়ই এগিয়ে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা অধিনায়ক স্মিথের ‘টাইমড আউট’ সম্পর্কে জ্ঞান থাকার কথা। কিন্তু সেদিন স্মিথ আউটের আবেদন করেননি।
সাকিব করেছেন। আউটও পেয়েছেন। অভিজ্ঞ ম্যাথুজকে বল খেলার সুযোগই দেননি। বাংলাদেশের অধিনায়ক মনে করেন, ‘যুদ্ধে নামলে দলকে কিংবা দেশকে জেতানোর জন্য সবকিছু করা উচিত।’ সেটা ক্রিকেটচেতনার সঙ্গে যায় কি যায় না, তাতে সাকিবের ‘কিছু আসে-যায় না’। কারণ নিয়ম তো নিয়মই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।