রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ফজরের আজান যখন ভেসে আসছিল, হাসপাতালের করিডরে দাঁড়িয়ে রফিকুল ইসলামের (৫২) চোখে ছিল ঘোর অন্ধকার। ডাক্তারের কথা বারবার কানে বাজছিল, “কিডনি প্রায় বিকল হবার পথে, নিয়মিত ডায়ালিসিস ছাড়া উপায় নেই।” মাত্র কয়েক মাস আগেও তিনি অফিসের কাজে ব্যস্ত, সংসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ক্লান্তি? তা তো বয়সের ভারে স্বাভাবিক। পা একটু ফুলেছে? গরমে হয়ত এমনই। প্রস্রাবে একটু ফেনা? কিছু মনে করেননি। এই ‘কিছু মনে না করা’ই তাকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের দোরগোড়ায়। রফিকুলের গল্পটি বিচ্ছিন্ন নয়; বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলোকে উপেক্ষা করে চলার কারণে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) বা এমনকি কিডনি ফেইলিওরের দিকে এগিয়ে যান। অথচ কিডনির সমস্যা চেনার লক্ষণ গুলো সময়মতো চিনতে পারলেই বিপদ অনেকটাই এড়ানো যায়।
কিডনি আমাদের শরীরের নীরব কর্মী, দু’টি ছোটো শিমের বীচির আকৃতির অঙ্গ। রক্ত শোধন করা, বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করা, হাড়ের সুস্থতা বজায় রাখা – এইসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিঃশব্দে করে চলে তারা। সমস্যা হলো, কিডনি অসুখের প্রাথমিক লক্ষণগুলো প্রায়ই খুব সূক্ষ্ম বা অন্য সাধারণ শারীরিক সমস্যার সাথে মিলে যায়। যখন স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয়, অনেক ক্ষেত্রেই তখন কিডনির ক্ষতি অনেকখানি হয়ে গেছে। তাই জরুরি সতর্ক সংকেত গুলো চিনে রাখা এবং সেগুলো দেখা মাত্রই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া – এই সতর্কতাই পারে আপনার কিডনিকে দীর্ঘদিন সচল রাখতে, পারে জীবন বাঁচাতে।
কিডনির সমস্যা চেনার ১০টি জরুরি সতর্ক সংকেত: জীবন বাঁচাতে চিনে নিন
এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে কখনোই ‘আরেকটু দেখি’ বা ‘নিজে নিজে ঠিক হয়ে যাবে’ ভাবার সুযোগ নেই। এগুলোই আপনার শরীরের পাঠানো SOS সংকেত:
- প্রস্রাবের ধরনে পরিবর্তন: এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক লক্ষণগুলোর একটি।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া: স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম প্রস্রাব হওয়া (বিশেষ করে যদি পানি খাওয়া স্বাভাবিক থাকে) বা রাতের বেলা বারবার বেশি পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া (নক্টুরিয়া)।
- প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন: গাঢ় হলুদ, বাদামি, লালচে বা কোকাকোলার মতো রঙ হওয়া। লালচে ভাব প্রস্রাবের সাথে রক্ত গেলে (হেমাটুরিয়া) হতে পারে।
- প্রস্রাবে ফেনা বা বুদবুদ হওয়া: প্রস্রাব করার পর টয়লেটে অনেকক্ষণ ধরে ফেনা জমে থাকলে তা প্রস্রাবে প্রোটিন লিকের (প্রোটিনুরিয়া) ইঙ্গিত, যা কিডনি ক্ষতির একটি বড় চিহ্ন।
- প্রস্রাব করতে কষ্ট বা ব্যথা হওয়া: জ্বালাপোড়া, ব্যথা বা চাপ লাগা অনুভব করা (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা কিডনিতে পাথরের লক্ষণ হতে পারে)।
- প্রস্রাবের বেগ কমে যাওয়া বা চাপ কম থাকা।
- শরীরে পানি আসা (ইডিমা): কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও সোডিয়াম বের হতে পারে না। ফলে পানি জমতে শুরু করে।
- পায়ে ফোলা: বিশেষ করে গোড়ালি ও পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া, জুতো আঁটসাঁট লাগা। সকালের দিকে কম থাকে, দিনের বেলায় বাড়ে।
- হাত ফোলা: আঙুলে আংটি আঁটসাঁট লাগা।
- মুখ ফোলা: বিশেষ করে চোখের নিচে বা গাল ফুলে যাওয়া (সকালে বেশি দেখা যায়)।
- পেট ফুলে যাওয়া বা শ্বাসকষ্ট: তরল জমার কারণে।
- অবিরাম ক্লান্তি ও দুর্বলতা: কিডনি যখন রক্ত শোধন করতে পারে না, তখন রক্তে বর্জ্য পদার্থ (যেমন ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন) জমতে থাকে। এর পাশাপাশি কিডনি থেকে উৎপন্ন হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন, এরিথ্রোপয়েটিন (EPO), কম উৎপন্ন হয় যা লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। এর ফলে:
- রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া) দেখা দেয়।
- দুর্বলতা, অবসাদ, শক্তি কমে যাওয়া অনুভব হয়।
- সহজেই হাঁপিয়ে ওঠা, সামান্য কাজেই ক্লান্তি ভর করা।
- মনোযোগ দিতে অসুবিধা হওয়া।
- শ্বাসকষ্ট: এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করতে পারে:
- ফুসফুসে তরল জমা: কিডনি অকার্যকর হলে শরীরে পানি জমে ফুসফুসেও পানি চলে আসতে পারে (পালমোনারি ইডিমা)।
- রক্তশূন্যতা: শরীরে অক্সিজেন বহনকারী লোহিত রক্তকণিকার অভাব।
- রক্তে অম্লতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (মেটাবলিক অ্যাসিডোসিস): কিডনি অ্যাসিড বের করতে না পারলে।
- হৃদযন্ত্রের উপর চাপ: কিডনি রোগ ও উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- বমি বমি ভাব, বমি ও ক্ষুধামন্দা: রক্তে বর্জ্য পদার্থের মাত্রা বেড়ে গেলে (ইউরেমিয়া) এটি সরাসরি পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রকে প্রভাবিত করে।
- প্রচণ্ড বমি বমি ভাব, বিশেষ করে সকালবেলা।
- বমি হওয়া।
- খাবারে অরুচি, মুখের স্বাদ বদলে যাওয়া (মেটালিক টেস্ট)।
- ওজন কমে যাওয়া।
- চুলকানি ও ত্বকের শুষ্কতা: কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করতে ব্যর্থ হলে, সেই বিষাক্ত পদার্থগুলো ত্বকের নিচে জমা হতে পারে।
- তীব্র, অবিরাম চুলকানি যা সহজে কমে না (ইউরেমিক প্রুরিটাস)।
- ত্বক শুষ্ক, ফ্যাকাশে বা বাদামি বর্ণের হয়ে যাওয়া।
- ত্বকে সহজেই কালশিটে পড়া বা র্যাশ বের হওয়া।
- পেশিতে টান পড়া ও দুর্বলতা: কিডনি ইলেক্ট্রোলাইট (যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম) এর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না।
- পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেলে (হাইপারক্যালেমিয়া) পেশিতে দুর্বলতা, অসাড়তা বা এমনকি হৃদযন্ত্রের সমস্যা হতে পারে।
- ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ভারসাম্যহীনতা হাড় দুর্বল করে (রেনাল অস্টিওডিস্ট্রফি) এবং পেশিতে ব্যথা ও ক্র্যাম্প (টান) তৈরি করতে পারে।
- সর্বদা ঠান্ডা লাগা: রক্তশূন্যতার কারণে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যায়, ফলে:
- অন্যান্যরা যখন স্বাভাবিক অনুভব করছে, তখন আপনার ঠান্ডা লাগতে পারে।
- জ্বর জ্বর ভাব, কাঁপুনি সহ।
- পিঠে বা পাজরের নিচে ব্যথা: এই ব্যথা সব কিডনি রোগের লক্ষণ নয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট অবস্থায় হতে পারে:
- কিডনিতে পাথর: তীব্র, আসা-যাওয়া করা ব্যথা যা কোমর থেকে তলপেট বা কুঁচকিতে ছড়াতে পারে।
- কিডনিতে সংক্রমণ (পায়েলোনেফ্রাইটিস): জ্বর, কাঁপুনি সহ পিঠের একপাশে বা দুপাশে ব্যথা।
- পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ: বড় হয়ে যাওয়া কিডনির কারণে পেটে বা পিঠে অস্বস্তি বা ভরাট ভাব।
- নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ ও স্বাদে পরিবর্তন: রক্তে ইউরিয়া জমে গেলে তা লালাকে ভেঙে অ্যামোনিয়া তৈরি করতে পারে।
- মুখে ধাতব স্বাদ বা অ্যামোনিয়ার মতো গন্ধ আসা (ইউরেমিক ফিটোর)।
- খাবারের স্বাদ, বিশেষ করে মাংসের স্বাদ পছন্দ না হওয়া।
কেন এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়? কিডনি রোগের পিছনে লুকিয়ে থাকা কারণসমূহ (H2)
কিডনির সমস্যা একদিনে তৈরি হয় না। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা কিডনির ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে, ধীরে ধীরে তার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় কারণগুলো হলো:
- ডায়াবেটিস (মধুমেহ): বাংলাদেশে কিডনি বিকল হওয়ার প্রধান কারণ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তে শর্করা রক্তনালীসহ কিডনির সূক্ষ্ম ফিল্টারিং ইউনিট (নেফ্রন) ক্ষতিগ্রস্ত করে। একে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি বলে। জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর তথ্যমতে, ডায়ালিসিসে যাওয়া রোগীদের প্রায় ৩০-৪০% ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। (Source: National Kidney Foundation of Bangladesh – Prevalence Data)
- উচ্চ রক্তচাপ: কিডনির রক্তনালীগুলোকে সরু ও শক্ত করে দেয়, ফলে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যায় এবং ফিল্টারিং ক্ষমতা নষ্ট হয়। আবার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়।
- কিডনির প্রদাহ (গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস): কিডনির ফিল্টারিং ইউনিটগুলোর (গ্লোমেরুলাস) প্রদাহ। বিভিন্ন ইনফেকশন (যেমন গলাব্যথার স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া) বা অটোইমিউন রোগ (যেমন লুপাস) এর কারণে হতে পারে।
- পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (PKD): একটি বংশগত রোগ যেখানে কিডনিতে অসংখ্য সিস্ট (তরলপূর্ণ থলে) তৈরি হয়, ধীরে ধীরে কিডনির স্বাভাবিক টিস্যুকে নষ্ট করে দেয়।
- বারবার কিডনিতে সংক্রমণ (ইউটিআই ও পায়েলোনেফ্রাইটিস): বারবার সংক্রমণ হলে কিডনির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
- কিডনিতে পাথর: বড় পাথর কিডনির নালী বন্ধ করে দিতে পারে, দীর্ঘস্থায়ী বাধা কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
- প্রদাহবিরোধী ব্যথানাশক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার (NSAIDs): আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে বা উচ্চ মাত্রায় সেবন কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বাংলাদেশে ব্যথানাশকের সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার এটিকে একটি বড় ঝুঁকির কারণ করে তুলেছে।
- প্রোস্টেট গ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (পুরুষদের ক্ষেত্রে): প্রস্রাবের পথে দীর্ঘস্থায়ী বাধা কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
- হৃদরোগ: হৃদযন্ত্র ও কিডনি একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটির সমস্যা অন্যটিকে প্রভাবিত করে।
- ধূমপান: কিডনির রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কিডনিতে রক্ত চলাচল কমায়।
- স্থূলতা: ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়, কিডনির ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করে।
- বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিডনির কার্যকারিতা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কমতে থাকে।
- পরিবারের ইতিহাস: কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেশি।
কিডনি রোগ কতটা মারাত্মক? বাংলাদেশের ভয়াবহ চিত্র (H2)
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ নেফ্রোলজি (ISN) এর মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কোনো না কোনো ধরনের কিডনি রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে এই সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU) এর নেফ্রোলজি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ৩৫-৪০ হাজার নতুন রোগী শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগে (ESRD) আক্রান্ত হচ্ছেন, যাদের নিয়মিত ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া বাঁচার উপায় নেই। (Source: Seminar Proceedings, Department of Nephrology, BSMMU – 2023)
কিডনি রোগের পর্যায় (CKD Stages):
পর্যায় (Stage) | eGFR (ml/min/1.73m²) | বর্ণনা | ঝুঁকি |
---|---|---|---|
১ | ৯০ বা তার বেশি | কিডনি স্বাভাবিক কিন্তু প্রোটিনুরিয়া বা অন্য ক্ষতির লক্ষণ থাকতে পারে | স্বল্প ঝুঁকি |
২ | ৬০-৮৯ | কিডনির কার্যকারিতা হালকাভাবে কমে গেছে | স্বল্প ঝুঁকি |
৩a | ৪৫-৫৯ | কিডনির কার্যকারিতা মাঝারি থেকে মাঝারি-মাত্রায় কমে গেছে | মাঝারি ঝুঁকি |
৩b | ৩০-৪৪ | কিডনির কার্যকারিতা মাঝারি থেকে গুরুতর মাত্রায় কমে গেছে | মাঝারি ঝুঁকি |
৪ | ১৫-২৯ | কিডনির কার্যকারিতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে | উচ্চ ঝুঁকি |
৫ | ১৫-এর নিচে | কিডনি বিকল (ESRD)। ডায়ালিসিস বা প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। | সর্বোচ্চ ঝুঁকি |
(eGFR = আনুমানিক গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট; কিডনি কতটা ভালোভাবে রক্ত ফিল্টার করছে তার পরিমাপ)
ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন – দুঃস্বপ্নের মতো বাস্তবতা: এই চিকিৎসাগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি। বাংলাদেশে বছরে একজন ডায়ালিসিস রোগীর খরচ পড়ে গড়ে ৩-৫ লাখ টাকা, যা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। সরকারি হাসপাতালে সুবিধা সীমিত, বেসরকারি হাসপাতালের খরচ অনেক বেশি। কিডনি প্রতিস্থাপন আরও জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। এই আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক চাপ রোগী ও পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়।
আমার সাক্ষাৎ: শিরিন আক্তারের যুদ্ধ (H3)
(কল্পিত কিন্তু বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা)
“সব শুরু হয়েছিল অল্প অল্প পা ফুলে আর ভীষণ দুর্বলতা দিয়ে,” বলছিলেন শিরিন আক্তার (৪৫), যিনি এখন সপ্তাহে তিনবার ডায়ালিসিস নিচ্ছেন। “ধরে নিলাম গরমের ক্লান্তি, হয়তো একটু বেশি লবণ খেয়েছি। ডাক্তার দেখাতে গেলাম অনেক দেরিতে, যখন প্রস্রাবে প্রচুর প্রোটিন লিক হচ্ছে আর কিডনির কার্যকারিতা ২০% নেমে এসেছে।” শিরিনের মতো হাজারো মানুষের কণ্ঠে একই আফসোস: “কিডনির সমস্যা চেনার লক্ষণ গুলো আগে জানা থাকলে…!”
কিডনি সুস্থ রাখার উপায়: প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা (H2)
যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের লক্ষণ স্পষ্ট নয়, তাই সচেতনতাই হাতিয়ার। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন আপনার কিডনিকে দীর্ঘদিন সুরক্ষিত রাখতে পারে:
- ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: যদি এই রোগগুলো থেকে থাকে, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ওষুধ সেবন, নিয়মিত ব্লাড সুগার ও ব্লাড প্রেসার মনিটর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষ্য রাখুন HbA1c এবং রক্তচাপ টার্গেটের মধ্যে আছে কিনা।
- স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন: স্থূলতা কমাতে ব্যায়াম ও সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।
- সক্রিয় জীবনযাপন করুন: প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা বা অন্য কোনো মধ্যম মাত্রার ব্যায়াম করুন। (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে: সকাল-সন্ধ্যা পার্কে হাঁটা, সিঁড়ি ব্যবহার করা)।
- ধূমপান ত্যাগ করুন: ধূমপান কিডনির রক্তনালীকে সরু করে ক্ষতি করে। আজই ছাড়ার চেষ্টা করুন।
- ওভার-দ্য-কাউন্টার ব্যথানাশক সাবধানে সেবন করুন: আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে বা ঘন ঘন সেবন করবেন না। প্যারাসিটামল তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, তবে সেটাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন: স্বাভাবিক অবস্থায় দিনে ৮-১০ গ্লাস (২-২.৫ লিটার) পানি পান করুন। পর্যাপ্ত পানি পান কিডনিতে পাথর ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। তবে হার্ট বা কিডনি রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে পানি গ্রহণের পরিমাণ ঠিক করুন।
- সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
- লবণ (সোডিয়াম) কম খান: রান্নায় লবণ কম দিন, প্রক্রিয়াজাত খাবার (চিপস, নুডুলস, প্যাকেটজাত স্যুপ, আচার, সস), ক্যানড ফুড, ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। লক্ষ্য দিনে ১ চা চামচ (৫-৬ গ্রাম) এর নিচে।
- প্রোটিনের পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত রাখুন: অতিরিক্ত প্রোটিন (বিশেষ করে রেড মিট) কিডনির ওপর চাপ ফেলে। ডাল, ডিম, মাছ, চিকেন পরিমিত পরিমাণে খান। কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ থাকলে প্রোটিনের পরিমাণ ডাক্তারের সাথে আলোচনা করুন।
- ফলমূল ও শাকসবজি: এগুলোতে থাকা ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিডনিকে সুস্থ রাখে। তবে কিডনি রোগের অগ্রসর পর্যায়ে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ কিছু ফল (কলা, কমলা, আঙুর, টমেটো) সীমিত করতে হতে পারে।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও চিনি কম খান: হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বছরে অন্তত একবার:
- রক্ত পরীক্ষা: সিরাম ক্রিয়েটিনিন (eGFR বের করার জন্য), ইউরিয়া, ইলেক্ট্রোলাইট (সোডিয়াম, পটাশিয়াম), ব্লাড সুগার (ফাস্টিং ও PP)।
- প্রস্রাব পরীক্ষা: প্রোটিনের উপস্থিতি (অ্যালবুমিনুরিয়া/প্রোটিনুরিয়া), রক্ত, সংক্রমণ ইত্যাদি দেখার জন্য। একটি সহজ ডিপস্টিক টেস্ট (Urine R/E) বা ACR (অ্যালবুমিন-টু-ক্রিয়েটিনিন রেশিও) টেস্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- রক্তচাপ মাপা।
এই পরীক্ষাগুলো (বিশেষ করে প্রস্রাব ও ক্রিয়েটিনিন) খুব সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ভালো কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে (স্টেজ ১-৩) ধরা পড়লে জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও ওষুধের মাধ্যমে কিডনির ক্ষতি অনেকটাই ধীর করা বা থামানো সম্ভব।
কখন ডাক্তার দেখাবেন? (H3)
উপরে বর্ণিত কিডনির সমস্যা চেনার লক্ষণ গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি যদি টানা কয়েকদিন বা সপ্তাহ ধরে থাকে, তাহলে দেরি না করে অবশ্যই একজন নেফ্রোলজিস্ট (কিডনি বিশেষজ্ঞ) অথবা অন্তত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। বিশেষ করে যদি আপনার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগের পারিবারিক ইতিহাস বা দীর্ঘদিন ব্যথানাশক সেবনের ইতিহাস থাকে।
জেনে রাখুন (FAQs – H2)
- প্রশ্ন: প্রস্রাবে সামান্য ফেনা দেখলেই কি কিডনি রোগ?
- উত্তর: সবসময় না। একবারের জন্য সামান্য ফেনা দেখা গেলে তা উদ্বেগের বিষয় নাও হতে পারে (যেমন প্রস্রাব দ্রুত করা, ডিহাইড্রেশন)। কিন্তু যদি ফেনা খুব বেশি হয়, ঘন ঘন হয় এবং টয়লেটে অনেকক্ষণ (কয়েক মিনিট) স্থায়ী হয়, তাহলে তা প্রোটিনুরিয়ার লক্ষণ হতে পারে, যা কিডনি ক্ষতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করান (Urine R/E এবং Urine ACR টেস্ট)।
- প্রশ্ন: রাতে বারবার প্রস্রাব করতে ওঠা (নক্টুরিয়া) মানেই কি কিডনি খারাপ?
- উত্তর: নক্টুরিয়ার অন্য কারণও থাকতে পারে, যেমন প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হওয়া (পুরুষদের ক্ষেত্রে), মূত্রথলির সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বা ঘুমের আগে বেশি পানি পান করা। তবে, এটি কিডনির সমস্যা চেনার লক্ষণ গুলোর মধ্যে একটি, বিশেষ করে যদি প্রস্রাবের পরিমাণও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। অন্য কারণগুলো বাদ দিতে এবং কিডনি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ডাক্তার দেখানো উচিত।
- প্রশ্ন: কিডনি পরীক্ষা করতে কী কী টেস্ট করাতে হয়? খরচ কেমন?
- উত্তর: প্রাথমিক স্ক্রিনিং এর জন্য দুটি সহজ ও তুলনামূলক সস্তা টেস্ট যথেষ্ট:
- প্রস্রাব পরীক্ষা (Urine Routine Examination – R/E): প্রোটিন, রক্ত, সংক্রমণ ইত্যাদি দেখে। খরচ: ১০০-৩০০ টাকা (বাংলাদেশ)।
- রক্তের ক্রিয়েটিনিন টেস্ট (Serum Creatinine): এর থেকে eGFR (কিডনির ফিল্টার করার ক্ষমতা) বের করা হয়। খরচ: ২০০-৫০০ টাকা।
- Urine ACR (অ্যালবুমিন-টু-ক্রিয়েটিনিন রেশিও): প্রস্রাবে অ্যালবুমিনের পরিমাণ মাপার আরও স্পর্শকাতর পরীক্ষা। খরচ: ৪০০-৮০০ টাকা।
- প্রাথমিক পরীক্ষায় কোনো সমস্যা ধরা পড়লে ডাক্তার আরও টেস্ট (ইউরিন কালচার, আল্ট্রাসনোগ্রাম, সিস্টাটিন সি, কিডনি বায়োপসি ইত্যাদি) দিতে পারেন।
- উত্তর: প্রাথমিক স্ক্রিনিং এর জন্য দুটি সহজ ও তুলনামূলক সস্তা টেস্ট যথেষ্ট:
- প্রশ্ন: কিডনি রোগ একবার হলে কি আর ভালো হয় না?
- উত্তর: এটি রোগের ধরন ও পর্যায়ের উপর নির্ভর করে।
- তীব্র কিডনি আঘাত (Acute Kidney Injury – AKI): হঠাৎ কোনো কারণে (গুরুতর ডিহাইড্রেশন, সংক্রমণ, ব্যথানাশক, বাধা) কিডনির কার্যকারিতা দ্রুত কমে গেলে, সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসায় এটি প্রায়শই সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সেরে উঠতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (Chronic Kidney Disease – CKD): সাধারণত স্থায়ী ক্ষতি। প্রাথমিক পর্যায়ে (স্টেজ ১-৩) ধরা পড়লে জীবনযাত্রার পরিবর্তন (লবণ-প্রোটিন কমানো, রক্তচাপ-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান ছাড়া) এবং ওষুধের মাধ্যমে রোগের অগ্রগতি অনেক ধীর করা বা থামানো যায়, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। পরবর্তী পর্যায়ে (স্টেজ ৪-৫) চিকিৎসার লক্ষ্য থাকে জটিলতা নিয়ন্ত্রণ এবং ডায়ালিসিস বা প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া।
- উত্তর: এটি রোগের ধরন ও পর্যায়ের উপর নির্ভর করে।
- প্রশ্ন: বাংলাদেশে কিডনি রোগের চিকিৎসা (ডায়ালিসিস/প্রতিস্থাপন) এর ব্যয়ভার সরকার কীভাবে সাহায্য করে?
- উত্তর: বাংলাদেশ সরকার কিছুটা সহায়তা করে:
- সরকারি হাসপাতালে ডায়ালিসিস: নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে ডায়ালিসিসের সুবিধা আছে (যেমন BSMMU, DMCH, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে)। তবে রোগীর চাপ বেশি, মেশিন ও সিট সীমিত, তাই অপেক্ষার তালিকা দীর্ঘ।
- স্বাস্থ্য বীমা: ‘শেখ হাসিনা জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা’সহ কিছু জেলায় পাইলট প্রকল্প চলছে, যা নির্দিষ্ট পরিমাণে ডায়ালিসিস খরচ বহন করে।
- প্রতিস্থাপন: সরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় (যেমন BSMMU, DMCH), খরচ তুলনামূলক কম, কিন্তু অপেক্ষা দীর্ঘ এবং ডোনার ম্যাচ খুঁজে পাওয়া জটিল।
- এনজিও সহায়তা: জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন (NKF) সহ কিছু সংস্থা আর্থিকভাবে অসহায় রোগীদের কিছুটা সাহায্য করে।
- তবে, সার্বিকভাবে ব্যয়ভার রোগী ও পরিবারের উপরই বেশি পড়ে। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালিসিসের খরচ অনেক বেশি (প্রতি সেশন ৩,০০০ – ৬,০০০+ টাকা)। তাই প্রতিরোধ ও প্রাথমিক সনাক্তকরণই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
- উত্তর: বাংলাদেশ সরকার কিছুটা সহায়তা করে:
আপনার কিডনি নীরবে আপনার জন্য অকল্পনীয় পরিশ্রম করে চলে; এর যত্ন নেওয়া আপনার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। উপরে বর্ণিত কিডনির সমস্যা চেনার লক্ষণ বা জরুরি সতর্ক সংকেত গুলো সম্পর্কে সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই পারে এই অমূল্য অঙ্গ দুটিকে সুস্থ রাখতে। রফিকুল বা শিরিনের মতো কারো ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না। সামান্য সন্দেহ হলেই দেরি করবেন না – আজই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার সচেতনতাই পারে একটি সুস্থ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।