বেলায়েত হুসাইন : কোরবানি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো নয়। এটি বছরে একবার মাত্র আসে। এজন্য এর আনুষঙ্গিক মাসআলাগুলো আমরা ভুলে যাওয়ার উপক্রম হই। একইসঙ্গে কোরবানি নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু ভুল ধারণাও থাকে। এমনই কিছু ভুল ধারণার বিষয়ে মাসআলা এখানে উল্লেখ করা হলো—
এক. কোরবানির শরিক সংখ্যা কি বেজোড় হওয়া জরুরি?
কিছু লোককে বলতে শোনা যায় যে পশুতে সাতজন শরিক হতে পারে, তবে শরিকের সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি। সুতরাং একটি গরুতে এক, তিন, পাঁচ বা সাত জন শরিক হতে পারবে। দুই, চার বা ছয়জন শরিক হতে পারবে না। এটা ভুল কথা। একটি গরু যেমন এক ব্যক্তি একা কোরবানি করতে পারেন, তেমনি দুই থেকে সাত পর্যন্ত যে কোনও সংখ্যক শরিক একত্র হয়েও কোরবানি করতে পারেন। এতে কোনও বাধা নেই। তেমনি শরিকের সংখ্যা জোড় না হয়ে বেজোড় হওয়ার মাঝেও এমন আলাদা কোনও ফজিলত নেই। যার কারণে পাঁচ শরিকের স্থলে ছয় শরিক বা ছয় শরিকের স্থলে সাত শরিক একত্র হয়ে কোরবানি করতে কোনও সমস্যা নেই।
দুই. শরিকে কোরবানির ক্ষেত্রে ওজন করা ছাড়া অনুমান করে মাংস বণ্টন করা।
অনেক মানুষই শরিকি পদ্ধতিতে কোরবানি করেন। সাত জন, ছয় জন বা পাঁচ জন—এভাবে মিলে শরিকে একটি গরু কোরবানি করেন। কিন্তু মাংস বণ্টনের সময় দেখা যায়, ওজন করে বণ্টন না করে অনুমানভিত্তিক বণ্টন করেন। অনেকে আবার ওজন করে বণ্টন করাকে অপছন্দ করেন। বলেন, সামান্য একটু কম-বেশি হলে তেমন আর কী সমস্যা! এটি একটি ভুল আমল।
শরিকে কোরবানির ক্ষেত্রে প্রত্যেক শরিকের প্রাপ্য অংশ ওজন করে বণ্টন করা জরুরি; অনুমানভিত্তিক বণ্টন জায়েজ নয়। কারণ এটি অন্যের হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। অন্যের হক যথাযথ বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি; কম-বেশি করা জায়েজ নেই।
তিন. কোরবানির মাংস তিন ভাগে বণ্টন না করলে কি কোরবানি হবে না?
কোরবানির মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে উত্তম হলো, তিন ভাগ করে এক অংশ সদকা করা; এক অংশ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গরীব প্রতিবেশীকে দেওয়া; আর এক অংশ নিজের জন্য রাখা।
এটি একটি মুস্তাহাব ও উত্তম আমল; ওয়াজিব ও আবশ্যকীয় নয়। কিন্তু অনেক মানুষ মনে করে, কোরবানির মাংস তিন ভাগে বণ্টন করা জরুরি এবং এতে সামান্য ত্রুটি করলেও কোরবানি হবে না। সঙ্গে এটাও মনে করে, এ বণ্টন হতে হবে মেপে মেপে। এ তিন ভাগ ওজনে সমান হতে হবে, কোনও কমবেশি চলবে না। স্পষ্ট কথা, এমন ধারণা সঠিক নয়।
চার. কোরবানির পশুর চর্বি বিক্রি করা।
অনেক এলাকায় দেখা যায়, কোরবানির কয়েকদিন পর ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরবানির পশুর চর্বি কিনে নেন। মানুষও না বোঝার কারণে নিজ কোরবানির পশুর চর্বি তাদের কাছে বিক্রি করেন। এটি জায়েজ নেই। কোরবানির পশুর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা নিষেধ। কেউ যদি বিক্রি করে ফেলেন, তাহলে এর পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। জেনে রাখা দরকার, মূল্য সদকার নিয়ত না থাকলে কোরবানির পশুর মাংস, চর্বি, খুর ইত্যাদি কোনও কিছুই বিক্রি করা জায়েজ নেই। এজন্য যারা কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করেন, তারা মূল্য সদকার নিয়তেই বিক্রি করেন এবং এর পূর্ণ মূল্যই সদকা করে দেন; নিজেরা খরচ করেন না।
পাঁচ. জবাই করার আগেই কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে দেওয়া।
অনেক সময় চামড়াক্রেতাদের পীড়াপীড়িতে কোরবানিদাতারা পশু জবাইয়ের আগেই চামড়া বিক্রি করে ফেলেন; এমনকি মূল্যও নিয়ে নেস। এমনটি করা নাজায়েজ। চামড়া পশুর দেহ থেকে আলাদা করার আগে তা বিক্রিযোগ্য নয়। তাই এ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে জবাইয়ের আগে বিক্রির ওয়াদা করা যেতে পারে, কিন্তু বিক্রি করা যাবে না।
ছয়. জবাই কি আড়াই পোঁচেই করতে হবে?
অনেক মানুষের ধারণা, জবাই আড়াই পোঁচেই হতে হবে; এর বেশি-কম হলে চলবে না। এটি একটি ভুল ধারণা। জবাই আড়াই পোঁচেই করতে হবে—এমন কোনও কথা নেই। আসল কথা হচ্ছে, রগগুলো কেটে রক্ত প্রবাহিত করে দেওয়া। তবে জবাইয়ের ক্ষেত্রে ধারালো অস্ত্রব্যবহার করবে; যেন প্রাণীর অধিক কষ্ট না হয়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতাআলা সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। …যখন তোমরা জবাই করবে, উত্তম পদ্ধতিতে জবাই করবে; ছুরিতে শান দিয়ে নেবে এবং পশুকে শান্তি দেবে।’
সাত. কোরবানির মাংস কি অমুসলিমদের দেওয়া যায় না?
কিছু মানুষের ধারণা, কোরবানির মাংস অমুসলিমদের দেওয়া যায় না। এ ধারণা ঠিক নয়।
কোরবানির মাংস অমুসলিমদের দেওয়া যায়। এতে অসুবিধার কিছু নেই। বিশেষত অমুসলিম যদি প্রতিবেশী হয়। কারণ প্রতিবেশী হিসেবে তার হক রয়েছে। সাহাবিগণ অমুসলিম প্রতিবেশীর হকের প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)-এর বাড়িতে একবার একটি বকরি জবাই করা হলো। যখন তিনি বাড়িতে ফিরলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে এ মাংস হাদিয়া পাঠিয়েছ? এভাবে দুইবার জিজ্ঞেস করলেন। সুতরাং অমুসলিমকে কোরবানির মাংসসহ অন্যান্য হাদিয়া দেওয়া যাবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ হতে বের করে দেয়নি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদের স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদের বের করার কাজে সহায়তা করেছে। তাদের সঙ্গে যারা বন্ধুত্ব করে তারা তো জালিম।’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮-৯)
আট. কোরবানির ঈদের দিন কি দুই পা বিশিষ্ট প্রাণী (হাঁস-মুরগি ইত্যাদি) জবাই করা নিষেধ?
কেউ কেউ মনে করে, কোরবানির ঈদের দিন হাস-মুরগি ইত্যাদি দুই পা বিশিষ্ট প্রাণী জবাই করা যাবে না। এটি একটি অমূলক ধারণা, এর কোনও ভিত্তি নেই। তারা হয়তো মনে করে যে, কোরবানি যেহেতু চার পা বিশিষ্ট প্রাণী দিয়ে করতে হয়, দুই পা বিশিষ্ট প্রাণী দ্বারা কোরবানি করা যায় না। সুতরাং এ দিনে দুই পা বিশিষ্ট প্রাণী জবাইও করা যাবে না। আসলে অজ্ঞতার কারণে এ ধরনের অমূলক ধারণার সৃষ্টি হয় এবং সমাজে এগুলোর প্রচলন হয়ে থাকে। এ ধরনের অমূলক ধারণা থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।
তথ্যসূত্র : সহি মুসলিম, জামে তিরমিজি, ইলাউস সুনান, বাদায়েউস সানায়ে, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী ও ‘জিলহজ ও কুরবানী লি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী’।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।