জুমবাংলা ডেস্ক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী। রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী খুব অল্প সময়ে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এ যেন রূপকথার সেই আলিফ লায়লাকে হার মানিয়েছে রায়পুরার এই লায়লার কাহিনি। এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো-
গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরাসহ রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়িঘর, ফ্ল্যাটসহ দেশে-বিদেশে ছেলে ও মেয়ের নামে একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও শত শত বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। গাজীপুরে ১০০ বিঘা জমির ওপর আপন ভুবন নামে একটি রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন। এই উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়ের নামে কানাডায় রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। সরকারি কলেজের একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক বনে গেলেন- এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী বলছেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চিহ্নিত রাজাকার ময়দর আলী দারোগার নাতনি হলেন লায়লা কানিজ লাকী। রাজাকার ও বিএনপি পরিবারের সন্তান হয়ে কীভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং এত সম্পদের মালিক বনে যান। এলাকায় কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। আগে লাকীদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এ ছাড়া লায়লা কানিজ লাকী একজন রাজাকারের নাতনি।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আবদুল কাদির ছিলেন রাজাকারদের সংগঠন শান্তি কমিটির সদস্য এবং মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি চিহ্নিত রাজাকার ময়দর আলী দারোগার জামাতা। এ ছাড়া তিনি বিএনপি পরিবারের সন্তান। তার চাচা এবং মামারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জানা গেছে, রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকী। তাদের ঘরে রয়েছে দুই সন্তান।
একজন তৌফিকুর রহমান অর্ণব এবং অপরজন ফারজানা রহমান ইপসিতা। অন্যদিকে আলোচিত তরুণ মুশফিকুর রহমান (ইফাত) মতিউর রহমানের দ্বিতীয় সংসারের প্রথম সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রী ফেনীর সোনাগাজী এলাকার শাম্মী আখতার। প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমীর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড় একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানেই ২০১৮ সালে তার পরিচয় হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর সঙ্গে।
২০২৩ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান সাদেকুর রহমান মারা গেলে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্যের প্রভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ। জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক। নামে-বেনামে দেশ-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। তার নির্বাচনি হলফনামা থেকে জানা গেছে, তার বাৎসরিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫, ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠা, গাজীপুরে ৫ কাঠা, গাজীপুরের পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ। এ ছাড়া গাজীপুরে ১০০ বিঘা জমির ওপর আপন ভুবন নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে।
তার মেয়ে ফারজানা ইসপিতার নামে মরজাল বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশ এলাকায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে। এ ছাড়া ছেলে আহম্মদ তৌফিক অনুদের নামে কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। ময়মংসিংহের ভালুকায় রয়েছে জুতার কারখানা। নাটোরের সিংরায় ২০ বিঘা জমি, গাজীপুরের পুবাইলে একাধিক রিসোর্টসহ বিস্তৃত পরিমাণ জমি রয়েছে।
শুধুমাত্র রাজধানীর ভাটারা এলাকাতেই মতিউর ও তার পরিবারের নামে রয়েছে ৪০টি প্লট। গুলশান-২ এ শাহবুদ্দিন পার্কের উল্টোদিকে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের একটি ভবনে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটগুলোর মূল্য প্রতিটি ৫ কোটি টাকার নিচে নয়। গুলশানের শান্তা প্রোপার্টিজের একটি ভবনে রয়েছে আটটি ফ্ল্যাট। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই ও আমেরিকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক।
নাম না প্রকাশের শর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, শিক্ষকতার আয়ে তার এত সম্পদ থাকার কথা নয়। শুধুমাত্র অবৈধ টাকার জোরেই লায়লা কানিজ লাকী রায়পুরার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। এসব টাকার সবই তার স্বামী আলোচিত রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অবৈধ উপার্জন।
মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি। গত শুক্রবার দুপুরে ওই বাড়িতে গেলে ভেতরে ঢুকতে দেননি বাড়ির দায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার। এ সময় তিনি জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান এখন বাড়িতে নেই। কোনো দরকার থাকলে রায়পুরা অফিসে যোগাযোগ করুন। এখন এখান থেকে চলে যান। আমার নাম জেনে আপনি কী করবেন। টাকা দেবেন? টাকা দেন বক্তব্য দেব! শুধু শুধু ছবি তুলবেন না। কিংবা ভিডিও করবেন না। সমস্যা হবে, চলে যান। ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। আলিশান গেট। বাড়ির ভিতরে রয়েছে দেশি-বিদেশি গাছের সারি, সবুজ ঘাসের আঙিনা, পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার রুম। বাড়ির ভিতরেই পেছনে রয়েছে বাঁধানো ঘাট ও বিশাল লেক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, বাড়িটির ভিতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে। এ বাড়িটিতে চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ থাকেন। এখানে আগে তেমন ভালো কোনো দালান ছিল না। প্রায় দুই বছর আগে এ বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণ করেন।
ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, দেড় একরের বেশি আয়তনজুড়ে পার্কটির অবস্থান। ভিতরে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। নির্ধারিত টাকায় এ কটেজে রাত্রিযাপন করা যায় বলেও জানান পার্কের গেটে থাকা আবু সাঈদ নামে একজন। এ ছাড়া পার্কে রয়েছে বিভিন্ন বয়সীদের জন্য বেশকিছু রাইড। পুরো পার্কজুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা এবং বিশাল আয়তনের একটি লেক। স্থানীয়দের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর পার্ক বলে প্রচারণা আছে। ছোট পার্কটিকে ক্রমে ক্রমে আধুনিক করে ইকো রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে।
বিমান বাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরি করে এত টাকার মালিক কীভাবে হলো এটা আমার বোধগম্য নয়। তিনি আমার জমিসহ অনেকের জমি দখল করেছেন। জমি ক্রয় করার কথা বলে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে জমি দখলে নেন। বাকি টাকা দেওয়ার পর রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে বলে কথা থাকলেও তিনি আর কোনো টাকা দেননি। জোর করে জমি দখলে নিয়ে ঢালাই করে পার্কের জন্য ব্যবহার করছেন। জোরপূর্বক এখনো আমার জমি দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া তিনি প্রশাসনিকভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিদা সুলতানা নাসিমা বলেন, উনি সরকারি চাকরি করেছেন, সম্মানিত একজন টিচার। এ অবস্থায় এত সম্পদের মালিক বনে যাওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া উনি আওয়ামী লীগের পরিবারের সদস্য নন। উনি একজন রাজাকারের নাতনি। উনার বাবার বাড়ি বলেন, নানার বাড়ি বলেন, সবাই বিএনপি। বিএনপি থেকে উনি আওয়ামী লীগ সেজেছেন। রায়পুরা উপজেলায় আওয়ামী লীগটাকে ভাগ করে দিয়েছেন। তছনছ করে দিয়েছেন পুরা উপজেলাটাকে।
এ ব্যাপারে রায়পুরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ময়দর আলী দারোগা ছিল তৎকালীন চিহ্নিত রাজাকার। এটা সবাই জানে। আর ময়দর আলী দারোগার জামাতা আবদুল কাদির চেয়ারম্যানের কথা আমার মনে নেই। রায়পুরা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসাইন বলেন, লায়লা কানিজ টাকার পাহাড় গড়েছেন। রায়পুরার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর উৎসাহেই রাজনীতিতে এসেছেন তিনি।
এসব বিষয়ে কথা বলতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী নরসিংদী রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি কল ধরেননি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।