ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ : রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল রুটে একাধিকবার বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোরেল সার্ভিস। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। তবে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, সমস্যাটি মানুষের সৃষ্টি। মেট্রোরেলে মানুষ চলাচলে অভ্যস্ত না হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। অভ্যস্ত হলে সমস্যা কেটে যাবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষ লোক দিয়ে মেট্রোরেল পরিচালনার কারণে মেট্রোরেলে এই সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া মেট্রোরেল ব্যবস্থায় লো ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা থাকায় তারের ওপর কোনো কিছু পড়লেই বাধাগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ। তাই মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য হাই ভোল্ডেজের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ লোক তৈরির পরামর্শ তাদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের মেট্রোরেলে চলাচলের অভিজ্ঞতা নতুন। তাই বিভিন্ন সময় যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেলে সমস্যা হতেই পারে। তাই যান্ত্রিক ত্রুটির দায় যাত্রীদের ওপর চাপানো ঠিক না। এছাড়া আমাদের এখানে যারা মেট্রোরেল পরিচালনা করেন, তারা আগে থেকেই প্রশিক্ষিত নয়।
তাদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করা হচ্ছে। তাই বলে মেট্রোরেল পরিচালনায় কোনো অদক্ষ লোক নেই-এটা বলা যাবে না। দক্ষ জনবল সংকটের কারণে অদক্ষ লোক দিয়ে কাজ করানো হয়। মেট্রোরেলে অদক্ষ লোকদের কারণে সমস্যা হতেই পারে।’ সেজন্য ঘন ঘন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল তৈরির পরামর্শ দেন তিনি।
ঘুড়ি উড়ালে মেট্রোরেল বন্ধ হবে কেন? ॥ দেশের প্রথম মেট্রোরেল ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ নির্মাণ করা হচ্ছে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত। ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইন মতিঝিল পর্যন্ত চালু হয়েছে। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে কমলাপুর অংশটি চালু হবে।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরের দিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে মেট্রোরেলে সাধারণ যাত্রী পরিবহন করা হয়। কিন্তু মেট্রোরেল চালুর একদিন পরেই বৈদ্যুতিক তারে ফানুস আটকে থাকার কারণে বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোরেল। এরপর গত বছরের শুরুতে মেট্রো লাইনসংলগ্ন ভবনের ছাদে নেড়ে দেওয়া কাপড় বিদ্যুতের তারে পড়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ঢিল ছুড়ে মেট্রোর গ্লাস ভাঙায় কিছুক্ষণের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া গত বছর বহুবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। কখনো ঘুড়ি, কখনো ফানুস আবার কাপড় পড়ে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তাই স্থানীয়দের প্রশ্ন মেট্রোরেলের কারনে কি আমরা কাপড় শুকানো ও ঘুড়ি উড়াতে পারবো না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে সাবেক এক মেকানিক্যাল(যন্ত্র) প্রকৌলশী জনকন্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় মেট্রোরেলের মূল সমস্যা হলো লো ভোল্টেজের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। অন্যান্য দেশের মেট্রোরেল পরিচালিত হয় ২৫০০-২৮০০ ডিসি ভোল্টেজে। কিন্তু আমাদের এখানে মেট্রোরেল চলে ডিসি ১৫০০ ভোল্টেজে। তাই বৈদ্যুতিক তারের উপর কিছু পড়লেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। তাই মেট্রোরেল এলাকায় ঘুড়ি উড়ানো ও কাপড় শুকানো বন্ধ করে দিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
এজন্য মেট্রোরেলের কারণে ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ করে দিবে মানুষ- এটা হতে পারে না। বিশে^ বিভিন্ন দেশে বৈদ্যুতিক ট্রেন চলছে। তাদের দেশে কি এই সমস্যা হয় না। তাই বলে ট্রেন বন্ধ করে দেয় বলে আমার মনে হয় না।’
মেট্রোরেল চলে ডিসি ১৫০০ ভোল্টেজ বিদ্যুতে ॥ মেট্রোরেলের লাইনের দুই পাশে বুমের (খুঁটি) মাধ্যমে ট্রেনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থাটিকে বলা হয় ‘ওভারহেড ক্যাটিনারি সিস্টেম’। রেল লাইনের দুইপাশে ১৫-২০ মিটার দূরত্বে এক-একটি খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এই খুটির মাধ্যমে বিদুতিক তারটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি ট্রেনে উপরে চারটি ফেন-টুর (বিদ্যুৎ সংযোগের তার) মাধ্যমে ডিসি ১৫০০ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ঢাকায় বিদ্যুতের পাওয়ার কম রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে অনেক বেশী ভোল্টেজ বিদ্যুতে চলে মেট্রোরেল সার্ভিস।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেট্রোরেলের এক কর্মকর্তা জানান, ভারতের হায়দ্রাবাদের মেট্রোরেলের সঙ্গে ঢাকার মেট্রোরেলের মিল রয়েছে। তবে ঢাকায় বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম রাখা হয়েছে। ডিসি ১৫০০ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে চলে এই ট্রেন। অথচ হায়দ্রাবাদের ২৫ হাজার ভোল্টেজে মেট্রোরেল চলাচল করে।’’
যান্ত্রিক ত্রুটিতে একাধিকবার বন্ধ ছিল মেট্রোরেল ॥ রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল রুটে গত বছর ৫ নভেম্বর থেকে ৪ ঘন্টার জন্য চালু হয় মেট্রোরেল সার্ভিস। এর পর গত ২০ জানুয়ারি থেকে উত্তরা-মতিঝিল রুটে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলাচল করছে মেট্রোরেল। এই রুটে গত ১ মাসে চারবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় সোয়া ১ ঘন্টা বন্ধ ছিলো মেট্রোরেল সার্ভিস।
রাজধানীর পল্লবী স্টেশনে হঠাৎ ট্রেনের স্বয়ংক্রিয় দরজায় (অটোমেটিক ডোর) সমস্যা দেখা দিলে ওইদিন দুপুর ২টা ৩৮ মিনিটে থেকে ৩ টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ছিল। সমস্যা সমাধান হলে পরে বিকেল ৩ টা ৫৫ মিনিটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এ সময় বিভিন্ন মেট্রোস্টেশনে ও ট্রেন আটকে পড়ে যাত্রীরা। এতে দীর্ঘ সময় ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে যাত্রীরা জানান।
এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কাজীপাড়ায় মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারের ওপর ঘুড়ি উড়ে পড়লে মেট্রোরেল চলাচল প্রায় আধ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। পরে বৈদ্যুতিক তার থেকে ঘুড়ি অপসারণ করে মেট্রোরেল চালু করা হয়। এই ঘটনায় পুলিশ প্রাপ্তবয়স্ক ২ জনকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক ৬ জনকে মুচলেকা দিয়ে থানা থেকে তার পরিবারের কাছে সোপর্দ করা হয়। গত ৪ ফেব্রুয়ারি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন বৈদ্যুতিক সিগন্যাল পদ্ধতির সমস্যার কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল সার্ভিস।
এ ছাড়া গত ২৩ জানুয়ারি হঠাৎ মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর কাওরানবাজার থেকে শাহবাগমুখী রুটে লাইনের মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারের ওপর ডিসের তার পড়ে পৌনে এক ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল চলাচল। তারটি সরানোর পর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটের দিকে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। ট্রেন বন্ধ থাকায় প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের ভিড় জমে যায়। এভাবে গত এক মাসে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চারবার বন্ধ হয় মেট্রোরেল সার্ভিস। তবে যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, মনুষ্য সৃষ্টি সমস্যার কারণে মেট্রোরেল বন্ধ হয়েছে বলে দাবি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যববস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন, ‘মেট্রোরেলে কোনো অদক্ষ লোক নেই। আমরা ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ লোক তৈরি করেছি। তাদের দিয়েই মেট্রোরেল সার্ভিস পরিচালনা করা হচ্ছে। মতিঝিল রুটে মেট্রোরেল চালুর ফলে কিছু সমস্যা হয়েছে। এটা মানুষ অভ্যস্ত না হওয়ার কারণে হয়েছে। এটা মনুষ্য সৃষ্টি সমস্যা।
কোনো যাত্রী স্বয়ংক্রিয় দরজা (অটোমেটিক ডোর) খোলার জন্য ইমার্জেন্সি বাটনে চাপ দেয়া সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখন লোক এসে দরজাটি ঠিক করতে কিছু সময় লেগে যায়। এতে ট্রেন চলাচল কিছু সময় বন্ধ ছিলো। এছাড়া মেট্রোরেলের তারের ওপর ঘুড়ি পড়ে সমস্যা তৈরি করেছে। মেট্রোরেল এলাকায় ঘুড়ি উড়ানো নিষেধ করা হয়েছে। এর আগে দুর্বৃত্তরা মেট্রোরেলের ক্যাবল কেঁটে ফেলোছিল। এতে ট্রেন চলাচলে সমস্যা হয়।
এগুলো সব মানুষ সৃষ্টি সমস্যা। মেট্রোরেল সার্ভিস পুরোটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। কোথাও সমস্যা হলে পুরো লাইনে সমস্যা তৈরি হয়।’ তবে মেট্রোরেল সার্ভিসে কোনো অদক্ষ লোক নেই বলে দাবি করেন তিনি। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।