আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরাইল যে বহুদিন ধরেই নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে আসছে, তা নতুন কোনো তথ্য নয়। তবে দেশটি কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই অস্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি।
সম্প্রতি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে রয়েছে দাবি করে ইসরাইল হামলা শুরু করেছে। পাল্টা জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে। এতে করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান—পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে ‘এনপিটি’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও ইসরাইল কখনোই এই চুক্তিতে সই করেনি। ফলে দেশটি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-কে তার পরমাণু স্থাপনায় পরিদর্শনের সুযোগ দিতে বাধ্য নয়, যদিও ইসরাইল IAEA-এর সদস্য।
তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে যা কিছু জানা যায়, তার বেশিরভাগই গোপন তথ্য ফাঁস, মার্কিন প্রতিরক্ষা বা জ্বালানি দপ্তরের পুরনো প্রতিবেদন, কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত।
এ ক্ষেত্রেই আলোচনায় উঠে আসে ইসরাইলের সাবেক পারমাণবিক প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনুর নাম।
কে ছিলেন মোর্দেচাই ভানুনু?
ভানুনু ছিলেন ইসরাইলের ডিমোনা পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করা একজন প্রকৌশলী। ১৯৮৫ সালে চাকরিচ্যুত হওয়ার আগে প্রায় ৯ বছর তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। তিনি গোপনে পারমাণবিক কেন্দ্রটির অনেক ছবি তুলে রাখেন, যেখানে অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ সংরক্ষণের প্রমাণ মেলে।
১৯৮৬ সালে তিনি ব্রিটিশ সংবাদপত্র The Sunday Times-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার দেন এবং ছবিগুলো প্রকাশ করতে রাজি হন। তার এই ফাঁসের মাধ্যমেই বিশ্ব জানতে পারে ইসরাইলের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির বিস্তারিত।
এরপর ভানুনুকে অপহরণ করে ইসরাইলে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রদ্রোহ ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৪ সালে তিনি মুক্তি পান, তবে এখনো তার বিদেশ যাত্রা ও আন্তর্জাতিক সংযোগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে ইসরাইলের ‘ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা’
ইসরাইল কখনো প্রকাশ্যে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার না করলেও, তারা অস্বীকারও করে না। এই নীতিকে বলা হয় ‘আমিমুত’— অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা।
ইসরাইলের পরমাণু বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেন বলেছেন, এই নীতিই ইসরাইলের পারমাণবিক যুগের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজও তার আত্মজীবনীতে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
কীভাবে ফাঁস হয় ইসরাইলের পারমাণবিক পরিকল্পনা?
প্রথমবার ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচির ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৯৬২ সালের মার্কিন নথিতে। সেখানে উল্লেখ ছিল, ১৯৫০-এর দশকে ফ্রান্সের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল দক্ষিণাঞ্চলে একটি পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে।
এই কেন্দ্রটির নাম নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার, যা ডিমোনা শহরের নিকটে একটি মরুভূমিতে অবস্থিত। একসময় ইসরাইল এটি একটি বস্ত্রশিল্প কারখানা এবং কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বলে প্রচার করত। কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন পার্লামেন্টে প্রথমবার স্বীকার করেন যে, এটি একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র।
ভানুনুর ফাঁস ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ভানুনু The Sunday Times-কে জানান, ইসরাইল তখন ১০০–২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ধারণ করত। যদিও আজও ইসরাইল এই অস্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি।
পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সুইডিশ প্রতিষ্ঠান SIPRI-এর মতে, বর্তমানে ইসরাইলের কাছে আনুমানিক ৯০টি ওয়ারহেড থাকতে পারে।
এই ওয়ারহেড তৈরির জন্য ব্যবহৃত প্লুটোনিয়াম মূলত ডিমোনার সেই গবেষণা কেন্দ্রেই উৎপন্ন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যদিও ইসরাইল দাবি করে চুল্লিটির ক্ষমতা মাত্র ২৬ মেগাওয়াট, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এর প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি।
চুল্লিটি আন্তর্জাতিক কোনো পরিদর্শনের আওতায় নেই, ফলে এর ব্যবহারের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই সম্ভব নয়।
মধ্যপ্রাচ্য কি কখনো পারমাণবিক মুক্ত হবে?
২০১২ সালে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যেখানে ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের আহ্বান জানানো হয়। তবে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়।
ইরান এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী হলেও ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় তারা সেখান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে।
জাতিসংঘে প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব আসে। কিন্তু ইসরাইল তা প্রত্যাখ্যান করে, বরং এটিকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে দাবি করে।
বিশ্লেষক জেভিয়ার বোহিগাস মনে করেন, ইসরাইলের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা খুবই উদ্বেগজনক। তারা জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করেও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ আন্তর্জাতিক মহল তেমন কিছুই করতে পারছে না।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।