আপনার চোখ দুটোই যে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ক্যামেরা। কিন্তু সেই ক্যামেরার লেন্স যখন ঘোলাটে হয়ে আসে, ফোকাস যখন ঝাপসা হতে শুরু করে, তখন কি মনে হয় না জীবনের সব রঙ যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে? স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা, দূষণ, ভুল খাদ্যাভ্যাস, আর ব্যস্ত জীবনের চাপ – আমাদের চোখের অমূল্য দৃষ্টিশক্তি দিন দিন ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চশমা বা কন্টাক্ট লেন্সের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, অনেকেরই চিন্তা, “চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়ানোর উপায় আদৌ আছে কি?” আশার কথা হলো, হ্যাঁ, আছে! দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা বা চশমা ছাড়া সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু একে সুস্থ, সতেজ রাখা এবং আরও উন্নত করার জন্য আপনি অনেক কিছুই করতে পারেন। এই লেখাটি আপনার জন্য – যিনি চান তার চোখ দুটো যেন আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক, পৃথিবীকে পরিষ্কারভাবে দেখুক।
চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়ানোর উপায়: প্রাকৃতিক পন্থা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন
দৃষ্টিশক্তি শুধু চশমার নম্বর নয়, এটি সামগ্রিক চোখের সুস্থতার প্রতিফলন। কিছু প্রাকৃতিক পন্থা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনি আপনার চোখের পেশীগুলিকে শক্তিশালী করতে পারেন, রক্তসঞ্চালন বাড়াতে পারেন এবং চোখের ক্লান্তি দূর করতে পারেন, যা দৃষ্টির স্পষ্টতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- চোখের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস (Diet for Eagle Eyes):
- ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার: রেটিনার জন্য অপরিহার্য। গাজর, মিষ্টি আলু, কুমড়ো, পালং শাক, কলমি শাক, লাল শাক, আম, ডিমের কুসুম, দুধ। এগুলো দৃষ্টিশক্তি রাতকানা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- লুটেইন ও জিয়াজ্যান্থিন: প্রাকৃতিক সানগ্লাসের মতো কাজ করে, নীল আলো শোষণ করে ম্যাকুলাকে রক্ষা করে। সবুজ শাকসবজি (পালং, ব্রকলি, শালগম শাক, লাউ শাক), ভুট্টা, ডিমের কুসুম।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: রেটিনার কোষের গঠন ও কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, চোখ শুষ্কতা কমায়। ফ্যাটি ফিশ (স্যালমন, ম্যাকারেল, সার্ডিন), আখরোট, ফ্লাক্সসিড, চিয়া সিড।
- ভিটামিন সি ও ই: শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, চোখের লেন্স ও রেটিনাকে ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। সাইট্রাস ফল (লেবু, কমলা), বেল পেপার, স্ট্রবেরি, বাদাম (আমন্ড, কাজু), বীজ (সূর্যমুখী), ভেজিটেবল অয়েল।
- জিঙ্ক: রেটিনায় ভিটামিন এ পরিবহনে সাহায্য করে। মাংস, ডাল, বাদাম, বীজ, গোটা শস্য।
- হাইড্রেশন: পর্যাপ্ত পানি পান চোখ শুষ্কতা রোধ করে এবং সামগ্রিক টিস্যু স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক।
সূত্র: National Eye Institute – Diet and Nutrition, American Academy of Ophthalmology – Diet and Eye Health
- চোখের ব্যায়াম ও বিশ্রাম (Eye Gym and Rest):
- ২০-২০-২০ রুল: প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকানোর পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য কমপক্ষে ২০ ফুট (৬ মিটার) দূরের কোনও বস্তুর দিকে তাকান। এটি সিলিয়ারি পেশীকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করে।
- ফোকাসিং এক্সারসাইজ (পেন্সিল পুশ-আপস): একটি পেন্সিল নাকের সামনে আনুন যতক্ষণ না সেটি ঝাপসা দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে দূরে সরান যতক্ষণ না আবার পরিষ্কার দেখা যায়। এটি নিকট ও দূরের ফোকাস ক্ষমতা উন্নত করে।
- চোখ ঘোরানো: চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে চোখের মণি ঘড়ির কাঁটার দিকে ও বিপরীতে ঘোরান। তারপর চোখ খুলে একই কাজ করুন। এটি চোখের পেশীর নমনীয়তা বাড়ায়।
- পামিং: হাত দুটি ঘষে গরম করুন, চোখ বন্ধ করে হাতের তালু চোখের উপর হালকাভাবে রাখুন (চোখে চাপ দেবেন না)। গভীর শ্বাস নিন, অন্ধকার ও উষ্ণতা উপভোগ করুন ১-২ মিনিট। এটি গভীর বিশ্রাম দেয়।
- ঘন ঘন পলক ফেলা: স্ক্রিনের দিকে তাকালে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে কম পলক ফেলি, যার ফলে চোখ শুষ্ক হয়। সচেতনভাবে ঘন ঘন পলক ফেলার অভ্যাস করুন।
- দৈনন্দিন অভ্যাসে সচেতনতা (Lifestyle Tweaks for Better Vision):
- পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুমের সময় চোখ পুনরুজ্জীবিত হয় এবং লুব্রিকেন্ট পুনরায় উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন।
- ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ছানি এবং অপটিক নার্ভের ক্ষতির ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় ধূমপান ছাড়া অপরিহার্য।
- সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা: ইউভি রশ্মি চোখের লেন্স ও রেটিনার ক্ষতি করে। বাইরে বের হলে সর্বদা ১০০% ইউভিএ/ইউভিবি প্রোটেকশন সমৃদ্ধ সানগ্লাস পরুন। টুপিও ভালো সুরক্ষা দেয়।
- কাজের পরিবেশ ঠিক করা: কম্পিউটার স্ক্রিন চোখের সমতলে বা সামান্য নিচে রাখুন। স্ক্রিন থেকে দূরত্ব বাহুর দৈর্ঘ্যের (প্রায় ২৫ ইঞ্চি) সমান রাখুন। নন-গ্লেয়ার স্ক্রিন ব্যবহার করুন বা উজ্জ্বলতা কমিয়ে আনুন। যথাযথ আলোর ব্যবস্থা করুন (সামনে বা পাশ থেকে আলো, সরাসরি চোখে বা স্ক্রিনে না)।
- নিয়মিত চোখ পরীক্ষা: বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসকের (অপথ্যালমোলজিস্ট) কাছে বছরে অন্তত একবার বা তার নির্দেশ অনুযায়ী চোখ পরীক্ষা করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু পাওয়ার চেক নয়, গ্লুকোমা, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির মতো মারাত্মক কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ শনাক্তের জন্য জরুরি।
চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নয়নে চিকিৎসা ও প্রযুক্তির ভূমিকা
প্রাকৃতিক পদ্ধতিগুলো চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা ও দৃষ্টির কিছুটা উন্নতিতে সাহায্য করলেও, রিফ্র্যাক্টিভ এরর (মায়োপিয়া, হাইপারমেট্রোপিয়া, অ্যাস্টিগম্যাটিজম) বা অন্যান্য চোখের রোগের জন্য চিকিৎসা-সম্মত সমাধান প্রয়োজন।
- সংশোধনমূলক লেন্স (Corrective Lenses):
- চশমা (Eyeglasses): সবচেয়ে সহজ, নিরাপদ ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। নিয়মিত চেক-আপের মাধ্যমে পাওয়ার পরিবর্তন হলে লেন্স পরিবর্তন করা যায়।
- কন্টাক্ট লেন্স (Contact Lenses): চশমার বিকল্প, বৃহত্তর দৃষ্টিক্ষেত্র দেয়। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবহারবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়, নতুবা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
- রিফ্র্যাক্টিভ সার্জারি (Refractive Surgery): দীর্ঘমেয়াদী চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স ছাড়া সুস্পষ্ট দৃষ্টির জন্য।
- লেসিক (LASIK – Laser-Assisted In Situ Keratomileusis): সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। কর্নিয়ার একটি পাতলা স্তর (ফ্ল্যাপ) তৈরি করে, তার নিচের কর্নিয়ার টিস্যুকে লেজার দিয়ে রিশেপ করে দৃষ্টিশক্তি ঠিক করা হয়, তারপর ফ্ল্যাপটি আবার বসিয়ে দেওয়া হয়।
- প্রিসাইট লেসিক (PRK – Photorefractive Keratectomy): LASIK-এর আগের পদ্ধতি। এখানে কর্নিয়ার বাইরের এপিথেলিয়াল স্তর সরিয়ে তারপর লেজার প্রয়োগ করা হয়। ফ্ল্যাপ না থাকায় কিছু ক্রীড়াবিদ বা কর্নিয়া পাতলা রোগীদের জন্য উপযোগী। রিকভারি সময় LASIK-এর চেয়ে কিছুটা বেশি।
- SMILE (Small Incision Lenticule Extraction): তুলনামূলক নতুন পদ্ধতি। LASIK-এর মতো ফ্ল্যাপ তৈরি না করে, কর্নিয়ার ভিতরে একটি ছোট লেনটিকুল তৈরি করে তা একটি ছোট ছিদ্র দিয়ে বের করে আনা হয়। কম শুষ্ক চোখের সমস্যা হতে পারে বলে দাবি করা হয়।
- সতর্কতা: প্রতিটি সার্জারিরই নির্দিষ্ট যোগ্যতা, ঝুঁকি ও সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। একজন অভিজ্ঞ কর্নিয়া ও রিফ্র্যাকটিভ সার্জনের সাথে বিস্তারিত পরামর্শ করে, আপনার চোখের গঠন, পুরুত্ব, চোখ শুষ্কতার মাত্রা, লাইফস্টাইল ইত্যাদি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সার্জারি শুধুমাত্র উপযুক্ত প্রার্থীদের জন্যই। বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চক্ষু বিভাগগুলোতে এ সম্পর্কে পরামর্শ পাওয়া যায়।
- অর্থোক্যারাটোলজি (Orthokeratology – Ortho-K): বিশেষ ধরনের রিজিড গ্যাস পারমিয়েবল কন্টাক্ট লেন্স যা রাতে পরলে কর্নিয়ার আকৃতি সাময়িকভাবে পরিবর্তিত হয়। দিনের বেলা লেন্স ছাড়াই পরিষ্কার দৃষ্টি পাওয়া যায়। মূলত হালকা থেকে মাঝারি মায়োপিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর। নিয়মিত ব্যবহার বন্ধ করলে কর্নিয়া ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। শিশু-কিশোরদের মায়োপিয়া বৃদ্ধির হার কমাতেও কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে বলে গবেষণা আছে।
সূত্র: American Academy of Ophthalmology – Refractive Surgery, FDA – LASIK
বিশেষ অবস্থা ও ভ্রান্ত ধারণা (Special Conditions and Myths)
- বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন (AMD): কেন্দ্রীয় দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসা (ইনজেকশন, লেজার) এবং বিশেষ পুষ্টি উপাদান (AREDS/AREDS2 ফর্মুলা) অগ্রগতি ধীর করতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু দৃষ্টি পুরোপুরি ফেরানো যায় না। নিয়মিত চেক-আপ অপরিহার্য। সূত্র: National Eye Institute – AMD
- ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণই মুখ্য। চোখের নিয়মিত স্ক্রিনিং (ডাইলেটেড আই এক্সাম) এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসা (ইনজেকশন, লেজার) দৃষ্টি রক্ষা করতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার সহজ উপায় সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ।
- ছানি (Cataracts): চোখের স্বচ্ছ লেন্স ঘোলাটে হয়ে দৃষ্টি ঝাপসা করে। একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা হল সার্জারির মাধ্যমে ঘোলাটে লেন্স সরিয়ে কৃত্রিম ইন্ট্রাওকুলার লেন্স (IOL) প্রতিস্থাপন করা। এটি অত্যন্ত সফল ও নিরাপদ একটি অপারেশন।
- চোখের জ্যোতি বাড়ানোর ভুল ধারণা (Common Myths):
- “গাজর খেলেই দৃষ্টিশক্তি বেড়ে যায়”: ভিটামিন এ চোখের জন্য ভালো, কিন্তু শুধু গাজর খেয়ে চশমার পাওয়ার কমে না বা দৃষ্টিশক্তি অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে না। সুষম পুষ্টি জরুরি।
- “চশমা পরলে চোখের পাওয়ার বাড়ে/চোখ নষ্ট হয়”: সম্পূর্ণ ভুল। চশমা শুধু ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টি ঠিক করে। প্রয়োজন আছে বলে পরলে চোখের কোন ক্ষতি হয় না, বরং চোখের উপর বাড়তি চাপ কমে।
- “কম আলোতে পড়লে চোখের ক্ষতি হয়”: কম আলোতে পড়লে চোখ দ্রুত ক্লান্ত হয়, মাথাব্যথা হতে পারে, কিন্তু স্থায়ী ক্ষতি হয় না এমন প্রমাণ নেই। তবে আরামদায়ক আলোতে পড়াই ভালো।
সতর্কীকরণ: এই আর্টিকেলে উল্লিখিত প্রাকৃতিক পদ্ধতি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলি চোখের সামগ্রিক স্বাস্থ্য রক্ষা, দৃষ্টির স্পষ্টতা বজায় রাখা এবং কিছু ক্ষেত্রে উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু এটি চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প নয়। চোখে কোনও সমস্যা (ঝাপসা দেখা, ব্যথা, লাল ভাব, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা, হঠাৎ দৃষ্টি কমে যাওয়া ইত্যাদি) অনুভব করলে অবশ্যই একজন যোগ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞের (অপথ্যালমোলজিস্ট) পরামর্শ নিন। রিফ্র্যাক্টিভ সার্জারি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একজন অভিজ্ঞ সার্জনের সাথে সকল ঝুঁকি ও সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করুন।
ডিপ্রেশন চেনার উপায়: আপনার চারপাশের অদৃশ্য যন্ত্রণাকে চিনবেন কীভাবে?
জেনে রাখুন –
- প্রশ্ন: চোখের দৃষ্টিশক্তি কি প্রাকৃতিক উপায়ে সত্যিই বাড়ানো সম্ভব?
উত্তর: চোখের রিফ্র্যাক্টিভ এরর (মায়োপিয়া, হাইপারমেট্রোপিয়া, অ্যাস্টিগম্যাটিজম) সাধারণত প্রাকৃতিক ব্যায়াম বা খাদ্যাভ্যাসে পুরোপুরি দূর হয় না বা চশমার পাওয়ার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে না। তবে, প্রাকৃতিক পদ্ধতি (সঠিক খাদ্য, ব্যায়াম, বিশ্রাম, সুরক্ষা) চোখের পেশীকে শক্তিশালী করতে পারে, রক্তসঞ্চালন বাড়াতে পারে, চোখের ক্লান্তি দূর করতে পারে এবং সামগ্রিক চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে। এর ফলে বিদ্যমান দৃষ্টিশক্তি আরও স্পষ্ট ও আরামদায়ক অনুভূত হতে পারে, এবং দৃষ্টিশক্তি আরও দ্রুত খারাপ হওয়ার গতি ধীর হতে পারে। বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার পরিবর্তন মায়োপিয়ার অগ্রগতি ধীর করতে সাহায্য করতে পারে। - প্রশ্ন: কোন খাবারগুলি চোখের দৃষ্টিশক্তির জন্য সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী কিছু খাবার হল গাঢ় সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, কেল, ব্রকলি – লুটেইন, জিয়াজ্যান্থিন সমৃদ্ধ), কমলা ও হলুদ ফলমূল ও শাকসবজি (গাজর, মিষ্টি আলু, কুমড়ো, কমলা, আম – বিটা-ক্যারোটিন/ভিটামিন এ সমৃদ্ধ), ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (স্যালমন, ম্যাকারেল, টুনা), ডিম (লুটেইন, জিয়াজ্যান্থিন, জিঙ্ক), বাদাম ও বীজ (আমন্ড, সূর্যমুখীর বীজ – ভিটামিন ই সমৃদ্ধ), এবং সাইট্রাস ফল ও বেরি (ভিটামিন সি সমৃদ্ধ)। মূল কথা হল রঙিন ও পুষ্টিগুণে ভরপুর সুষম খাদ্যাভ্যাস। - প্রশ্ন: কম্পিউটার বা মোবাইলের স্ক্রিন চোখের দৃষ্টিশক্তির জন্য কতটা ক্ষতিকর? কীভাবে রক্ষা পাবেন?
উত্তর: দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে ডিজিটাল আই স্ট্রেন বা কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম হয়। লক্ষণগুলির মধ্যে আছে চোখ শুষ্কতা, জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা। স্ক্রিনের নীল আলোর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়েও গবেষণা চলছে। রক্ষা পেতে ২০-২০-২০ নিয়ম মেনে চলুন, স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা ও কন্ট্রাস্ট আরামদায়ক মাত্রায় রাখুন, স্ক্রিন থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন (প্রায় ২৫ ইঞ্চি), অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্ক্রিন বা চশমা ব্যবহার করুন, ঘন ঘন পলক ফেলুন এবং কৃত্রিম চোখের পানির ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন (চিকিৎসকের পরামর্শে)। - প্রশ্ন: চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম কি সত্যিই কাজ করে? কোন ব্যায়ামগুলি ভালো?
উত্তর: চোখের ব্যায়াম রিফ্র্যাক্টিভ এরর দূর করে না বা চশমার পাওয়ার কমায় না। তবে, এগুলি চোখের পেশীগুলোর নমনীয়তা ও সহনশীলতা বাড়াতে পারে, ফোকাস করার ক্ষমতা উন্নত করতে পারে এবং বিশেষ করে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম বা চোখের ক্লান্তির লক্ষণগুলি কমাতে পারে। কার্যকর কিছু ব্যায়ামের মধ্যে রয়েছে ২০-২০-২০ নিয়ম, ফোকাসিং এক্সারসাইজ (পেন্সিল পুশ-আপস), চোখ ঘোরানো, এবং পামিং। নিয়মিত ও সঠিকভাবে করা গুরুত্বপূর্ণ। - প্রশ্ন: শিশুদের চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে কী করণীয়?
উত্তর: শিশুদের দৃষ্টিশক্তি বিকাশে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। পর্যাপ্ত আলোতে পড়াশোনা করতে দিন। টিভি, কম্পিউটার, মোবাইলের ব্যবহার সীমিত করুন (বিশেষজ্ঞরা সাধারণত ২ বছরের নিচে একদম না, এবং বড় শিশুদের জন্য দিনে ১-২ ঘণ্টার বেশি না বলেছেন)। বাইরে খেলাধুলা ও প্রাকৃতিক আলোর সংস্পর্শে আসার জন্য উৎসাহিত করুন (গবেষণায় বাইরের সময় কাটানো মায়োপিয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে বলে প্রমাণিত)। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করান (জন্মের পর, স্কুলে যাওয়ার আগে এবং প্রতি বছর বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)। শিশু চোখে চোখ চেপে দেখে, খুব কাছে বসে টিভি দেখে, ঘন ঘন চোখ ঘষে, মাথাব্যথার অভিযোগ করলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিন। - প্রশ্ন: লেসিক সার্জারি কতটা নিরাপদ? এর স্থায়িত্ব কতদিন?
উত্তর: লেসিক সার্জারি একটি অত্যন্ত নিরাপদ ও সফল প্রক্রিয়া, তবে যেকোনো সার্জারির মতোই কিছু ঝুঁকি ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেমন সাময়িক শুষ্ক চোখ, ঝাপসা দৃষ্টি, গ্লেয়ার, হালো দেখা, খুব কম ক্ষেত্রে ইনফেকশন বা দৃষ্টি ক্ষতি) থাকে। সঠিক রোগী নির্বাচন (চোখের কর্নিয়া যথেষ্ট পুরু, পাওয়ার স্থিতিশীল, চোখ শুষ্কতা না থাকা ইত্যাদি) এবং একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সার্জন দ্বারা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেসিক সার্জারির ফলাফল সাধারণত স্থায়ী হয়। তবে বয়সের সাথে সাথে প্রেসবায়োপিয়া (৪০-৪৫ বছরের পর কাছের জিনিস ঝাপসা দেখা) হবেই, যা লেসিক দূর করে না। খুব অল্প সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে দৃষ্টি কিছুটা ফিরে আসতে পারে (রিগ্রেশন), যাদের আবার টাচ-আপ বা এনহ্যান্সমেন্ট সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
আপনার দৃষ্টিশক্তি কেবল একটি ইন্দ্রিয় নয়, এটি আপনার বিশ্বকে উপলব্ধি করার, শিখতে, কাজ করতে এবং জীবনকে পূর্ণভাবে উপভোগ করার ক্ষমতা। চোখের দৃষ্টি শক্তি বাড়ানোর উপায় হিসেবে প্রাকৃতিক যত্ন, সচেতন জীবনযাপন এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ – এই তিনটি স্তম্ভ মেনে চললেই আপনি আপনার অমূল্য এই অনুভূতিকে দীর্ঘদিন ধরে সুস্থ, সতেজ ও প্রখর রাখতে পারবেন। মনে রাখবেন, প্রতিরোধ সর্বদা প্রতিকারের চেয়ে শ্রেয়। আজই আপনার চোখের যত্নের রুটিনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করানোর জন্য একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন – এটি আপনার ভবিষ্যতের উজ্জ্বল দৃষ্টির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আপনার চোখের আলো যেন কখনো নিভে না যায়!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।