জুমবাংলা ডেস্ক : গত সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে লাগামহীনভাবে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে বাজার। মাত্র ৩০/৪০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ২৮০টাকা পর্যন্ত। পেঁয়াজের ঘাটতি সামলাতে গিয়ে খুবই হিমশিম অবস্থায় পড়ে বাংলাদেশ।
উচ্চমূল্য দিয়ে তখন বিকল্প দেশ থেকে বিমানে করে জরুরিভাবে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ ঘাটতি পূরণের জন্য এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এরমধ্যে বাজারে নতুন পেঁয়াজ এসেছে। তবুও নিত্য ব্যবহার্য এই মসলা জাতীয় পণ্যের দাম এখনও প্রতি কেজি কমবেশি প্রায় ১০০ টাকা।
অথচ প্রায় দেড় দশক আগেই এই সমস্যা সমাধানের পথ দেখিয়েছিলেন তৎকালিন বারি বিজ্ঞানী ড. মোঃ মহব্বত উল্যাহ। যথাসময়ে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বেসামাল পেঁয়াজ সংকটের বোঝা বইতে হচ্ছে ভারত নির্ভর বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) জানাচ্ছে, পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর জন্য বারির বিজ্ঞানীরা ১৯৯৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ মহব্বত উল্যাহ ২০০২ সালে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের উপর গবেষণার কাজ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি উদ্ভাবন করেন বছরব্যাপী উৎপাদনযোগ্য উচ্চফলনশীল পেঁয়াজের অগ্রবর্তী জাত বারি ওএফ-৫। যা শীতকালীন দেশী চারটি জাতের পেঁয়াজের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি ফলন দেয়। শীতকালীন দেশী জাতের পেঁয়াজ বেলে দোআঁশ মাটি ছাড়া হয় না।
বারি-র তথ্য ও ড. মোঃ মহব্বত উল্যাহর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতকালীন জাতের পেঁয়াজ চাষ হয় বছরে মাত্র একবার। যা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ হয় না। ঘাটতি থাকে প্রায় ৮/১০ লাখ মেঃ টন। অন্যদিকে বারি পেঁয়াজ-৫ বছরে তিনবার অর্থাৎ সারা বছর চাষ করা যায়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে বারি পেঁয়াজ-৫ যে কোন মাটিতে হয়। মাটির নীচে নয়, বারি পেঁয়াজ-৫ মাটির উপরে শিকড় থেকে জন্মায়। ফলে আকারে বড় হয়। প্রতিটি ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের। পাঁচটি পেঁয়াজের ওজন হয় ১০০০ গ্রাম বা ১ কেজি। এছাড়া উৎপাদনের একমাস আগে সেচ বন্ধ রাখলে এজাতের পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। এতে করে তা ৮/১০ মাস সংরক্ষণ করা যায়। শীতকালীন দেশীয় জাতের পেঁয়াজ হেক্টরে ১০ টন উৎপাদন হয় মাত্র। অন্যদিকে বারি পেঁয়াজ-৫ এর আড়াই গুণ ফলন দেয়। যা প্রতি হেক্টরে ২৫ টন।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, কৃষি মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ১০ জুন বারি পেঁয়াজ-৫ মুক্তায়িত করে। কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের অভাবে মাঠ পর্যায়ে তা সঠিকভাবে নিতে পারছে না। কৃষককে কারিগরি শিক্ষা দিতে পরামর্শক নেয়ার সুযোগও কাজে লাগছে না। যথোপযুক্ত লোক না নেয়ার কারণকেই এ জন্য দায়ি করছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ। যদিও ২০১৬-২০২১ জুন পর্যন্ত মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ১৭৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান। পেঁয়াজে জোর দেয়ার নির্দেশনাও আছে মন্ত্রণালয় থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারি বিজ্ঞানী ড. মোঃ মহব্বত উল্যাহ ২০১৬ সালের ৩০ জুন অবসরে যান। বর্তমানে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড এর মসলা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিথযশা এই বিজ্ঞানীর একাধিক সাফল্যের কোনটাই রহস্যজনক কারণে পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি।
ড. মোঃ মহব্বত উল্যাহ জানান, এই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি যৌথ উদ্যোগে ২শ’ কৃষকের মাঠে বীজ ও চারা বিতরণের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি পরিদর্শনে যান সেখানকার সংসদ সদস্য কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি অন্যান্যদের সাথে বারি মহাপরিচালক ড. আবদুল ওহাব সেখানে যান বারি পেঁয়াজ-৫ উত্তোলন (হারভেস্ট) পরিদর্শনে। সেখানে হেক্টরে উৎপাদন পাওয়া যায় ২৫ টন। তিনি (বারি মহাপরিচালক) ১০ কেজি করে বারি পেঁয়াজ-৫ নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন কৃষিমন্ত্রী ও কৃষি সচিবের জন্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ৩১ লাখ মেঃ টন। উৎপাদন হয় প্রায় ২৪ লাখ মেঃ টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বছরে বর্তমানে ৮/১০ লাখ মেঃ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে। যা ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানী করে পূরণ করতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লেগে যায়। চলতি বছর এই ঘাটতি অন্যান্য দেশ থেকে আমদানী করে পূরণ করতে হয়েছে। যা করতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লেগে গেছে। অন্য সময়ের তুলনায় এবার এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
বারি পেঁয়াজ-৫ এর সম্ভাবনা নিয়ে দেশের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় নানা শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও তা মাঠ পর্যায়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কি সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, কেন এখনও ৮/১০ লাখ মেঃ টন পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণে ২/৩ হাজার কেটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে- প্রশ্নের যুক্তিসংগত উত্তর মিলছে না। বারি পেঁয়াজ-৫ এর সম্ভাবনাকে সাফল্যে পরিণত করতে আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে তাও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। এখন তা কেবল দেখার অপেক্ষায় থাকাটাই আমাদের জন্য আশা জাগিয়ে রাখার শেষ অবলম্বন বলা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।