জুমবাংলা ডেস্ক : বাঙালি রমণীরা আগের দিনে ঘরে পরার জন্য দু’চারখানা আটপৌরে কম দামের সূতির শাড়ি রাখতেন । আর বাইরে পরার জন্য বাহারি জমকালো খান-কয়েক ওয়ার্ড্রবে তুলে রাখতেন – যার নাম তোলা-শাড়ি । কিন্তু ইদানীং নানা কারণে ঘরে-বাইরে প্রায় সবখানে শাড়ির জায়গা দখল করেছে টু-পিস, থ্রি-পিস, ম্যাক্সি , ইত্যাদি । এর মধ্যে কোনোটা ভারতীয় , কোনোটা পাকিস্তানী ।
এগুলি ঠাসাঠাসি করে পাশাপাশি থাকে , কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই । উভয়ের উদ্দেশ্য বাঙালি খদ্দেরের পকেট থেকে কিছু ভালোবাসা উপহার পাওয়া । তবে দিনকয়েক আগে ভারতীয় সংস্থা কর্তৃক ভৌগলিক পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ির নামে নিবন্ধন দেয়া নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে , তাতে শাড়ির একটু লাভ হয়েছে, বলা যায়। মনে হয়, বহুকাল পরে পোশাক জগতের মঞ্চে এসে শাড়ি একটু আলোচনায় শরীক হতে পেরেছে ।
শাড়ি পরার সময় আঁচল, পাড় আর জমিনকে এক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে আনতে পারা মেয়েদের জন্য একটা শৈল্পিক গুণ। কোন পর্যন্ত কুচি দিলে শাড়ির আঁচলটা যুতসইভাবে ঝুলে থেকে চেহারাখানাকে খোলতাই করে দিতে পারবে, তার জন্য একটা গভীর অন্তর্দৃষ্টি দরকার হয় । এই অন্তর্দৃষ্টির গুণে শাড়ির মাহাত্ম্য ফুটে ওঠে । এটা শিখতে সময় লাগে ।
তাই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা মা-চাচি-খালাদের দ্বারস্থ হয় । তবে শাড়ি পরার সাথে কিছু বাড়তি ধক্কলও আছে । ব্লাউজটা , পেটিকোটটা ম্যাচিং করে কিনে অথবা শাড়ি থেকে কাটিং করে অতঃপর ফিটিং করে বানিয়ে আনতে হয় । অধিকন্তু মাড় দেওয়া , ইস্ত্রি করা , এসব বাড়তি কাজ তো রয়েছেই । তবু শাড়ি-পরিধানের মধ্যে একটা বনেদি ব্যাপার-সেপার আছে । এই কসরতটা মহাকাব্যিক এবং মনোমুগ্ধকর । শাড়ির ভাগ্য ভালো যে, সিনেমা বা নাটকে দ্রৌপদির কাহিনী দেখাতে থ্রি-পিস পরলে চলবে না ; শরীর ঘুরাতে হবে, আর পরিধানের কাপড়কে অবয়ব বাড়িয়ে যেতেই হবে । বারো হাত দীর্ঘ আর আড়াই হাত চওড়া এই পোশাক ছাড়া এমন বৃহৎ বুকের পাটা আর কটা পরিচ্ছদের আছে ? তাই এ উপ-মহাদেশে পৌরাণিক কাহিনীগুলো যতদিন আছে , ততদিন শাড়িও থাকবে বলে আশা করা যায় ।
নানা রকমের শাড়ির মধ্যে টাঙ্গাইল শাড়ির একটা মস্তবড় সুনাম আছে । এটা গায়ে জড়ালে রোগা-পটকাদেরও মোটাসোটা দেখায় – শাড়ির শরীর বেশি আহ্লাদ করে পরিহিতার গায়ে এসে লেপ্টে থাকে না । ফলে শাড়ির জগতে টাঙ্গাইল শাড়ি একটা মর্যাদার আসনে সমাসীন । নামের মধ্যে ফলের পরিচয়ের মত টাঙ্গাইল শাড়ির উৎস বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলা । বহু বছরের ঐতিহ্য নিয়ে তাঁত শিল্পের এই মোহনীয় পণ্যটি বাংলাদেশের একটি গর্বের বস্তু। অন্যদিকে দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল থেকে কিছু কারিগর সম্প্রদায়ের লোক পশ্চিম বাংলার নদীয়া ও পূর্ব-বর্ধমান অঞ্চলে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন । তারা সেখানে টাঙ্গাইল শাড়ির প্রচলন করেন । সেইসাথে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়ে যাওয়া টাঙ্গাইল শাড়ি পরিধান করে শাড়িপ্রেমী ভারতীয় মহিলারা বেজায় খুশি । তাই টাঙ্গাইল শাড়ি সেখানকার নিবন্ধন সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে রাজখাতায় ভৌগলিক পণ্য হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেছে ।
দেশ ভাগ হয়েছে কিন্তু সংস্কৃতি তো ভাগ করা যায়নি – ভাষা , সাহিত্য , খাওয়া-পরার ধরণ, গান, নদীর পানি ভাগ করা যায়নি । যে দুই ভাই দুই দেশে থাকেন, তাদের পূর্ব-পুরুষের রক্তও তো ভাগ করা যায়নি । পদ্মা যেমন তার উজানের অগ্রজ নদী গঙ্গাকে অস্বীকার করতে পারে না , তেমনি ভাটিতে থাকা পদ্মার বিশালত্বকে গঙ্গা অস্বীকার করতে পারে না । যার যার নামের যে আলাদা আলাদা মাধুর্য , তা চির ভাস্বর হয়ে আছে । ‘টাঙ্গাইল’ নামটি বাংলাদেশের একটি জেলার নাম । এই নামের সাথে জুড়ে থাকা টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি পণ্য ।
শাড়ির পরিধান ঘরে ঘরে কমে গেলেও, শাড়ির প্রতি বাঙালি রমণীর অন্তরের ভালোবাসা এখনও অটুট রয়েছে । বিশেষ বিশেষ দিনে , পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আজও তারা শাড়ি পরাকে প্রাধান্য দেন । পয়লা বৈশাখে সাদা শাড়ি লাল পাড় , পয়লা ফাল্গুনে হলুদ বাসন্তী রঙের শাড়ি পরার রেওয়াজ চোখে পড়ার মত । তাই ঐতিহ্যের টানে রমণীরা সখের শাড়িগুলিকে ওয়ারড্রবে সাজিয়ে রেখে দেখভাল করে আনন্দ পান। স্মৃতি নাড়া দেওয়া সেসব শাড়ির মূল্য তাদের কাছে অনেক । এসব বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিবন্ধন সংস্থা অবশেষে টাঙ্গাইল শাড়িকে ভৌগলিক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছেন । এবার আবেদন জানালে হয়তো আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ত্ব সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশের ভৌগলিক পণ্য হিসেবে টাঙ্গাইল শাড়ির স্বীকৃতি মিলতে পারে । স্বীকৃতি মিলুক আর না মিলুক , একটা ফল তো হাতে-হাতে পাওয়া গেছে । পরিধেয় সামগ্রীর বাজারে শাড়ির ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তার সময়ে নিবন্ধন বিষয়ক শাড়ি-বিতর্ক এবার একটা বিজ্ঞাপনের মত কাজ ক’রে শাড়ির প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করা যায় ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।