লাইফস্টাইল ডেস্ক : সাফল্য সাধারণত আমাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। আর এই সত্যকে জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন ওয়ারেন বাফেট। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি প্রমাণ করে আসছেন যে সঠিক অভ্যাস ও শৃঙ্খলা একত্রে অনন্য সাফল্য এনে দিতে পারে। আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি, ছোট ছোট সিদ্ধান্ত কিভাবে সময়ের সাথে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। হতে পারে এটি আমার ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে, যেখানে একটি সামান্য পরিবর্তনও বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। অথবা এটি আমার মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বোঝার আগ্রহ থেকেও আসতে পারে।
যাই হোক, যখন আমি ওয়ারেন বাফেটের মতো সফল ব্যক্তিদের দেখি, তখন তাদের জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা ও কাজের ধরনে কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে পাই। আজ আমরা এমন পাঁচটি মূল অভ্যাস নিয়ে আলোচনা করব, যা ওয়ারেন বাফেট অনুসরণ করেন এবং যা প্রকৃত ধনী ও সফল ব্যক্তিদের সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করে তোলে:
০১. আজীবন শেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন
ওয়ারেন বাফেটের সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তিগুলোর একটি হলো— “যত বেশি শিখবে, তত বেশি উপার্জন করবে।” এটি এমন একটি সত্য যা আমি কখনোই উপেক্ষা করতে পারি না। বাফেট মূলত একজন আজীবন শিক্ষার্থী। তিনি প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়েন— ইতিহাস, জীবনী থেকে শুরু করে আর্থিক প্রতিবেদন পর্যন্ত সবকিছুই। তার যুক্তি সহজ: জ্ঞানও সুদের মতো বেড়ে চলে, যেমন টাকা বাড়ে।
আমাদের সবার পক্ষে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা বই পড়া সম্ভব নাও হতে পারে, তবে আমরা নিজেদের সময় ও আগ্রহ অনুযায়ী শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। হতে পারে, প্রতি সপ্তাহে একটি অডিওবুক শোনা, কিছু চিন্তাশীল নিবন্ধ পড়া, বা নতুন কোনো দক্ষতা শেখার জন্য অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখা। মূল বিষয় হলো পরিমাণ নয়, বরং ধারাবাহিকতা।
মানসিকভাবে নতুন তথ্য গ্রহণ আমাদের কৌতূহলী ও অভিযোজনযোগ্য করে তোলে। অন্যরা যেখানে সমস্যার সমাধান খুঁজে পায় না, আমরা সেখানে নতুন সুযোগ দেখতে পাই। তাই, আজীবন শেখার অভ্যাস তৈরি করা ব্যক্তিগত ও পেশাগত সাফল্যের জন্য একধরনের জ্বালানির মতো কাজ করে।
০২. বিচক্ষণভাবে ব্যয় করুন
বাফেট তার মিতব্যয়িতার জন্য বিখ্যাত। একজন বিলিয়নিয়ার হয়েও তিনি এখনও সেই বাড়িতেই থাকেন, যা তিনি বহু বছর আগে কিনেছিলেন। তিনি দামি গাড়ি কেনেন না, বিলাসবহুল খরচেও আগ্রহী নন। এর কারণ? তিনি মূল্য ও ব্যয়ের পার্থক্য বুঝতে পারেন।
এখানে আমাদের শেখার বিষয় দুটি:
-সচেতনভাবে খরচ করুন: আপনি যা কিনছেন, তা আপনার জীবনে প্রকৃত মূল্য যোগ করছে কি না, তা ভাবুন। মজা নেওয়া ভুল নয়, তবে খরচে পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
-নিজের উন্নয়নে বিনিয়োগ করুন: বাফেট বিনিয়োগ বলতে শুধু শেয়ার কেনার কথা বোঝান না, তিনি আত্মোন্নয়নকেও বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন। এটি হতে পারে নতুন কিছু শেখা, কর্মশালায় অংশ নেওয়া, বা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামে ব্যয় করা।
আমি নিজেও যখন ক্যারিয়ারে এগোতে পারছিলাম না, তখন বুঝতে পারি যে প্রয়োজনীয় কোর্স বা নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে বিনিয়োগ না করাই আমার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। পরে যখন আমি এতে ব্যয় করা শুরু করি, তখনই প্রকৃত অগ্রগতি দেখতে পাই। সুতরাং, সচেতন ব্যয় ও আত্মোন্নয়নে বিনিয়োগ একসঙ্গে চলতে হয়। যখন আমরা নিজের দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধিতে ব্যয় করি, তখন তা ভবিষ্যতে বহুগুণে ফিরে আসে।
০৩. শৃঙ্খলা বজায় রাখুন
ওয়ারেন বাফেটের সাফল্যের মূল রহস্যগুলোর একটি হলো তার শৃঙ্খলা। তিনি কখনই ট্রেন্ডের পেছনে ছুটে চলেন না, বরং ধৈর্য ধরে সঠিক বিনিয়োগের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেন।
প্রথমে শৃঙ্খলা শুনতে বিরক্তিকর লাগতে পারে, কিন্তু আসলে এটি সত্যিকারের স্বাধীনতার মূল চাবিকাঠি। শৃঙ্খলা ছাড়া আমরা আবেগ, ইচ্ছা ও সাময়িক প্রলোভনের দ্বারা পরিচালিত হই। যে কেউ যদি শরীরচর্চা বা কোনো প্রকল্পের সময়সীমা মেনে চলার চেষ্টা করে থাকেন, তবে নিশ্চয় জানেন যে মনোযোগ ধরে রাখা কতটা কঠিন হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল অসাধারণ হয়।
ব্যক্তিগতভাবে, আমি নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করেছি— লেখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সময়সীমা নির্ধারণ, এবং প্রতিদিন কিছু সময় শিক্ষামূলক কিছু পড়ার জন্য বরাদ্দ রাখা। শৃঙ্খলা আমাদের প্রতিদিনের অগ্রগতি নিশ্চিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে বিশাল পরিবর্তন আনে।
০৪. শক্তিশালী সম্পর্ক তৈরি করুন
ওয়ারেন বাফেট বারবার বলেছেন, “আপনি কাদের সঙ্গে সময় কাটান, সেটাই আপনার ভবিষ্যত নির্ধারণ করে।” তিনি মনে করেন, তার সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো তার ভালো বন্ধু, উপদেষ্টা ও অংশীদারদের উপস্থিতি। মানুষের মানসিকতা ও অভ্যাস অনেকাংশে তাদের আশেপাশের মানুষদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি আপনার চারপাশে অনুপ্রেরণাদায়ক মানুষ থাকে, তবে আপনিও উন্নতি করতে উদ্বুদ্ধ হবেন।
আমি যখন ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলাম, তখন ভাবতাম সাফল্য একান্তই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফল। কিন্তু পরে বুঝেছি, সঠিক মানুষদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করাই আসল অগ্রগতির চাবিকাঠি।
তাই, সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে শুধুমাত্র নিজের লাভের কথা ভাবা যাবে না। বরং আন্তরিকভাবে অন্যের কল্যাণে আগ্রহী হতে হবে, তাদের সাফল্য উদযাপন করতে হবে, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করতে হবে। শক্তিশালী সম্পর্ক শুধু ক্যারিয়ার নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই অমূল্য সম্পদ হয়ে ওঠে।
০৫. দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখুন
ওয়ারেন বাফেটের বিখ্যাত উক্তি— “আজ কেউ ছায়ায় বসে আছে কারণ কেউ একসময় একটি গাছ লাগিয়েছিল।” তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, সফলতা একদিনে আসে না; এটি সময় ও ধৈর্যের ফল। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে যেখানে সবাই তাৎক্ষণিক ফলাফল চায়, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করা একটি বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। যখন কেউ ভবিষ্যতের দিকে মনোযোগ দেয়, তখন সে সাময়িক ব্যর্থতায় হতাশ হয় না, ট্রেন্ডের পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করে না। বরং সে তার মূল লক্ষ্যের দিকে স্থির থাকে এবং সময়ের সাথে তার সাফল্য গড়ে ওঠে।
আমি নিজেও এটি আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। কিছু লেখা তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পায় না, কিন্তু সময়ের সাথে পাঠকদের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা আমাদের আর্থিক, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে স্থায়ী উন্নতি নিশ্চিত করে।
ওয়ারেন বাফেটের সাফল্য শুধুমাত্র সঠিক বিনিয়োগ বা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। এটি তার আজীবন শেখার অভ্যাস, শৃঙ্খলা, ব্যয়ের প্রতি সংবেদনশীলতা, সম্পর্কের গুরুত্ব, এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফল। আমাদের জীবনের কোন ক্ষেত্রগুলোতে এই অভ্যাসগুলোর প্রয়োগ প্রয়োজন? তা ভাবার সময় এসেছে।
সফলতা কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়; এটি প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসের সমষ্টি। তাই নিয়মিত শেখা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বুদ্ধিমানের মতো ব্যয় করা, সম্পর্ক তৈরি করা ও ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা— এগুলোই আমাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধি বয়ে আনবে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।