ড. আলি কারাহ দাগি : আল্লাহতায়ালা দুইটি কারণে মুসলিমদের জন্য জাকাত ফরজ করেছেন। প্রথমত, ধনীর মন ও চিন্তা-ভাবনা থেকে লোভ-লালসা দূর করা এবং দরিদ্র ব্যক্তির মনকে হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত করা। দ্বিতীয় কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সম্পদের প্রবৃদ্ধি। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১০৩)।
আয়াতের মধ্যে ‘তাজকিয়া’ বা পরিশোধন দ্বারা আত্মিক ও বাহ্যিক উন্নয়নের মধ্যে বাহ্যিক অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। ইসলামি অর্থনীতিতে দরিদ্র ব্যক্তিকে জাকাতের মাধ্যমে নিঃস্ব থেকে স্বাবলম্বী করা যায়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে সর্বপ্রথম উমর (রা.)-এর যুগে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছিল। আবু মুসা আশআরি (রা.)-কে ইয়ামানে পাঠানোর দুই বছর পর তিনি সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ উমর (রা.)-এর কাছে পাঠিয়ে বলেন, আমার এখানে কোনো উপযুক্ত দরিদ্র লোক নেই।
জাকাতের যথার্থ ব্যবহার : জাকাতের রূপরেখা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয় উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর সময়ে। তিনি মাত্র দুই বছর ছয় মাস ১৭ দিন ছয় ঘণ্টা খেলাফতের দায়িত্বভার পালন করেছেন। এ সময়ে অতি নিঃস্ব-দরিদ্র ও অক্ষম ব্যক্তিদের প্রয়োজন পূরণ করে সামর্থ্যবান করা হয়। আর কর্মক্ষম ব্যক্তিদের মূলধন ও উৎপাদন যন্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। ফলে মাত্র দুই বছরের ভেতর পুরো মুসলিমবিশ্ব অভাবমুক্ত হয়ে পড়ে। মূলত নিঃস্ব ও অসহায় মানুষের অভাব দূর করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করাই জাকাতের প্রধান উদ্দেশ্য। মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সমাজের স্থিতিশীলতা প্রধান লক্ষ্য। মানুষের সাময়িক ক্ষুধা-অভাব মোচন করা জাকাতের মূল লক্ষ্য নয়। প্রখ্যাত আলেম ইয়াহইয়া (রহ.) বর্ণনা করেছেন, ‘আমি আফ্রিকায় গিয়ে কোনো অভাবীকে খুঁজে পাইনি। উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর কাছে তিনি পত্র লিখে জানান, এখানে কোনো অভাবী নেই। তখন উমর (রা.) জাকাতের অর্থ দাস মুক্ত করতে ও তরুণ-তরুণীদের বিবাহকার্যে ব্যয়ের নির্দেশ দেন।
সব বস্তুর জাকাত আছে : জাকাতের বিধানটি কেবল সম্পদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। বরং নিজের সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও জাকাতের বিধান প্রযোজ্য হবে। ইসলামের সব বিধিবিধান সর্বজনীন ও সমন্বিত নীতির অনুগামী। তাই মানুষের ভোগ করা সবকিছুতে জাকাতের বিধান প্রযোজ্য হবে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে ইলমের জাকাত আদায় হয়। কোরআনে বর্ণিত খাতে সম্পদ ব্যয়ের মাধ্যমে সম্পদের জাকাত আদায় হয়। তাই আল্লাহ প্রদত্ত সবকিছুতেই জাকাত আছে।
জাকাত সংগ্রহে প্রয়োজন স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান : ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মুসলিমদের মোট জাকাতের পরিমাণ প্রায় ৩শ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪শ বিলিয়ন ডলার। উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর মতো সমন্বিতভাবে জাকাতের মাধ্যমে মানুষকে স্বাবলম্বী করে উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হলে জাকাতের এ অর্থ মুসলিম অভাবীদের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যথার্থ হবে। দুঃখের বিষয় হলো, জাকাত সংগ্রহে কোনো সমন্বিত ব্যবস্থা নেই যেমন, তেমনি তা বণ্টনেরও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা নেই। অথচ জাকাতের বিধান বাস্তবায়নের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এটি কোরআনের আয়াত থেকেও বোঝা যায়। এদিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং জাকাত সংগ্রহের কর্মচারীদের জন্য’। (সুরা তাওবাহ, আয়াত : ৬০)।
এখানে কর্মচারী দ্বারা জাকাত সংগ্রহ-সরবরাহের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বোঝানো হয়েছে। কোরআনে একমাত্র জাকাতের বিধানের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্র এ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারবে, পরিচালনায় থাকবেন দ্বীনদার, খোদাভীরু শরিয়তবিশেষজ্ঞ আলেমরা। তারা জাকাতকে সব রকমের অন্যায়-অবিচারের অভিযোগ থেকে মুক্ত রাখতে কাজ করবে।
অসহায়ের সহযোগিতা উত্তম : ব্যক্তিগত হিসাব মতে, ১৪৪০ হিজরিতে রমজানে ওমরায় ব্যয়ের সর্বনিম্ন পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৬২২ মিলিয়ন ডলার। এ বছর কারও পক্ষে ওমরা পালন করা সম্ভব নয়। এ বছরের ওমরার অর্থ অভাবী ও অসহায় লোকদের জন্য ব্যয় করা হলে মুসলিমবিশ্বের দারিদ্র্যের হার অনেকাংশে কমে যাবে। মুসলিম দেশগুলোতে জাকাত ও ওমরার অর্থ সংগ্রহের জন্য ফান্ড গঠন করতে পারে। এ অর্থ দিয়ে দরিদ্রদের অভাবমুক্ত করা এবং কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া হবে। ইসলাম আমাদের এক কাজের বদলে অন্য কাজ করার সুযোগ দিয়েছে।
হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.) একবার হজে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কাফেলার একটি পাখি মারা যায়। এক ডাস্টবিনে সেটি ফেলে দেওয়া হয়। তিনি সঙ্গীদের থেকে একটু পিছিয়ে ছিলেন। ডাস্টবিনের কাছে এসে দেখলেন, পাশের ঘর থেকে একটি মেয়ে বের হয়ে মৃত পাখিটি ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনটি দেখে আবদুল্লাহ বিন মুবারক তাকে ডেকে তার অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটি বলল, আমার ও আমার ভাইয়ের গায়ের বস্ত্র ছাড়া আর কোনো কাপড় নেই। ডাস্টবিনের ফেলে দেওয়া বস্তু আমাদের খাবার। বাবা অনেক সম্পদশালী ছিলেন। কিন্তু জুলুম করে সব আত্মসাৎ করা হয় এবং তিনি নিহত হন। এ কথা শুনে আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রহ.) সহকারীকে বললেন, আমাদের সঙ্গে কী পরিমাণ অর্থ আছে? সে বধলল, এক হাজার দিনার। ফিরে যাওয়ার জন্য বিশ দিনার রেখে বাকি সব অর্থ মেয়েটিকে দিতে বললেন। আর বললেন, এ বছর হজ করার চেয়ে তাকে সাহায্য অনেক উত্তম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/১৮৭)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সেই মানুষ যে মানুষের কল্যাণ করে।’ (আত-তারগিব, হাদিস : ২৬২৩)। মানুষের উপকারের সর্বোত্তম সময় এখন। বৈশি^ক দুর্যোগে কর্মজীবী মানুষের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। অনুগ্রহ-অনুকম্পার মাস রমজানে মানুষকে আর্থিকভাবে সেবা করার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর প্রিয় ও নিকটতম হওয়ার এখনই সুবর্ণ সুযোগ। তাই বর্তমানের সংকটকালে একথা বলা যায় যে, দুর্যোগকালে নফল হজ ও ওমরার অর্থ অভাবী ও দরিদ্রদের সহযোগিতার জন্য দেওয়া অনেক উত্তম।
সুসংগঠিতভাবে জাকাত সংগ্রহ না করার সমস্যা : মুসলিমদের মধ্যে যারা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, আলেম ও বুদ্ধিমান, মূলত তারাই যথাযথ জাকাত আদায় করে থাকেন। সাধারণ মুসলিমের জাকাত সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান নেই। এ ব্যাপারে অনেক বিত্তবান মুসলিমের কোনো চিন্তা-ভাবনাও নেই। মধ্যপ্রাচ্যের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অমুকের জাকাত সম্পর্কে কি কিছু জানেন? তিনি তো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, সম্পদের পরিমাণও প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার হবে। লোকটি উত্তরে বললেন, ওনার ওপর জাকাত ফরজ নয়। কারণ ওনার বিশাল সম্পদের লাভের পুরোটাই এক বছর অতিবাহিত হওয়ার আগেই খরচ হয়ে যায়। তাছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষকে দান করে দেন। আমি বললাম, ভাই, আল্লাহকে ভয় করো। একজন সাধারণ লোকের পাঁচটি উট থাকলে আল্লাহতায়ালা একটি ছাগল জাকাত হিসেবে আবশ্যক করেছেন। আর ৪০টি ছাগল হলে একটি দেওয়া আবশ্যক। (বোখারি, হাদিস নং : ১৩৮৬)। আর তুমি বলছ, ৪০টি সুবিশাল ভবনের মালিক হয়েও তার ওপর জাকাত আবশ্যক হয় না। করোনা মহামারীর পূর্বে করা জাতিসংঘের হিসাব মতে মুসলিমবিশ্বে ৯৫০ মিলিয়ন দারিদ্র্যপীড়িত লোক আছে। বৈশ্বিক মহামারীর পর অবশ্যই এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই মানুষের মধ্যে অর্থ-সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের নীতিমালা না থাকলে অনেক বড় বড় সংকট দেখা দেবে।
জাকাত ব্যয়ের খাত : আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে জাকাত প্রদানের ৮টি খাত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় জাকাত নিঃস্ব, দরিদ্র, জাকাত সংগ্রহকারী, অন্তর আকর্ষণ, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরের জন্য, আল্লাহর আবশ্যকীয় বিধান, আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৬০)।
নিঃস্ব বলতে হতদরিদ্র ব্যক্তি যার একদম কিছুই নেই। দরিদ্র বলতে যার কেবল প্রয়োজন পূরণের সামর্থ্য আছে, কিন্তু অভাবগ্রস্ত। আর জাকাত সংগ্রহকারী বলতে যারা জাকাতের সংশ্লিষ্ট বিধানাবলি বাস্তবায়নে নিযুক্ত ব্যক্তি। অন্তর আকর্ষণ বলতে যারা নতুন ইসলাম গ্রহণ করে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দাসমুক্তির বিষয়টি পূর্বে বিদ্যমান ছিল। তবে কোরআনের শব্দপ্রয়োগ দ্বারা বোঝা যায়, বর্তমান সময়ের বন্দি, অপহরণকৃত ব্যক্তি ও বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্তদের জন্য জাকাত ব্যয় করা যাবে। ঋণগ্রস্তকে দায়মুক্তির জন্য জাকাত দেওয়া যাবে।
জাকাতের অর্থে নির্মাণকার্য : জাকাতের জন্য সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। যথাযথ জাকাত সংগ্রহ করে উপযুক্ত খাতে ব্যয়ের নিশ্চয়তা আবশ্যক। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দরিদ্রদের জন্য সুনির্দিষ্ট খাত নিশ্চিত করে এর পেছনে জাকাত ব্যয় করা যাবে। তবে এগুলোর পরিচালনায় একদল একনিষ্ঠ শরিয়তবিশেষজ্ঞ লোক থাকতে হবে যারা লেনদেনের শরিয়তবিষয়ক দিকগুলো দেখাশোনা করবেন।
ভাষান্তর : মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।