আবু নাঈম : বিশাল একটি এলাকাজুড়েই বাঁশঝাড়, বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ ও বনজবৃক্ষ। নানা ফসলের ক্ষেত। মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি কাঁচা সড়ক। এটি ব্যবহার করছেন কৃষি কাজে নিয়োজিত গুটি কয়েক মানুষ। পাশেই ভারতের বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে বেশ বড় কয়েকটি চা বাগান। সবুজ প্রকৃতির সুনসান নীরবতায় মোহবিষ্ট করে সীমান্তের এপার-ওপার উড়ে চলা হরেক রকম পাখির কলকাকলি। এ যেন সবুজ প্রকৃতি আর প্রতিবেশি দু’দেশের একসঙ্গে পাশাপাশি চলার একটি ছবির মতোই দৃশ্য।
জনবসতিহীন সবুজ প্রকৃতির চমৎকার এ দৃশ্যটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে ওঠা দুই দশক আগে বিলুপ্ত হওয়া চান্দাপাড়া গ্রামের।
গত দুই দশক আগেও গ্রামটিতে বংশপরম্পরায় কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন পেশার প্রায় ৭০টি পরিবার বাস করতো। বিভিন্ন উৎসবে হতো নানা আয়োজন। গ্রামের সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর নির্মাণ করা হয়েছিল একটি জামে মসজিদ। স্থানীয়দের মতে আশপাশের কয়েক গ্রামের মধ্যে এটিই প্রথম আধাপাকা মসজিদ। এটি প্রাত্যহিক নামাজের পাশাপাশি ধর্মীয় পাঠশালা হিসেবেও সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। মসজিদটি ঠিক কবে কে নির্মাণ করেছেন, সে সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনদের কাছে সুনির্দিষ্ট তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ওই গ্রামে একসময় বাস করতেন আফাজউদ্দীন (৯০)। তিনি বলেন, ২০০০ সালের কথা। হঠাৎই সবুজ গাছপালা আর কৃষি ক্ষেতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা গ্রামটি ভারতীয় গরু চোর ও ডাকাতদের রোষানলের শিকারে পরিণত হয়। সন্ধ্যা নামতেই ভারতীয় চোর-ডাকাতের দল গ্রামটিতে হানা দিত। লুটে নিয়ে যেত গ্রামের গরু, মহিষসহ সর্বস্ব। কখনো কখনো নারীদের ওপরও চালাতো বর্বরতা। ওই সময়ই জমি নিয়ে গ্রামবাসীর দু’পক্ষের সংঘর্ষে আব্দুস সালাম নামে এক ব্যক্তি নিহত হলে গ্রামে বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যে কারণে স্থানীয়রা যে যার মতো পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঠাঁই খুঁজে নেন।
একই কথা জানালেন, গ্রাম ছেড়ে যাওয়া মানিক হোসেন ও আলেমা বেগম। তারা জানান, গ্রামটিতে বংশপরম্পরায় তারা বেশ সুখে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় চোর-ডাকাতের অত্যাচার আর গ্রামে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের পর সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যান। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই অন্যত্র চলে যাওয়ায় চান্দাপাড়া গ্রাম বলতে কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে সেই এলাকায় এখন কোনো জনবসতি নেই।
পার্শ্ববর্তী মীরগড় গ্রামের স্কুল শিক্ষক নূর আজম ও শাহাজুল ইসলাম জানান, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় কাপড় সেলাই করার জন্য একমাত্র চান্দাপাড়াতেই ইয়াছিন আলী নামের একজন দর্জি ছিলেন। পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের মানুষ যেতেন সেই গ্রামে কাপড় সেলাই করতে। তিনিও তার বাবার হাত ধরে অনেকবার গেছেন সেই গ্রামে। কয়েক বছরের ব্যবধানে একসময়ের ব্যস্ত সেই চান্দাপাড়া এখন বিরানভূমি। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে গ্রাম ছিল।
গ্রামবাসীরা চলে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে নিজের অবস্থানেই রয়ে গেছে চান্দাপাড়ার সেই আধাপাকা জামে মসজিদটি। ওই মসজিদে দীর্ঘ দিন মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসা রুহুল আমিন বলেন, গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেলে মসজিদে লোক আসা বন্ধ হয়ে যায়। লোকজন না থাকায় এলাকাটি নীরব, নিস্তব্ধ ও ভূতুড়ে পরিবেশে সৃষ্টি হওয়ার কারণে একসময় মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
সীমানা প্রাচীর ও দেয়ালে ফাটল ধরা মসজিদটির একপাশে মৃতব্যক্তি দাফনে ব্যবহৃত কাঠের পুরনো একটি খাটিয়া, সামনে অব্যহৃত অকেজো একটি নলকূপ আর দেয়ালের বাইরে ওজু করার পানির জন্য নির্মিত একটি কুয়ো রয়েছে। স্থানীয়দের প্রয়োজন আর কালের ধারায় গ্রামটি হারিয়ে গেলেও স্বারক হিসেবে চান্দাপাড়া জামে মসজিদটি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখুক এমনটাই প্রত্যাশা করেন স্থানীয়রা ।
গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়রম্যান মনোয়ার হোসেন দিপু বলেন, গ্রামটিতে ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী শতবছর ধরে বাস করতেন। গ্রামে থাকা মসজিদে ছোট ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষাদানও করা হতো। ভারতীয় চোর-ডাকাতের উপদ্রবে গ্রামের মানুষ অন্যত্র চলে যাওয়ায় চান্দাপাড়ায় পরিত্যক্ত থাকা শত বছরের পুরনো মসজিদটি স্মৃতি ধরে রেখেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।