লাইফস্টাইল ডেস্ক : আপনার সঙ্গী হয়তো অভিযোগ করছেন যে আপনি রাতের বেলা ভীষণ নাক ডাকেন। ঘুমের মধ্যে আপনার হাসফাস লাগে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ওঠার পরও দিনের বেলায় ঝিমুনি হয়। এসব সমস্যাকে হালকাভাবে না নিয়ে জানার চেষ্টা করুন আপনি স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত কি না।
একজন পালমোনোলজিস্ট বা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারবেন। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কারণ হচ্ছে সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার প্রভাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো, চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া এমনকি সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক অবনতি হওয়ার মতো সমস্যায় পড়ে থাকেন।
তবে কেউ যদি রোগ শনাক্তের সাথে সাথে ব্যবস্থা নেন, তাহলে এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কী?
স্লিপ হলো ‘ঘুম’ এবং অ্যাপনিয়া বলতে মেডিক্যালের ভাষায় ‘শ্বাসরুদ্ধ’ হওয়া বোঝায়। সে হিসেবে স্লিপ অ্যাপনিয়া হচ্ছে ঘুমানোর সময় শ্বাসনালী কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া।
শ্বাসনালী যতক্ষণ বন্ধ থাকে, রোগী নিশ্বাস নিতে পারেন না। এতে বাইরে থেকে বাতাসের মাধ্যমে অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করতে পারে না।
এতে মস্তিষ্ক, হার্ট বা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিনের পর দিন কিছু সময়ের জন্য অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। যার প্রভাবে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্যমতে, ঘুমের সময় আমাদের ঘাড় ও গলার চারপাশের মাংসপেশী শিথিল হলে ভেতরের দিকে এলিয়ে পড়ে। এ কারণে ঘুমানোর সময় সবারই শ্বাসনালীর কিছুটা সংকোচন ঘটে।
যাদের পেশীর শিথিলতা অন্যদের চেয়ে বেশি, বিশেষ করে যারা স্থূলতায় ভুগছেন, তাদের শ্বাসনালীর সংকোচন অনেক বেশি হয়, যা শ্বাসনালীর পথ বন্ধ করে দিতে পারে।
শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল রাখতে অক্সিজেন খাদ্যের মতো কাজ করে। যখন অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, তখন মস্তিষ্ক সিগন্যাল দিয়ে রোগীকে জাগিয়ে তোলে, যেন তিনি নিশ্বাস নেন এবং তখন সংকুচিত শ্বাসনালী খুলে যায়।
এভাবে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগী বার বার জেগে ওঠেন। বার বার ঘুম ভাঙার কারণে তারা ক্লান্ত থাকেন, ফলে দিনের বেলায় ঝিমুতে থাকেন।
সুইডেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে তাদের গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা আড়াই গুণ বেশি। এছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার হারও বেশি থাকে।
লক্ষণ
জাতীয় নাক কান গলা ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ স্লিপ অ্যাপনিয়ার এমন কিছু লক্ষণের কথা জানিয়েছেন।
– অস্বাভাবিক নাক ডাকা। অস্বাভাবিক বলতে হঠাৎ জোরে ডাকছেন, আবার থেমে যাচ্ছে, তারপর আবার ভিন্ন স্বরে নাক ডাকছেন। এই ব্যাখ্যা আপনার সাথে যিনি ঘুমান, তিনি ভালো দিতে পারবেন।
– মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়, বিশেষ করে চিৎ হয়ে ঘুমানোর সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে ওঠেন বা বসে পড়েন, কিছু সময়ের জন্য হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়।
– অনেক সময় ঘুমানোর পরও ক্লান্ত লাগে, কাজ করতে গিয়ে বা গাড়ি চালাতে গিয়ে হুট করে ঘুমিয়ে পড়েন।
– মেজাজ খিটখিটে থাকে।
– কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না, অবসাদগ্রস্ত লাগে।
– কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না।
– ভুলে যাওয়ার সমস্যা।
– ওষুধ খেয়েও রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।
– পা ম্যাজ ম্যাজ করা, মাথাব্যথা করা।
স্লিপ অ্যাপনিয়া পরীক্ষা
স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কি না বুঝতে একজন বিশেষজ্ঞ রোগীর পূর্ণাঙ্গ স্লিপ স্টাডি বা পলিস মনোগ্রাফি করে থাকেন।
অর্থাৎ রোগী যখন ঘুমান, তখন তার চোখের মুভমেন্ট, নাক ডাকা, হার্ট রেট, ব্রেন ওয়েভ, মাসল টুইচিং, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, এমন প্রায় ২০টি প্যারামিটার দেখা হয়।
রোগী কতক্ষণ গভীরভাবে ঘুমিয়েছেন, কখন ঘুম পাতলা হয়ে গেছে বা জেগে উঠেছেন সেটির নোট নেয়া হয়।
এর মাধ্যমে চিকিৎসকরা বোঝার চেষ্টা করেন যে তার স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কিনা, থাকলে সেটি কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এই স্লিপ স্টাডি হাসপাতাল বা রোগীর বাসা যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে। সাধারণত বাংলাদেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোয় স্লিপ স্টাডির সব ধরণের সুবিধা দেয়া আছে।
এই স্লিপ স্টাডি সাধারণত একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ দেখে থাকেন।
চিকিৎসা
প্রাথমিক পর্যায়ের স্লিপ অ্যাপনিয়া ধরা পড়লে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
তবে দীর্ঘদিন যদি এই সমস্যার সুরাহা করা না হয়, তাহলে পরিস্থিতি জটিল আকার নেবে এবং শরীরের জরুরি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়া শুরু হবে। এতে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা ও ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে; যার প্রভাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া জটিল আকার নিলে চিকিৎসকরা রোগীকে কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেশার বা সি প্যাপ নামে একটি যন্ত্রের সাহায্য নিতে বলেন।
এ যন্ত্রটি অনেকটা বক্সের মতো এবং এর সাথে মোটা পাইপের সংযোগ দিয়ে একটি মাস্ক বসানো থাকে। রোগীকে প্রতিবার ঘুমের সময় এ মাস্কটি পরতে হয়।
যন্ত্রটি মূলত ঘুমের মধ্যে রোগীর শ্বাসনালী খোলা রাখতে সাহায্য করে এবং অক্সিজেনের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখে।
ফলে শরীরের অঙ্গগুলোকে আর অক্সিজেনের ঘাটতিতে ভুগতে হয় না। এতে অনেক জটিল রোগের নিরাময় সম্ভব হয়।
তবে যন্ত্রটির ব্যবহার শুরুতে শুরুতে অস্বস্তিকর, যদিও পরে অভ্যাস হয়ে যায়।
নিয়ম হচ্ছে, প্রতিবার ঘুমের সময় এই যন্ত্র ব্যবহার করা। এমনকি ভ্রমণের সময়ও সাথে রাখা, অনেকটা চশমার মতো।
অনেকেই আছেন যারা স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে কিছুদিন যন্ত্র ব্যবহারের পর তা ফেলে রাখেন। এমনটি করা যাবে না।
তবে যারা সি-প্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন না, তাদের বিকল্প চিকিৎসা নিতে হয়। যেমন, গলার টনসিল বা নাকের পেশি বড় হয়ে গেলে তা অপারেশন করা।
ম্যান্ডিবুলার অ্যাডভান্সমেন্ট ডিভাইস-ম্যাড ব্যবহার। এটি মুখের নিচের চোয়ালকে সামনে এগিয়ে রাখতে দাঁতের চারপাশে বসানো এক ধরণের যন্ত্র, যা শ্বাসনালী খোলা রাখতে সাহায্য করে। তবে এই যন্ত্র ব্যবহারের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, যেমন চোয়াল, মাড়ি ও দাঁতে ব্যথা করা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া।
লেজার অপারেশনের মাধ্যমে শ্বাসনালীর পরিধি বড় করাও একটি প্রক্রিয়া।
এছাড়া জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
যেমন- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিস/রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ও মদপান পরিহার, কাত হয়ে ঘুমানো।
তবে ওজন কমালেই স্লিপ অ্যাপনিয়া চলে যাবে সেটা বলা যায় না; এতে রোগটি মোকাবিলা করা, নিয়ন্ত্রণে রাখা আগের তুলনায় সহজ হবে এবং জটিলতা কমে যাবে।
নাক ডাকার সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সম্পর্ক
নাক ডাকা মানেই যে আপনার স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে, বিষয়টা তেমন নয়। তবে যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে, তাদের বেশিরভাগের নাক ডাকার সমস্যা আছে।
শোয়ার সময় পেশী যখন শিথিল হয়, তখন শ্বাসনালীর টিউবটি সংকুচিত হয়ে যায়। এতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় হুইসেলের মতো শব্দ হয়। এটাকেই নাক ডাকা বলে।
যখন শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায়, তখন নাক ডাকাও বন্ধ হয়ে যায়। আবার ব্রেন সিগন্যাল দেয়ার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায় এবং রোগী শ্বাস নিতে থাকে।
শুধু নাক ডাকার চিকিৎসা আরো সহজ ও ভিন্ন হয়ে থাকে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া কাদের হয়?
নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-স্থূলকায় বা হালকা গড়নের মানুষ সবাই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
তবে যাদের ওজন বেশি বা স্থূলতায় ভুগছেন, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যাদের গলা ও ঘাড় চওড়া, জিহ্বা ভারী, তাদেরও আশঙ্কা বেশি থাকে। কেননা, এতে বেশি পরিমাণ পেশি শিথিল হয়ে শ্বাসনালী আটকে যায়।
গলায় টনসিল ফুলে গিয়ে এমনটা হতে পারে। শ্বাসনালী ও গলার সংযোগ স্থলে অনেক সময় মাংসপেশি ফুলে যায়, যেটাকে অ্যাডনয়েড বলা হয়। এছাড়া অনেক সময় নাকের ভেতরে মাংসপেশি বড় হয়ে যায়।
স্লিপ অ্যাপনিয়ায় নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
সাধারণত ৩৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী এবং বংশে কারো স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভোগার হার তিন গুণ বেশি যেহেতু ধূমপায়ীদের গলার পেছনের মাংসপেশী ফুলে যায়, যা শ্বাসনালী আটকে দেয়। তাই ধূমপান ছাড়া জরুরি।
চিৎ হয়ে ঘুমানো, সেইসাথে যারা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেস বা সিওপিডিতে আক্রান্ত, তাদের স্লিপ অ্যাপনিয়ায় ভোগার ঝুঁকি থাকে।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।