অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবদুল হাই : ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশিতে বিচরণশীল একটি ছোট্ট জেলিফিশ বিজ্ঞানকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জেলি ফিসটির বৈজ্ঞানিক নাম Turritopsis dohrmi। এ মাছটি মরণশীল নয় বরং চিরজীবী। ৫০০ মিলিয়ন বছরের তরুণ জেলিফিশের দেখাও মিলেছে। দেখা গেছে, উক্ত জেলিফিশটি যখনই আঘাতের সম্মুখীন হয় বা বিরূপ কোনো পরিবেশের সম্মুখীন হয়, তখনই তার শরীর-কোষ নিজেই নিজেকে পুনঃনির্মাণ করে বা পুনরায় নতুন করে গড়ে তুলে।
বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে অন্য প্রাণীর পক্ষেও কী এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব?
বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখন এ নিয়ে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এক অংশ মনে করেন, অধুনা মলিকুলার সায়েন্স যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আগামী কয়েক দশকে এটা অর্জন সম্ভব। অন্যপক্ষ, এ ব্যাপারে মোটেই আশাবাদী নন।
তবে মানুষের অমর হওয়ার স্বপ্ন অনেক পুরনো। হাজার বছর ধরে আলকেমিরা মৃত সঞ্জীবনী সুরা উদ্ভাবনের চেষ্টা কম করেনি। বিজ্ঞানী নিউটনও একসময় আলকেমিদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। অমরত্বের স্বপ্ন মানুষের অধরাই রয়ে গেছে।
সাধারণত আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কোষে পরিবর্তন আসে।
আমাদের ডিএনএ-তে এক ধরনের মিউটেশন বা গঠনগত পরিবর্তন হয়। শরীরের কোষগুলোর সাধারণ নিয়ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত বিভক্ত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ প্রক্রিয়া স্লথ হয়ে যায়। কোষ যখন বিভক্ত হতে পারে না, তখন সে শক্তি হারিয়ে ফেলে, মেটাবলিজমের কারণে কোষের ভেতর নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি হয়। এতে করে ধীরে ধীরে কিছু কিছু কোষের মৃত্যু ঘটতে থাকে। অন্যদিকে সূক্ষ্ম রক্তনালীগুলোও ধীরে ধীরে আরও সংকুচিত হয়ে থাকে, এতে অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই সঠিক ভাবে অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। সংক্ষেপে এটিই বার্ধক্যজনিত শরীরের বায়োলজি।
কিছু কিছু বিজ্ঞানী, যেমন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অঁনৎবু উব এৎবু মনে করেন, বার্ধক্যজনিত এসব সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। আধুনিক টেকনোলজি প্রয়োগ করে ইতিমধ্যেই কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাস করা সম্ভবপর হয়েছে। কিছু আশাবাদী এবং ধনিক শ্রেণির মানুষ মনে করেন আগামী কয়েক দশকেই অমরত্ব না হলেও মানুষের আয়ু অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভবপর হবে। তাদের অনেকেরই বিশ্বাস, মৃত্যুর পর সঠিকভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা সম্ভব হলে বিজ্ঞানীরা তখন এই দেহে প্রাণ সঞ্চালন করতে সক্ষম হবেন। এদেরই একটি অংশ ইতিমধ্যেই মৃত্যুর পরপরই শরীর কবরস্থ না করে ফ্রিজিং সিস্টেমের ভেতর শরীর সংরক্ষণের পরিকল্পনা করে রেখেছেন। ইতিমধ্যে একটি কোম্পানিও গড়ে উঠেছে, যারা প্রতিটি মৃতদেহ ঠাণ্ডা লিক্যুইড নাইট্রোজেনে সংরক্ষণের জন্য ২০০০০০ ডলার ফি নির্ধারণ করেছে।
বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখেন না। একটি মেশিন বা গাড়ি যতই উন্নত টেকনোলজির হোক না কেন, এটাকে চিরদিন চালনা সম্ভবপর নয়। বিজ্ঞান এখনো মনে করে মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ ১২৫ বছর বাঁচা সম্ভব। যদিও গত ২৫ বছরে কেউই ১২৫ বছরের বয়সসীমা স্পর্শ করতে পারেননি। Jean Louise Calment নামীয় একজন মহিলা ১৯৮৭ সালে ১২২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বয়সী মানুষ তিনিই। তবে শতায়ু মানুষের সংখ্যা এ শতাব্দীতে অনেক বেশি বেড়েছে। এ হারে বাড়তে থাকলে পরিসংখ্যানবিদরা মনে করেন এ শতাব্দীতে সর্বোচ্চ আয়ু ১৫০ বছরে পৌঁছানো সম্ভব। যদিও বায়োলজিস্টরা এ ব্যাপারে এখনো সন্দিহান।
অন্যরকম এক আশার বাণী শুনিয়েছেন বিজ্ঞানী Roy Kurywell. তিনি মনে করেন আগামী ২০ বছরের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কে মেমোরি, নেটওয়ার্ক ইত্যাদি পুরোপুরি বিজ্ঞানের আয়ত্তে চলে আসবে। তখন মানুষের মস্তিষ্ক পুরোপুরি একটি উচ্চমানের কম্পিউটারে ডাউনলোড করে রাখা সম্ভব হবে। তখন শরীরকে পরিত্যক্ত করে ফেলে রেখে মেশিনের ভেতরেই বেঁচে থাকা সম্ভব। এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যাবে। আমরা মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু কি ডাউনলোড করতে সক্ষম হবো- যেমন ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি। অথবা বেঁচে থেকে কীভাবে শরীর ছাড়া উপভোগ করা যাবে খাদ্য বা নারী সঙ্গ। বেঁচে থাকারও তো একটা ফিলোসফি রয়েছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে কম আয়ুসম্পন্ন প্রাণীর নাম হলো গধুভষু. আয়ু মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এ সময়ের ভেতরই তার আনন্দ, বেদনা, জীবন, যৌবন ও মৃত্যু। এটাও তো একটা জীবন। Greenland Shark বেঁচে থাকে ২৯০ বছরেরও বেশি। জেলি ফিস এর কথা তো আগেও বলেছি। ৫০০ মিলিয়ন বছর ধরে এখনো বেঁচে আছে ওরা।
এ জীবনে যে আমরা বেঁচে আছি, আসলে সত্যিকারের বেঁচে থাকা কতোক্ষণ? বেশির ভাগ মানুষের জীবনে পূর্ণ আনন্দের স্মৃতি খুব অল্পই। হাজার বছর বেঁচে থাকার মানেই হাজার বছর বেঁচে থাকা নয়।
বিশ্বাসী মানুষ তো এমনিতেই অমর। মুসলিম বিশ্বাস মতে, মানুষের সব আত্মা একসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল আদম সৃষ্টিকালের সময়েই। দীর্ঘকাল স্রষ্টার সান্নিধ্য উপভোগ করে মানুষ মায়ের গর্ভে প্রবেশ করে। এখানে নয় মাস দশ দিন থেকে পৃথিবীর বুকে পা রাখে। এখানে মানুষের আয়ু কখনো কখনো কয়েক সেকেন্ডও হতে পারে, আবার ১২২ বছর হতে পারে। মানুষের মৃত্যু হয়, রুহের মৃত্যু নেই। রুহের মূল লক্ষ্য একটাই যে, স্বর্গে স্রষ্টার সান্নিধ্য ও আনন্দ সে উপভোগ করেছিল, আবার সেখানেই ফিরে যাওয়া। এ পথ পরিক্রমায় মানুষকে বাধা-বিপত্তি বিভ্রান্তির সম্মুখীন হতে হবে, কিন্তু স্রষ্টার দেখানো পথ ধরে, সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবার সে ঠিকই ফিরে যাবে আপন ঠিকানায়। এটাই মুসলিম বা অন্যান্য একাত্মবাদী ধর্মের ফিলোসফি।
অতীতে কবি বলেছিলেন, বর্তমান বিজ্ঞানও বলে, নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়, আর মানুষ তো অতি ক্ষুদ্র জীব। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষ সবসময়ই অস্থির, সব সময় মানুষ স্বপ্নের চেয়ে বড় হতে চায়। তাই পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকার স্বপ্ন অতীতেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
লেখক: (চর্ম, যৌন ও এলার্জি রোগ বিশেষজ্ঞ) জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চেম্বার: ১২, স্টেডিয়াম মার্কেট, সিলেট। ফোন: ০১৭১২-২৯১৮৮৭
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।