জুমবাংলা ডেস্ক : গবেষণাগারজুড়ে বাক্সবন্দি হয়ে রয়েছে বিষধর সব সাপ। একটি দুটি নয়। সর্বমোট ৬০টি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কেউটে, গোখরা ও চন্দ্রবোড়ার মতো মারাত্মক বিষধর প্রজাতির সাপ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকরা সাপগুলো সংগ্রহ করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
এছাড়া গবেষণাগারে ডিম ফুটিয়ে কিছু সাপের বাচ্চার জন্ম দেওয়া হয়েছে। অত্যন্ত আদর-যত্নে এগুলোকে লালন পালন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো এদের বিষ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তা থেকে সাপের বিষনাশক (এন্টিভেনম) ওষুধ তৈরি করা।
সাপগুলোর দেখাশোনার জন্য রয়েছেন ছয়জন কর্মী। সাপের আহারের জন্য এখানে ইঁদুর এবং সরীসৃপ প্রাণী পালন করা হচ্ছে। বাইরে থেকে কিনে আনা হচ্ছে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা। প্রকল্পের সহকারী গবেষক মিজানুর রহমান জানান সাপের বাচ্চাগুলোকে তারা নিজেরা হাতে ধরে মুখে তুলে খাইয়ে দেন। “অনেক সময় প্রাপ্তবয়স্ক সাপকেও ধরে খাইয়ে দিতে হয়।”
সর্বমোট ১৫ জন গবেষক এই প্রকল্পে সার্বক্ষণিক গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো দেশে সাপের বিষনাশক ওষুধ উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে এই প্রকল্পের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চমেক মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও যুক্ত রয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যাটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদল।
অনিরুদ্ধ বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। এই মৃত্যুহার আগামী ১০ বছরের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি এই সংস্থা সাপের কামড়ে মৃত্যুকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে অন্যতম প্রধান চিকিৎসা অবহেলাজনিত মৃত্যুর হিসেবে ঘোষণা দেয়। বিশ্বের প্রধান সাপ উপদ্রুত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিকেল বিভাগের তত্ত্বাবধানে সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় উপযুক্ত প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণা চলছে। ছবি: রাজীব রায়হান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। তাদের মধ্যে মারা যান ৬ হাজারের মতো। বন্যার সময় দ্বিতীয় বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান সাপের কামড়ে। সেসময় চারদিকে পানি থাকে বলে সাপগুলো মানুষের বাসায় আশ্রয় নেয়।
সাপের কামড়ের চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোতে যে বিষনাশক ওষুধ ব্যবহৃত হয়, সেসব মূলত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানিকৃত। বিশেষজ্ঞদের মতে ওই ওষুধগুলো থেকে অনেকক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কার্যকারিতা পাওয়া যায় না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. রোবেদ আমিন এই সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “আমদানিকৃত অ্যান্টিভেনমগুলো আমাদের দেশের সাপের বিষের সাথে খুবই কম মিলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই ওষুধের বিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অনেক চিকিৎসক সেই আমদানিকৃত ওষুধ রোগীকে দিতে চান না।”
টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর সভাপতি ড. এমএ ফয়েজ বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিভেনম তৈরি করা উচিত সেই দেশের সাপের বিষ থেকে যে দেশে তা ব্যবহার করা হবে। কেননা, এলাকাভেদে সাপের বিষের তারতম্য হয়।”
এমনকী, এটিও পাওয়া গেছে যে একই দেশে ভিন্ন ভিন্ন জায়গার একই প্রজাতির সাপের বিষের মাত্রায় তারতম্য দেখা যায় বলেও জানান তিনি।
প্রকল্পের সহ-গবেষক ও চমকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ বলেন, গবেষণার প্রথম ধাপে সাপগুলো থেকে বিষ সংগ্রহ করে বিষের উপাদান এবং গুণাগুণ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হবে। তারপর দেখা হবে, বাজারে প্রচলিত সাপের বিষনাশক ওষুধগুলো এই বিষের বিরুদ্ধে কতোটা কার্যকর।
তিনি বলেন, পরবর্তী পর্যায়ে এই বিষের অতি সামান্য অংশ ঘোড়া বা অন্য কোনো সুবিধাজনক প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করানো হবে। ওই প্রাণীর শরীরে বিষের বিরুদ্ধে যে এন্টিবডি তৈরি হবে, তার সিরাম সংগ্রহ করা হবে। সেই সিরাম থেকে পরবর্তীতে সাপের বিষনাশক ওষুধ তৈরি করা হবে।
প্রকল্পের আরেকজন সহ-গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে তারা সাপের বিষ সংগ্রহ ও তার গুণাগুণ বিশ্লেষণ করছেন। এই ধাপের গবেষণা সম্পন্ন হওয়ার পর একে একে পরবর্তী ধাপের গবেষণা শুরু হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত গাইডলাইন মেনেই গবেষণার সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে তিনি জানান। পুরো প্রকল্পটি সম্পন্ন করার প্রাক্কলিত সময় পাঁচ বছর। ২০১৮ সালের মার্চে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে এবং তা চলবে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত।
গবেষকেরা আশা করছেন এই গবেষণা সফলভাবে সম্পন্ন করা গেলে সাপের বিষের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কার্যকরী বিষনাশক ওষুধ এই দেশেই ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা যাবে।
https://www.youtube.com/watch?v=Zr0egcQkrAo&feature=youtu.be
সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।