লাইফস্টাইল ডেস্ক : কাজের চাপ বা ক্লান্ত শরীরে কখনো কখনো অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব হতে পারে, যাকে ঠিক হ্যালুসিনেশন বলা যায় না। অলৌকিক কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া, ভৌতিক শব্দ শোনা, অযৌক্তিক গন্ধ পাওয়া, মৃত মানুষের সঙ্গে কথা বলা, অলৌকিক কারও দ্বারা কিছু করতে বাধ্য হওয়াকে সাধারণত হ্যালুসিনেশন বলে।
হ্যালুসিনেশনে ভোগা অনেকেই শোনেন- তাকে কেউ মরে যেতে বলছে। অনেকে আবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন।
প্রতিবেদনের আলোচনার বিষয়টি একটু ভিন্ন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই অভিজ্ঞতাকে ‘অনুভূত উপস্থিতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এখানে যে ক’জন ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একজন লুক রবার্টসন। তিনি ২০১৫ সালের দিকে অ্যান্টার্কটিকায় স্কিইং করতে গিয়েছিলেন। তুষার এবং বরফে ঘেরা ওই জায়গায় লুক একাই ছিলেন।
তিনি ৪০ দিনের পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন- কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহের মাঝেই কিছু জায়গায় গোলমাল বাধে। ফলে পুরো ব্যাপারটাই এলোমেলো হয়ে যায়। তিনি দক্ষিণ মেরুতে অবস্থানের সময় জটলা বেধে যাওয়া জায়গাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন।
সব মিলে ক’দিনের মধ্যেই হাঁপিয়ে ওঠেন লুক। ক্লান্তি ও অবসাদে ভুগতে শুরু করেন তিনি।
এরইমধ্যে একদিন তিনি তার আশপাশে তাকিয়ে অনুভব করলেন চারপাশে সবুজ মাঠ। তিনি স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিনশায়ারে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
বিবিসি রেডিওর ‘অল ইন মাইন্ড’ অনুষ্ঠানে রবার্টসন জানান সে সময়কার অভিজ্ঞতা।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় তার চার্জারগুলো কাজ করছিলো না। তিনি গান বা কোনো মিউজিকও শুনতে পারছিলেন না। চারপাশে শুধু শোনা যাচ্ছিলো অ্যান্টার্কটিকার জোর শব্দ আর বাতাসের ‘শো শো’।
লুক জানান, যতই দিন যাচ্ছিলো- ততই তার অদ্ভুত লাগছিল। তিনি শুনতে পেতেন- কেউ তার নাম ধরে ডাকছেন, তার পিছু পিছু হাঁটছেন। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকালে আর কাউকে দেখতে পেতেন না।
একবার যখন ক্লান্তিতে আর হাঁটতে পারছিলেন না, তখন তিনি বরফের মধ্যেই বসে পড়েছিলেন। সে মুহূর্তে তার মনে হয়েছিলো- একজন নারী কণ্ঠ তাকে বলছে, এগিয়ে চলো। ওই শব্দের পেছনে পেছনে এগিয়ে গিয়ে সেবার তিনি রক্ষা পান।
তখন ওই ডাকে এগিয়ে না গেলে খারাপ কিছু ঘটতে পারতো, যোগ করেন লুক। হয়তো তিনি জীবিত ফিরেই আসতে পারতেননা, কারণ চারপাশে তুষার ধস হচ্ছিলো।
অন্যান্য আরো বেশ কয়েকজন অভিযাত্রী জানিয়েছেন, তারাও যাত্রার সময় একই ধরনের শব্দ এবং সহযোগিতা পেয়েছেন।
আর্নেস্ট শ্যাকলটন ১৯১৯ সালে তার বইয়ে লেখেন-, যখন তারা ৩৬ ঘণ্টা লম্বা সময় ধরে ট্রেক করছিলেন এবং তার দলের তিনজনই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন- তখন তার মনে হয়েছিলো তারা তিনজনই সেখানে নেই, আরো কেউ একজন তাদের সাথে আছেন। পরে অবশ্য তার মতের সাথে বাকিরাও একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। তারাও স্বীকার করেন, সবার একইধরনের অনুভূতি হয়েছিল।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এ ধরনের অভিজ্ঞতাকে ‘অনুভূত উপস্থিতি’ বলা হয়। যুক্তরাজ্যের ডারহাম ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক বেন অ্যাল্ডারসন-ডে তার ‘প্রেজেন্স: দ্য স্ট্রেঞ্জ সায়েন্স অ্যান্ড ট্রু স্টোরিজ অফ দ্য আনসিন আদার’ বইয়ে লিখেছেন, এই অভিজ্ঞতাগুলো শুধু চরম পরিস্থিতিতেই হয়না।
তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, আপনিও হয়তো কখনো কখনো যখন ঘরে একা, তখন অনুভব করেছেন, আরও কেউ আছে- যদিও আপনি তাদের কখনো দেখতে পাননি। যারা খারাপ সময় পার করেন বা মনোব্যাধিতে ভোগেন তাদের জন্য এমনটা ঘটা খুব অবাস্তব নয়।
তিনি এক জরিপের উদাহরণ দিয়ে বলেন, যেখানে পারকিনসন্স আক্রান্তদের রোগীদের এক-চতুর্থাংশই দাবি করছেন, তারা বহুবার এমন অনুভব করেছেন। গবেষণাটিতে বলা হয়, যখন কেউ জেগে ওঠে বা ঘুমিয়ে থাকে তখন এটি ঘটতে পারে।
পারকিনসন্স রোগ হলে মস্তিষ্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতি দেখা যায়। মানুষের ব্রেনে ছোট একটি অংশ রয়েছে, যেটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা’ বলা হয়।
ওই অংশের স্নায়ুকোষ বা নিউরন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার (এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ) নষ্ট হয়ে যায় অথবা এর ঘাটতি দেখা দেয়।
স্বাভাবিক অবস্থায় মস্তিষ্কে ব্যাজাল গ্যাংলিয়া নামের একটি অংশ মানুষের চলাফেরা এবং গতির সমন্বয় করে থাকে, ডোপামিনের অভাবে সেই সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তখন একজন মানুষ আক্রান্ত হয় পারকিনসন্স রোগে।
কারো কারো আবার এমনও হয় যে, তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর নড়াচড়া করতে পারছেন না। তখন, কেউ কেউ অনুভব করতে পারেন- ঘরের মধ্যে কেউ আছেন। অনেকে আবার অনুভব করেন, কেউ তাদের বুকের ওপর বসে আছেন এবং তাদের চেপে ধরেছেন।
অ্যাল্ডারসন-ডে দেখেছেন যে, বেশিরভাগ সময়ই ঘুমের মধ্যকার এসব পরিস্থিতি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি তৈরি করে। অনুভব হয়, কেউ একজন সাথে আছে এবং খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয় ভুক্তভোগীদের- যা বর্ণনা করা কষ্টকর।
এই বিষয়গুলো শারীরিক ইন্দ্রিয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না। স্পর্শ, দৃষ্টি, শ্রবণ, গন্ধ বা স্বাদ এর সাথে জড়িত না; তাই একে হ্যালুসিনেশনও বলা যায় না।
বস্তুনিষ্ঠভাবে একে বাস্তবই মনে করা হয়, কিন্তু আসলে এমন কিছু সেই জায়গায় ঘটনার সময় উপস্থিত থাকে না। এ ধরনের অনুভূতি চিন্তার সাথে জড়িত।
অনেকে একে ‘ঘন বাতাসে’র মতো অস্পষ্ট কিছু হিসেবে দাবি করেন। যা প্রায় একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মতো এবং ঘটনার সময়ে খুব বাস্তব মনে হয়।
অ্যাল্ডারসন-ডে ব্যাখ্যার জন্য তার অনুসন্ধানে শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সংমিশ্রণের চেষ্টা করছেন। তিনি ধারণা করেন, পর্বতারোহী এবং অভিযাত্রীদের সাথে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব ঘটে থাকতে পারে।
তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন- এটা কি এমন কোনো উপস্থিতি জাগিয়ে তোলে- যা আমাদের বিরূপ পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে সহায়তা করেন?
রবার্টসনের নিজস্ব ব্যাখ্যা হলো, কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যখন তার যাত্রা চলছিল- তখন তাকে সহায়তা করার জন্য তার মস্তিষ্ক তাকে এমন অনুভূতি দিয়েছিল। তাই তিনি কখনও বাড়ির ছবি দেখেছেন আবার কখনো একটি কণ্ঠস্বর তাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
গবেষণা বলছে, কিছু লোকের ‘অনুভূত উপস্থিতি’ অনুভব করার প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশি। অল্পবয়সীদের মধ্যেও এ অনুভূতি লক্ষ্য করা যায়।
জেনেভার একটি গবেষণাগারে গবেষকরা একটি রোবট তৈরি করেছেন, যা একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্ককে বোঝাতে পারে যে, আপনার পেছনে কেউ একজন আছেন। ফলাফলে তারা দেখতে পান, পারকিনসন্সে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে বেশি সংবেদনশীল।
গবেষণায় একটি নেটওয়ার্কে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের এক অস্বাভাবিক প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে টেম্পোরো প্যারিটাল জংশন, ইনসুলার এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স।
দেখা যায়, ইন্দ্রিয়গুলোকে একীভূত করার সাথে যুক্ত এলাকা এবং শরীরের অবস্থান মিলে এ ধরনের অনুভূতি তৈরি হয়।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বলা যায়, যখন আমাদের ভুল হয়, শরীরের ওপর চাপ যায় তখন এমন অদ্ভুত অনুভূতি হতে পারে।
অ্যাল্ডারসন-ডে’র মতে, মস্তিষ্ক ‘সেখানে কী আছে সে সম্পর্কে একটি অবহিত অনুমান নেয়।’
তার মতে, আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি হতে পারে। যেমন ওই পর্বোতারোহীদের অনুভব হয়েছিল যে, অদৃশ্য কেউ একজন তাদের সহায়তা করছে।
অ্যাল্ডারসন-ডে বিশ্বাস করেন, আসলে কি ঘটছে তা বোঝার জন্য আমাদের আরো গবেষণা এবং অধ্যয়ন দরকার।
তিনি মনে করেন, এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললে তা ভুক্তভোগীদের উদ্বেগ কমাতে পারে। সাইকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরকে কারও কণ্ঠ শুনতে পাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়ে থাকলেও, কারও অনুভূত উপস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার ঘটনা বিরল।
অ্যাল্ডারসন-ডে বিশ্বাস করেন, এই অনুভূতিগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এসবের মোকাবেলা করার উপায় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
অথবা একজন ব্যক্তি যে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা মনে করেন- তিনি যদি জানতে পারেন- তিনি একাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেই; তার মতো আরো অনেকে আছে- তা তার মনোবল বাড়িয়ে দিতে পারে।
রবার্টসন শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছেছিলেন, যদিও তিনি প্রথমবার গবেষণা কেন্দ্রটি দেখে ভেবেছিলেন তিনি এটি কল্পনা করছেন। তিনি এই অভিজ্ঞতাগুলো সম্পর্কে আরও আলোচনা করতে চান, যাতে তার মতো অভিযাত্রীরা তাদের সাথে কী ঘটছে তা বুঝতে পারেন এবং তাদের হাতে থাকা কাজটিতে মনোযোগ দিতে সাহায্য করতে পারেন। এতে করে এই অদৃশ্য অতিথিরা বাধা দেয়ার পরিবর্তে সহায়তা করতে পারবেন বলে আশা তার। সূত্র: বিবিসি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।