আবুল খায়ের : কুমিল্লার সবচেয়ে ‘ভিআইপি সাবরেজিস্ট্রি অফিস’ হলো আদর্শ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিস। নগরীর ফৌজদারি এলাকায় অবস্থিত এ কার্যালয়ের কর্ম এলাকা গোটা নগর এবং শহরতলি।
এখানে প্রতিদিন কোটি টাকা থেকে শুরু করে শতকোটি টাকার দলিল সম্পাদন হয়। ফলে দলিল সম্পাদন, নকল (সার্টিফায়েড) কপি, টিপসইসহ নানা খাতে প্রতি মাসে সাবরেজিস্ট্রারকে কমপক্ষে এক কোটি টাকা ঘুস দিতে হয়। এরপরও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ সেবাপ্রত্যাশীদের।
গত ২ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে এ কার্যালয়ের সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২৫ কোটি টাকা। নিজস্ব অনুসন্ধান, সেবাগ্রহীতা, অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলিল লেখক, দালাল সবার সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি চারদিকে দুর্নীতিবিরোধী খবর এবং উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে নিজের এসব অপকর্ম ঢাকতে আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন ওই সাবরেজিস্ট্রার। এ অফিস থেকে তিনি দ্রুত বদলি হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে কুমিল্লার আদর্শ সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। ৭০ জন নকলনবিশ কাজ করছেন অবিরাম। অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, টিসি মোহরার ও মোহরারসহ ডজনখানেক কর্মচারী এবং পিয়ন রয়েছেন। দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা মহা ব্যস্ত।
শতাধিক দলিল লেখক এবং তাদের পাঁচ শতাধিক সহকারী আরও বেশি ব্যস্ত। এ কার্যালয়ে ২০২২ সালের শুরুতে যোগদান করেন সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ। যোগদানের পরপরই উত্তরসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও ঘুসের পাইপলাইনে যুক্ত হয়ে পড়েন।
অভিযোগ রয়েছে, এখানে ছোটখাটো দলিলের সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও সাবরেজিস্ট্রারকে প্রতি দলিলে সেরেস্তার নামে ৩ হাজার টাকা, দলিলের টিপসই বাবদ ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা ও প্রতিটি দলিলের নকল কপিতে (সার্টিফায়েড) স্বাক্ষর করতে দিতে হয় অতিরিক্ত এক হাজার টাকা। পাশাপাশি বিভিন্ন কাগজের প্রকারভেদ এবং দলিলের মূল্যের ওপর সাবরেজিস্ট্রারকে দিতে হয় ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। এই উপজেলা এবং নগরীর প্রতিটি জায়গা মূল্যবান হওয়ায় পান থেকে চুন খসলেই লাখ টাকা ঘুস দিয়েও সাবরেজিস্ট্রারের মন জয় করতে কষ্ট হয়। অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা দলিলের মূল্য কোটি টাকা ছাড়ালেই শুরু হয় ঘুসের দরকষাকষি।
সূত্র জানায়, সাবরেজিস্ট্রার এসব ঘুষের টাকা নিজের হাতে নেন না। সেরেস্তার টাকাটা নেওয়া হয় মোক্তারদের মাধ্যমে।
নকল স্বাক্ষরের টাকা নকলনবিশদের মাধ্যমে আর টিপসইয়ের টাকা নেওয়া হয় পিয়নের মাধ্যমে। উচ্চমূল্যের দলিল এবং ছোটখাটো ত্রুটিযুক্ত দলিলের ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্ট করার জন্য রয়েছে দালাল সিন্ডিকেট। অফিস সহকারী এবং পিয়নদের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট হওয়ার সিগন্যাল পেলেই দলিলে স্বাক্ষর করে দেন সাবরেজিস্ট্রার।
এই সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দলিল রেজিস্ট্রি হয় প্রায় ১ হাজার। দলিলের নকলের চাহিদা বেশি থাকায় স্বাক্ষর হয় প্রায় ১ হাজারের অধিক। হিসাব করে দেখা যায়, এসব রেজিস্ট্রিকৃত দলিল থেকে সেরেস্তা, নকল, টিপসই ও বিভিন্ন অজুহাতে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকা ঘুস নিচ্ছেন সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ। যার পুরো টাকাটাই আদায় করা হয় সরকার নির্ধারিত দলিল ফির বাইরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ডেভেলপার কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও প্রতিটি ফ্ল্যাট দলিল করতে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে নানা অজুহাতে ৫-১০ হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়। আর জমি রেজিস্ট্রি হলে কোনো কথাই নেই। অনেক খুঁটিনাটি দেনদরবার করতে হয় রেজিস্ট্রি করতে। কারণ কুমিল্লা শহরের জমি অত্যন্ত মূল্যবান। নগরীতে ১ থেকে ২০ কোটি টাকা শতাংশ পর্যন্ত জমির মূল্য রয়েছে।
বেশ কয়েকজন সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে দলিল লেখকরা সাবরেজিস্ট্রার এবং অফিস খরচের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। তবে মুখ খুললে মূল্যবান জমি এবং ফ্ল্যাট নিয়ে সমস্যা হতে পারে-এমন আশঙ্কায় কথা বলছেন না সেবাপ্রত্যাশীরা।
এ বিষয়ে সাবরেজিস্ট্রার মো. হানিফ বলেন, এখানে অতিরিক্ত কাজের চাপ। আমি যোগদান করেছি ২ বছরের বেশি হয়ে গেছে। এখন বদলি হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে আমরা কোনো টাকা-পয়সা নেই না। দলিল লেখক এবং দালাল সিন্ডিকেট সেবাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেয় বলে শুনেছি। কিন্তু এর দায় আমার না। আমার কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমি ব্যবস্থা নিতাম। তিনি আরও বলেন, যতদিন দলিল সাবমিট প্রসেস ডিজিটালাইজড না হবে ততদিন পর্যন্ত গ্রাহকদের নানাভাবে হয়রানির শিকার এবং অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। সূত্র : যুগান্তর
![](https://inews.zoombangla.com/wp-content/uploads/2024/03/34-5.jpg)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।