বৃষ্টিভেজা বিকেলে ঢাকার নাজিরাবাজারের চটপটির স্বাদ, কিংবা শীতের সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের আন্ধারমানিকের ভাজার গন্ধ—স্ট্রিট ফুড আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ। কিন্তু এই প্রিয় মুখরোচক খাবারই যখন ডেকে আনে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-এ, বা খাদ্যে বিষক্রিয়া, তখন প্রশ্ন ওঠে: স্ট্রিট ফুড হাইজিন মেনটেইন কতটা জরুরি? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ দূষিত স্ট্রিট ফুড জনিত রোগে আক্রান্ত হন, যার ৪০%ই শিশু। এই লেখায় আমরা খুঁজে দেখব, কীভাবে সুস্থ থাকুন সচেতন হোন মন্ত্রে স্ট্রিট ফুডের আনন্দকে নিরাপদ রাখা যায়, ভেন্ডার থেকে ভোক্তা—সবাইকে নিয়ে।
স্ট্রিট ফুডের জনপ্রিয়তা ও ঝুঁকি: কেন হাইজিন মেনটেইন অপরিহার্য?
বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুড শুধু খাবার নয়, সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। ফুচকা, ঝালমুড়ি, সমুচা, কাচ্চি বিরিয়ানি—এগুলো আমাদের রক্তে মিশে আছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২৪ সালের গ্লোবাল ফুড সেফটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬৫% স্ট্রিট ফুডে ই-কোলাই, সালমোনেলা বা স্ট্যাফিলোকক্কাসের মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। কারণগুলো স্পষ্ট:
- অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ: ৭০% ভেন্ডার খোলা ড্রেন বা আবর্জনার পাশে দাঁড়িয়ে খাবার বিক্রি করেন (সূত্র: IEDCR সার্ভে ২০২৩)।
- দূষিত পানি: ঢাকার ৯০% স্ট্রিট ফুড আইটেমে ব্যবহৃত পানি WHO-এর মান অতিক্রম করে (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, ২০২৪)।
- ক্রস-কন্টামিনেশন: একই কাটিং বোর্ডে মাছ-মাংস ও শাকসবজি কাটা।
প্রকৃত ঘটনা থেকে শিক্ষা:
২০২৩ সালের জুলাইয়ে খুলনায় ২৩ জন স্কুলছাত্র হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দূষিত ফুচকা খাওয়ার পরে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফারহানা আক্তার বলেছেন, “ভেন্ডার যদি হ্যান্ড গ্লাভস পরতেন ও বরফ টিউবওয়েলের পানির বদলে ফিল্টার্ড পানি দিয়ে বানাতেন, এই ঘটনা এড়ানো যেত।”
স্ট্রিট ফুড হাইজিন মেনটেইন: ভেন্ডারদের জন্য বিজ্ঞানসম্মত গাইড
খাবার প্রস্তুতি থেকে বিক্রি—প্রতিটি ধাপে সচেতনতা
১. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা (Personal Hygiene)
- হাত ধোয়া: খাবার স্পর্শের আগে সাবান-পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে। WHO-এর এই গাইডলাইন মেনে চললে সংক্রমণ ৫০% কমে।
- প্রোটেক্টিভ গিয়ার: চুল নেট দিয়ে ঢাকা, মুখে মাস্ক, হাতে ডিসপোজেবল গ্লাভস পরা বাধ্যতামূলক।
২. উপকরণ ও পানি ব্যবস্থাপনা
- পানি শোধন: টিউবওয়েলের পানি ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে ব্যবহার করুন। আইসক্রিমের বরফের জন্য FDA-অনুমোদিত ওয়াটার পিউরিফায়ার জরুরি।
- কাঁচামাল: মাছ-মাংস ঢাকনা দেওয়া পাত্রে রাখুন, শাকসবজি ব্লিচিং পাউডার মেশানো পানিতে ধুয়ে নিন (বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির পরামর্শ)।
৩. পরিবেশ ও সরঞ্জাম পরিচ্ছন্নতা
- রান্নাঘর: প্রতিদিন ফিনাইল বা ব্লিচিং দিয়ে মোছা, মাছি-তেলাপোকা নিয়ন্ত্রণে নিম বা ইউক্যালিপটাস তেল স্প্রে করুন।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দুটি ডাস্টবিন রাখুন—জৈব ও প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য। ঢাকা সাউথ সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে সপ্তাহে তিনবার বর্জ্য সংগ্রহ করুন।
সফলতার গল্প:
কুমিল্লার বিরল উপজেলার রিকশাভ্যান ভেন্ডার শফিকুল ইসলাম। ফুড সেফটি ট্রেনিং (BSTI-আয়োজিত) নেওয়ার পর তার আয় বেড়েছে ৪০%। “গ্রাহকরা এখন বলছেন, আমার স্টলে খেলে পেটে ব্যথা হয় না,” — তার মন্তব্য।
ভোক্তা হিসেবে আপনার ভূমিকা: নিরাপদ স্ট্রিট ফুড বাছাইয়ের ৭টি গোল্ডেন রুল
কী দেখবেন স্টলে? (স্টল অডিট চেকলিস্ট)
লক্ষণ | নিরাপদ | ঝুঁকিপূর্ণ |
---|---|---|
হ্যান্ডলিং | গ্লাভস পরা, টংস ব্যবহার | খালি হাতে খাবার স্পর্শ |
পানি | ফিল্টার্ড পানি/বোতলজাত পানি | ট্যাংকের অস্বচ্ছ পানি |
খাদ্য আচ্ছাদন | কাঁচ/প্লাস্টিক কভার | খোলা অবস্থায় রাখা |
প্র্যাকটিকাল টিপস:
- “হট অ্যান্ড ফ্রেশ” নীতি: যে খাবার গরম অবস্থায় পরিবেশন করা হয় (চা, ভাজা পোড়া), সেগুলোতে ব্যাকটেরিয়ার ঝুঁকি কম।
- সস সতর্কতা: কাটা লেবু বা কাঁচা মরিচে মাছি বসলে সালমোনেলা ছড়ায়। প্যাকেটজাত সস চাইতে বলুন।
- প্লাস্টিক এড়ানো: গরম খাবার স্টাইরোফোম কাপে না খাওয়াই ভালো (ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা)।
ভোক্তা অধিকার:
অনিরাপদ খাবার পেলে সরাসরি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের হটলাইন (১৬১৫৭) এ অভিযোগ করুন। ২০২৩ সালে এই লাইনে ১২,০০০+ অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে।
সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ ফুড সেফটি অ্যাক্ট ২০১৩ অনুযায়ী, প্রতিটি স্ট্রিট ফুড ভেন্ডারের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে নিবন্ধিত ভেন্ডার মাত্র ১৫% (সূত্র: FPMU ২০২৪)।
সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ:
- ঢাকা উত্তর সিটি: “ক্লিন স্ট্রিট ফুড জোন” চালু করেছে গুলশান লেক পার্কে। ভেন্ডারদের বিনামূল্যে হাইজিন কিট দেওয়া হয়।
- চট্টগ্রাম সিটি: মাসিক হেলথ ইনস্পেকশন ও রেটিং সিস্টেম (A, B, C গ্রেড) চালু করা হয়েছে।
এনজিও পার্টনারশিপ:
BRAC-এর “সেইফ স্ট্রিট ফুড” প্রোগ্রামে ৫,০০০+ ভেন্ডারকে হাইজিন ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত ভেন্ডারদের স্টলে সবুজ স্টিকার লাগানো থাকে।
সুস্থ থাকুন: অসুস্থতার পর কী করবেন?
খাওয়ার ৬-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বমি, জ্বর বা ডায়রিয়া দেখা দিলে:
- ORS খান: লিটার পানিতে এক চিমটি লবণ + আট চামচ চিনি মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ আইসিডিডিআর,বি।
- নমুনা সংরক্ষণ: খাবারের নমুনা (যদি থাকে) পলিপ্যাকে রাখুন। স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষার জন্য দিতে পারেন।
- রিপোর্ট করুন: NFSA-র অ্যাপ “খাদ্য সুরক্ষা” ডাউনলোড করে ফটো ও লোকেশনসহ অভিযোগ জানান।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ:
ডা. তাহমিদা আহমেদ (গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট, অ্যাপোলো হসপিটাল): “স্ট্রিট ফুড খাওয়ার পর কাঁচা পেপায়া বা আদা চা খান। এনজাইম ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক।”
স্ট্রিট ফুড হাইজিন মেনটেইন কেবল নিয়ম নয়, আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনি যখন এক কাপ চায়ের দামে গ্লাভস কিনে ভেন্ডারকে দেন, বা পলিথিনে মোড়ানো খাবার এড়িয়ে চলেন—তখনই সুস্থ থাকুন সচেতন হোন বাস্তব হয়। ভেন্ডার, ভোক্তা ও সরকার—তিন শক্তির অংশীদারিত্বেই রক্ষা পাবে আমাদের ফুচকার স্বাদ, আমাদের সংস্কৃতির প্রাণ। আজই শপথ করুন: “নিরাপদ খাবারের অধিকার আমার, দায়িত্বও আমার।”
জেনে রাখুন
১. স্ট্রিট ফুড থেকে কোন রোগগুলো সবচেয়ে বেশি হয়?
বাংলাদেশে স্ট্রিট ফুডজনিত শীর্ষ রোগ হলো ডায়রিয়া (৬০%), টাইফয়েড (২০%), এবং হেপাটাইটিস-এ (১৫%)। দূষিত পানি ও অপরিচ্ছন্ন হ্যান্ডলিংই মূল কারণ। প্রতিরোধে ভেন্ডারদের ফুড হ্যান্ডলার সার্টিফিকেট নেওয়া জরুরি।
২. ভেন্ডারকে কী প্রশ্ন করলে বুঝব তিনি হাইজিন মেনটেইন করেন?
জিজ্ঞাসা করুন: “আপনি কোন পানি ব্যবহার করেন?”, “কতক্ষণ পর পর হাত ধোন?” বা “খাদ্য নমুনা পরীক্ষা করিয়েছেন কি?”। আত্মবিশ্বাসী উত্তরই নির্ভরযোগ্যতার লক্ষণ।
৩. রাস্তার পাশের ফলের রস কি নিরাপদ?
শুধু তখনই নিরাপদ, যদি ফল ধোয়া পানি ফুটানো হয় এবং রস বরফ ছাড়া পরিবেশন করা হয়। লেবু-কমলার রসে সংরক্ষণকারী (সোডিয়াম বেনজোয়েট) থাকলে এড়িয়ে চলুন।
৪. সরকার স্ট্রিট ফুড হাইজিন নিশ্চিত করতে কী করছে?
২০২৫ সালের মধ্যে “স্ট্রিট ফুড হাইজিন রেটিং” বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাইলট প্রকল্প চালু হয়েছে। ভেন্ডারদের ট্যাক্স ছাড়, হাইজিন কিট বিতরণ ও মাইক্রোক্রেডিট দেওয়া হচ্ছে।
৫. বর্ষায় স্ট্রিট ফুড খাওয়া কি বেশি বিপজ্জনক?
হ্যাঁ, বৃষ্টির পানিতে ময়লা মিশে ব্যাকটেরিয়া বাড়ে। এ সময় গরম ভাজা পোড়া (পাকোড়া, তেলেভাজা) নিরাপদ। কাঁচা সালাদ বা ফুচকার পানি এড়িয়ে চলুন।
৬. হাইজিন মেনটেইন করেও ভেন্ডাররা লাভবান হবেন কীভাবে?
গবেষণা বলে, হাইজিনিক স্টলে গ্রাহক ৩৫% বেশি আসেন। BSTI-র “নিরাপদ খাদ্য” সীল পেলে সিটি কর্পোরেশন স্টলের ভাড়া মওকুফ করে। সামাজিক মিডিয়ায় রিভিউ বাড়লে আয়ও বাড়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।