সেলিম রেজা : বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে ৯৩ কিলোমিটার কমছে বেনাপোল-ঢাকার দূরত্ব। এতে সময় বাঁচবে চার ঘণ্টা। একইসঙ্গে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাড়বে। হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধি। বন্দর থেকে পণ্যবোঝাই ট্রাক দ্রুত সময়ে পৌঁছে যাবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে একদিকে যেমন পরিবহন খরচ কমবে, অন্যদিকে বাজারে পণ্যের দাম কমবে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বেনাপোল থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে ঢাকার দূরত্ব ২৭৮ কিলোমিটার। এই পথে ঢাকায় যেতে সময় লাগছে আট-নয় ঘণ্টা। মাঝে মধ্যে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। দুর্যোগকালীন ফেরি না পাওয়ায় নদীর পাড়ে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফলে আমদানি পণ্য নষ্ট হয়ে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা। বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে আসা বিদেশি পণ্য সঠিক সময়ে ঢাকায় পৌঁছাতে না পারায় বাজারে সংকট তৈরি হয়। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় দাম।
পদ্মা সেতু চালুর পর মাওয়া দিয়ে ঢাকার দূরত্ব হবে ১৮৫ কিলোমিটার। ঢাকায় যেতে সময় লাগবে চার-পাঁচ ঘণ্টা। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ ও পণ্যবাহী যানবাহন ফরিদপুর ও ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে সহজে ঢাকায় পৌঁছাবে। এছাড়া পচনশীল দ্রব্য; যেমন শাকসবজি, রেণুপোনা দ্রুত সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি বিদেশেও পাঠানো সম্ভব হবে। কৃষক, ফুল ও মাছ চাষিদের জন্যও আশীর্বাদ হবে পদ্মা সেতু।
সড়ক ও জনপথ অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম বলেন, ‘বেনাপোল থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে ঢাকার দূরত্ব ২৭৮ কিলোমিটার। ঢাকায় যেতে সময় লাগছে আট-নয় ঘণ্টা। মাঝে মধ্যে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। পদ্মা সেতু চালুর পর মাওয়া দিয়ে ঢাকার দূরত্ব হবে ১৮৫ কিলোমিটার। ঢাকায় যেতে সময় লাগবে চার-পাঁচ ঘণ্টা। এতে মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে।’
বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সিংহভাগ কলকারখানা ও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ৮০ শতাংশ কাঁচামাল বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি হয়। বন্দর থেকে খালাস করা কাঁচামাল দ্রুত সময়ে শিল্প ও কলকারখানায় পৌঁছে গেলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে যাবে। শিল্প ও কলকারখানা প্রসারিত হবে। কৃষিপণ্যের বাজার প্রসারিত হবে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউজ জানায়, বর্তমানে বেনাপোল কাস্টমস হাউজ থেকে সরকার প্রতি বছর ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায়। পদ্মা সেতুর কারণে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে, কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য স্বল্প সময়ে এবং কম খরচে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাবেন। এ অঞ্চলের সামগ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন হবে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামছুর রহমান বলেন, ‘জরুরি পণ্য পরিবহনের সময় বেনাপোল বন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু ঘুরে যেতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার তুলনায় আরও ৬০-৭০ কিলোমিটার বেড়ে যায়। সময় ও ব্যয় বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়ে। এখন যাতায়াত সহজ হওয়ায় দাম কমবে। ভোগান্তিও কমে যাবে।’
বেনাপোল আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সভাপতি মহসিন মিলন বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। কম সময় লাগার কারণে বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ বাড়বে ব্যবসায়ীদের। আমদানি-রফতানিকারকদের আর্থিক ক্ষতি কমবে। সময়ও বাঁচবে।’
বেনাপোলের ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে পদ্মা সেতু। দেশ থেকে রফতানি বাড়বে দ্বিগুণ। হারানো গৌরব ফিরে পাবে বেনাপোল বন্দর।’
বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন গাজী বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ব্যবসার প্রসার ঘটলে পণ্য পরিবহনের জোগান বাড়বে। বেনাপোল বন্দর থেকে প্রতিদিন ৭০০ পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যায়। সেতু চালুর পর আমদানি-রফতানিতে গতি বাড়বে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।’
সোহাগ পরিবহনের বেনাপোল অফিসের ম্যানেজার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে যাতায়াতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। ঢাকা থেকে বেনাপোল আসতে এখন সময় লাগে আট-নয় ঘণ্টা। দুর্যোগকালীন আরও বেশি সময় লাগে। সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে বেনাপোল আসতে লাগবে চার-পাঁচ ঘণ্টা।’
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘এ অঞ্চলের মানুষের জন্য দুর্গম পথ ছিল ঢাকা। বেনাপোল থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে আট-নয় ঘণ্টা সময় লেগে যেতো। প্রতি বছর শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশার কারণে পদ্মার দুই পাড়ে শত শত যানবাহন এবং হাজার মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে দেখেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকায় পড়াশোনা করতে পারেনি এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। বহু রোগী সময় মতো পদ্মা পার হতে না পেরে ফেরিঘাটে মারা গেছেন। এবার এসব দুর্ভোগ দূর হবে।’
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের যুগ্ম কমিশনার আব্দুর রশিদ মিয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। সেতুতে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে দ্রুত ও কম খরচে পণ্য খালাস করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে ভারতে যাত্রী পারাপার বাড়বে। বর্তমানে বেনাপোল চেকপোাস্ট দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যাতায়াত করছেন। পদ্মা সেতু চালু হলে যাত্রী পারাপার দ্বিগুণ হবে। বাড়বে রাজস্ব আয়।’
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে, এটা আমাদের খুবই আনন্দের বিষয়। বেনাপোল দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়বে দ্বিগুণ। বেনাপোল দিয়ে রেলপথে মালামাল আমদানি বেড়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে পণ্য খালাসের পর দ্রুত সময়ে রেলযোগে পৌঁছে যাবে ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হবে।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।