নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: ১২ বছর আগে দৃষ্টি হারান খাইরুল ইসলাম। এরপর থেকেই তার চোখে পৃথিবী অন্ধকার। তাই বলে থেমে থাকবেন খাইরুল? না, থেমে যাননি। চোখে না দেখেও ছোট্ট একটি টং-দোকানে ব্যবসা করে চালাচ্ছেন সংসার। কারণ, ক্রেতারাই তাকে বেচাকেনায় সহযোগিতা করেন। এতে হয় না হিসাবের গরমিলও।
খাইরুলের ক্রেতা মূলত স্থানীয় স্কুল শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ ১২ বছর ধরেই তার সব লেনদেনের কাজটি করছেন খুদে শিক্ষার্থীরা। ক্রেতা হিসেবে ওই শিক্ষার্থীরা দোকান থেকে যা-ই কেনে না কেন,তার মূল্য নির্দিষ্ট বাক্সে রেখে দোকানিকে বলে যান কত টাকা রেখে যাওয়া হলো। এই বিশ্বাস আর অল্প কিছু পুঁজিতেই খাইরুলের দোকান চলে। চলে সংসারও। এজন্য দোকানটির নাম দিয়েছেন ‘ব্যতিক্রম সততার স্টোর’।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে খাইরুলের এই দোকানের অবস্থান। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার। সম্বল বলতে আছে শুধুই ভিটেমাটি। জন্মের পর থেকে অভাব তার পিছু না ছাড়লেও আত্মপ্রত্যয়ী খায়রুল থেমে থাকেননি। চোখে না দেখলেও জীবিকার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, প্রতিদিন সকালে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় দোকানে গিয়ে তালা খোলেন খাইরুল। প্রথমে দোকান গোছগাছে সহযোগিতা করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর বেচাকেনা শুরু হলে একের পর এক শিক্ষার্থী দোকানে গিয়ে পণ্য চেয়ে নেন। কোনো শিক্ষার্থী খাতা চাইলে খাইরুল হাত উঁচু করেন। শিক্ষার্থীরা তখন নির্দেশনা দেয়, ‘একটু বামে, একটু ওপরে’ সেই নির্দেশনা পেয়ে খাইরুল ঠিক ঠিক পণ্যটি খুঁজে পান। তুলে দেন ক্রেতা শিক্ষার্থীর কাছে। এছাড়া বেশিভাগ সময় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই পণ্য নিয়ে টাকা বাক্সে রেখে যান।
বাইজিত নামের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আঙ্কেলের দোকানে যা-ই কিনি, ঠিক ঠিক টাকা পরিশোধ করি। আঙ্কেল অনেক ভালো মানুষ। তাকে কেউ ঠকায় না।’
রোকাইয়া নামের পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আঙ্কেল চোখে দেখতে পান না। যদি তার অসুবিধা হয়, তখন আমরা তাকে সহযোগিতা করি।’
আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আঙ্কেল চোখে দেখতে পান না। কিন্তু তিনি হাত দিয়ে দোকানের জিনিস ধরতে পারেন। যদি তার অসুবিধা হয়, তখন আমরা তাকে সহযোগিতা করি।’
কথা হয় দোকানমালিক খাইরুল ইসলামের সঙ্গে। দোকানের হিসাব-নিকাশে কোনো গরমিল হয়নি এই বারো বছরে। বাড়ি থেকে দোকানে যাওয়া ও দোকান বন্ধ করে বাড়িতে ফেরার সময় সহযোগিতা করছে শিক্ষার্থীরা, জানান তিনি।
তিনি বলেন, বেশিভাগ শিশু তাকে ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকে। অনেকে ‘খাইরুল ভাই’ও বলে। তার নিজের দুই সন্তান। একজন মাহফুজা আক্তার। সে গাজীপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অন্যজন মাহিম আহমেদ। সে গাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।
খাইরুল জানান, মাত্র দশবছর বয়সেই বাবা-মাকে হারান তিনি। এরপর পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়া খাইরুল অনেক কষ্টে নিজেকে তৈরি করেন। একসময় কাজ নেন স্থানীয় কাজী গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে দীর্ঘদিন চাকরি করেন। কিন্তু ১২ বছর আগে হঠাৎ তার চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে। খুব দ্রুতই তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। এরপর তিনি ঠিক করেন,বাড়ির পাশের বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দোকান দেবেন।
তার ইচ্ছার কথা জানালে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে দোকান স্থাপনের অনুমতি দেয়। তিনি অন্ধত্বকে ভুলে গিয়ে দোকান শুরু করেন। শুরু থেকেই তার ক্রেতা হিসেবে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে সহযোগিতা করতে থাকে। দোকানের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী ও তার মধ্যে নির্মোহ সততার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তিনি বলেন, শুরুতে তার স্ত্রী তাকে দোকানে নিয়ে যেতেন। দোকানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে পুরোপুরি গুছিয়ে দিয়ে যেতেন। কিন্তু দ্রুতই তাকে দোকানে নিয়ে আসার কাজটিতে সহযোগিতার হাত বাড়ায় শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লাকী আক্তার বলেন, ‘খাইরুল ভাই একজন অন্ধ ব্যক্তি। এ দোকান দিয়ে তার সংসার চলে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সততার সঙ্গে তার দোকান থেকে কেনাকাটা করেন। তাকে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে।’
শিক্ষক রোজী আক্তার বলেন, ‘ অন্ধ খাইরুল ভাই খুবই দরিদ্র একজন ব্যক্তি। দোকান পরিচালনার কাজে তার স্ত্রী তাকে সহযোগিতা করেন। মাঝে মাঝে খাইরুল ভাই ভুল করে কাউকে টাকা বেশি দিয়ে দিলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সততার সঙ্গে ফেরত দেয়।’
প্রধান শিক্ষক মাহিনুর ইসলাম বলেন, খাইরুল ইসলাম একজন জীবনযোদ্ধা। তার জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। মানুষ কীভাবে নিজের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে জীবন চালিয়ে নেয়, সংসারের চাকা ঘোরায়, তা দেখিয়েছেন খায়রুল। আমরা তাকে এখানে দোকান চালানোর অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে একটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছি বলে মনে করি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।